পূর্বের একই শিরোনামের লেখায় আরাকান তথা রাখাইনের চলমান সংঘাত সংঘর্ষের আলোকে সেখানে মায়ানমার সেনাবাহিনীর এক ধরনের বির্পযয়ের কথা তুলে ধরেছিলাম।
ইতিমধ্যে আমার পাঠকদের এ বিষয়ে অনুসন্ধিৎসা এবং ব্যাপক আগ্রহ আমাকে এ লেখায় মনোনিবেশে আরো বেশি উৎসাহিত করেছে। পাঠকদের অনেকেই আমাকে রাখাইন অঞ্চলের পরিস্থিতি এবং সেখানে আরাকান আর্মির অগ্রাভিযান নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করেছেন। এসব প্রশ্নের মাঝে অনেকেই জানতে চেয়েছেন
‘আরাকান আর্মির কি বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে?’
‘আরাকান কি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে?’
কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন ‘আরাকান আর্মি রাখাইন দখলে নিলে আমাদের দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কতটা সম্ভব হবে?’
কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন ‘আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মায়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ হয়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গারা পরাজিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চাইলে তখন বাংলাদেশ কি ভূমিকা পালন করবে?’
আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন ‘রোহিঙ্গারা কি আদৌ তাদের জন্মস্থানে ফিরে যেতে পারবে?’
এমন প্রশ্নও করেছেন অনেকেই ‘বাংলাদেশের এখন কি আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা উচিত নয়?’
আবার অনেকেই জানতে চেয়েছেন ‘ভবিষ্যৎ এ রোহিঙ্গারা অস্ত্র হাতে তুলে নিলে তখন বাংলাদেশ কি ভূমিকা পালন করবে? বা বাংলাদেশের তখন কি ভূমিকা পালন করা উচিৎ?’
কেউ কেউ আবার এমন কঠিন বিষয়ের অবতারনাও করেছেন, ‘রাখাইনকে ঘিরে বৈশ্বিক ভূ–রাজনীতির সম্ভাবনা আছে কিনা? থাকলে সেরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা কী হতে পারে?’
আমার কাছে প্রশ্নকারীদের এসব প্রশ্নের পিছনে একটি যৌক্তিক কারণ রয়েছে বলে মনে হয়। সে কারণ হল দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা।
আমি প্রশ্নকারীদের স্বদেশ ভূমির প্রতি মমত্ববোধ এবং ভালোবাসাকে আমার অন্তর থেকে শ্রদ্ধা প্রর্দশন করে উপরের প্রশ্নগুলির একে একে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
আরাকান আর্মি’র বাংলাদেশে প্রবেশ করার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ এবং দূর সম্ভাবনার বিষয়। এর কারণ হল অতীতে আরাকান আর্মি যখন তেমন সংগঠিত ছিল না তখনও তারা মায়ানমার সেনাবাহিনীর চাপে বা তাড়া খেয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে কখনো বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি। তবে এর ব্যতিক্রম সেটি ইতিহাস থেকে পাঠ নিলে পাওয়া যায়। ১৭৯১ সালে আরাকানিজরা তাদের সাবেক রাজার বংশধর গুয়েমুর নেতৃত্বে বার্মিজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এ বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এতে আরাকানিজদের প্রতি বার্মিজদের অত্যাচার নিপীড়ন চরম আকার ধারণ করে। এরই প্রতিক্রিয়া হিসাবে আরাকানিজদের সবচেয়ে সাহসী পুরুষ চিন বাইন’এর নেতৃত্বে বার্মিজদের বিরুদ্ধে আরাকানিজদের ভয়াবহতম বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এ বিদ্রোহে চিন বাইন’এর সৈন্যরা আশ্রয় এবং সাহায্যের জন্য তৎকালীন বৃটিশ শাসিত বাংলায় প্রবেশ করত। এই সূত্রে বার্মিজ সৈন্যরা আরাকানিজদের উপর হামলা চালাতে বাংলার সীমান্ত অতিক্রম করার ঘটনা ঘটাত। এরই ফলশ্রুতি ১৮২৪ –১৮২৬ এ্যাংলো বর্তমান যুদ্ধ এবং বৃটিশদের বার্মা দখল। এখনকার পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন। এখন বার্মিজরা আরাকানে কোণঠাসা অবস্থায় সুতরাং যেহেতু আরাকান আর্মি তেমন চাপে নাই তাই তাদের বাংলাদেশে প্রবেশের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আরাকানিজ বা আরাকান আর্মি এখনও তাদের স্বাধীনতার বিষয়টি তেমন জোরালোভাবে উত্থাপন করেনি। বরং তারা পানলুঙ এর পথ ধরে হয়ত মায়ানমারের সাথে একটি লুজ ফেডারেশনের পথেই আগাবে। অন্যদিকে আরাকান আর্মি’র পৃষ্ঠপোষকরাও হয়ত স্বাধীন আরাকান চাইবে না।
এই না চাওয়ার বিষয়টি রাখাইনকে ঘিরে বিদ্যমান ভূ–রাজনীতি এবং অর্থনীতি অংশে পরবর্তী লেখায় ব্যাখ্যার আশা রাখি।
১৯৪২ পর্যন্ত আরাকান তথা রাখাইনে সামাজিক সম্প্রীতি বিদ্যমান ছিল। সে সম্প্রীতির মূলে কুঠারঘাত হানে বৃটিশরা। ভারতীয় উপমহাদেশে যেমন বৃটিশরা ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ অপ কৌশলের মাধ্যমে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা এবং দূরত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল ঠিক তেমনিভাবে আরাকানেও রাখাইন–রোহিঙ্গা বিভেদ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় বিশ্ব–যুদ্ধকালীন বৃটিশরা তাদের পক্ষে ব্যবহার করে। এর ফলে যুগযুগ ধরে দুটি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসকারী সম্প্রদায় চিরদিনের জন্য বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ বিভক্তি শুধু জাতিগত এবং ধর্মীয়ভাবে নয় ভৌগলিকভাবেও সংঘটিত হয়েছে। আরাকান তথা রাখাইন এখন উত্তর দক্ষিণে বিভক্ত। উত্তরে বসবাস করে রোহিঙ্গারা আর দক্ষিণে রাখাইনরা। এরকম জাতিগত, ধর্মীয় এবং ভৌগলিকভাবে বিভক্ত দুটি গোষ্ঠীর মাঝে মেলবন্দন অনেক দুরূহ একটি কাজ হবে। অতএব আরাকান আর্মি রাখাইন স্টেট দখলে নিলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি সহজ না হয়ে জটিলই হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
আরাকান আর্মি’র বিরুদ্ধে মায়ানমার সেনাবাহিনীর হয়ে রোহিঙ্গাদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। কারণ এই মায়ানমার সেনাবাহিনীই রোহিঙ্গাদের নিপীড়ন নির্যাতন চালানোর মাধ্যমে তাদের স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করে। যার জন্য যারা মায়ানমারের ঘটনা প্রবাহের দিকে দৃষ্টি রাখেন তাদের কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্যই ঠেকবে। বিষয়টি খতিয়ে দেখলে এ ঘটনার পিছনে দুটি বিষয় কাজ করে থাকতে পারে বলে প্রতীয়মান। প্রথমটি মনস্ত্তাত্বিক, রোহিঙ্গাদের কাছে রাখাইনদের থেকে বার্মিজদের ঘনিষ্ট অথবা বন্ধুভাবাপন্ন অথবা নির্ভরযোগ্য মনে হয়ে থাকতে পারে। এটির পিছনে সেই ঐতিহাসিক কারণ কাজ করে থাকতে পারে, অর্থাৎ বৃটিশদের দ্বারা সৃষ্ট বিভাজন। দ্বিতীয়ত কারণ হতে পারে বৈশ্বিক, এতে রয়েছে প্রলোভন এবং ধোকা। রোহিঙ্গারা মায়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করলে তাদের নাগরিকত্ব সহ সকল সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। ঘটনা যাই হোক এখন বাস্তবতা হল কোনো ধরনের অলৌকিক কিছু না ঘটলে সে ক্ষেত্রে আরাকানে মায়ানমার সেনাবাহিনী পরাজয়ের মুখামুখি। এ পরিস্থিতিতে তাদের পাশে থেকে যুদ্ধ করা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসা অস্বাভাবিক নয় কারণ এখানে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশের কৌশল প্রণেতাদের এখনই ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ গুলি বিবেচনায় রাখতে হবে। সময় যত যাচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি তত জটিল হয়ে উঠছে।
২০১৭ সালে পরিচালিত অপারেশন ‘ক্লিনজ’ এ রোহিঙ্গা নিপীড়ন নির্যাতন এবং বিতাড়নে মায়ানমার সেনাবাহিনীর দোসর ছিল রাখাইনদের উগ্র জনসমষ্টি। ২০২৪ –২৫ এ এসে মায়নমার সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি যুদ্ধরত। এ দৃশ্যপট পর্যন্ত ঠিক ছিল। ঘটনা জটিল হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের পক্ষভূক্ত হওয়াতে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মায়ানমার সেনাবাহিনীর হয়ে আরাকান আর্মি’র বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছে। চুড়ান্তভাবে আরাকান আর্মি যদি চলমান যুদ্ধে মায়ানমার আর্মি’র বিরুদ্ধে জয়লাভ করে তবে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। সে রকম পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের সহসা স্বদেশ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন প্রলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বাংলাদেশকে এবিষয়টি সব সময় মাথায় রেখে স্বীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
পৃথিবীর দেশে দেশে স্বীয় নিরাপত্তা এবং স্বার্থ রক্ষায় মূলত দুই ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা আমরা জানি। এর একটি ‘ওভারট’ বা প্রকাশ্য যোগাযোগ, এটি কূটনীতিকদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। দ্বিতীয়টি ‘কোভার্ট’ বা গোপন যোগাযোগ, এটি গোয়েন্দা তৎপরতায় পরিচালিত হয়। মায়ানমারের চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে উভয় পন্থাই অবলম্বন করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। অর্থাৎ মায়ানমার সরকারের সাথে নেপিডো’তে যেমন প্রকাশ্য যোগাযোগ রাখতে হবে একইভাবে আরাকান আর্মি’র সাথে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। এটি আমাদের স্বীয় নিরাপত্তা এবং স্বার্থ রক্ষায়। বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ইতিমধ্যে এব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে আমাদের অবিলম্বে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ। অবশিষ্ট প্রশ্নগুলির উত্তর পরের লেখায় স্ববিস্তারে ব্যাখ্যার আশা রাখি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।