সমকালের দর্পণ

রাখাইনে ভূ-রাজনীতি আমাদের জন্য শঙ্কার

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৯:১৭ পূর্বাহ্ণ

গত লেখায় মায়ানমার পরিস্থিতি জটিলতর হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলাম। এ আশঙ্কার অনুষঙ্গ ইতিমধ্যে বেশ জোরালোভাবে আমাদের সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। এ অনুষঙ্গ মায়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ সংক্ষেপে বিজিপির দুই শো’রও অধিক সংখ্যক সদস্যের বাংলাদেশে আশ্রয় প্রার্থনা। এদের মত আরাকান আর্মির সদস্যরাও আমাদের সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় চাইতে আসতে পারে এমনকি মায়ানমার সেনা সদস্যরাও। এসব ঘটবে ভূরাজনীতির জটিল মারপ্যাচের কারণে। মায়ানমারের রাখাইনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ভূঅর্থনীতি সংশ্লিষ্ট দেশ বিশেষ করে ভারত এবং চীনের এক ধরনের অদৃশ্য প্রতিযোগিতা রয়েছে। এ প্রতিযোগিতা তাদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্থাপনাকে ঘিরে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাখাইনের চকপিউতে চীনের গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মালাক্কা প্রণালীতে চীনের অবাধ বাণিজ্য চলাচলের উপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করে আসছে। এ চাপ চীন, দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বশক্তি উপস্থিতি থেকে বহুদিন ধরে অনুভব করে আসছিল। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রফিলিপিন, ভিয়েনাম, তাইওয়ান এবং মালয়েশিয়াকে কখনো কখনো সঙ্গী করে চীনের উপর জোর খাটানোর প্রচেষ্টা প্রদর্শন করেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে চীন তার জন্য নিষ্কণ্টক নিরাপদ পথ খুঁজে বেড়িয়েছে। বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে চীন সেরকম একটি পথের জন্য আমাদের সাথে আলাপ আলোচনায় বেশ এগিয়েও গিয়েছিল। সোনাদিয়া ছিল চীনের সে কাঙ্ক্ষিত সমুদ্র বন্দর গড়ার লক্ষ্য। নানা পক্ষের চাপাচাপির কারণে চীনকে এ লক্ষ্য থেকে সরে যেতে হয়। ভূরাজনীতিতে এ অপ্রাপ্তি চীন একেবারে সহজভাবে নিয়েছে এটা যারা ভাববেন তারা হয়ত ভুল করবেন। রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের রোহিঙ্গাদের বিষয়ে ভূমিকা আমাদের অনেক কিছু ভাবার অবকাশ সৃষ্টি করে দেয়। সোনাদিয়া না হয়ে চকপিউ কেন এবং রোহিঙ্গা সংকট এসব বিষয় হয়ত ভবিষ্যৎ এ ভূরাজনীতি বিষয়ক গবেষকদের জন্য একটি চমকপ্রদ ক্ষেত্র হয়ে দেখা দেবে।

আমাদের সোনাদিয়ায় চীন যেটা করতে পারেনি মায়ানমার রাখাইন স্টেটের চকপিউতে সে সুযোগ চীনের জন্য অবারিত করে দিয়েছে। এ থেকে দক্ষিণ চীন সাগর তথা মালাক্কার ঝক্কি ঝামেলা পরিহার করে চীন বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহা সাগরে যাতায়াতের সহজ পথটি পেয়ে যায়। এটি চীনের তার বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

The Hundred Year Marathon-China’s Secret Strategy to Replace America as the Global Superpower  বইতে ২০৪৯ সালের মধ্যে চায়না কীভাবে আমেরিকাকে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির এক নম্বর পরাশক্তির স্থান থেকে বিচ্যুত করে নিজে সেই স্থান দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছে, তার সবিস্তার বর্ণনা দিয়েছেন। সে বর্ণনার সারমর্ম এ রকম : আগামীতে চায়না এমনই এক বিশ্বব্যবস্থার প্রবর্তন করবে, যা তার জন্য অনুকূল হবে, এমন একটি বিশ্ব যেখানে আমেরিকার আধিপত্য লোপ পাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর উডস এবং সান ফ্রানসিসকো প্রতিষ্ঠিত ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিতে আমেরিকার আধিপত্যকে খর্ব করে চীনের স্বার্থে সে নতুন বিশ্বব্যবস্থা চালু হবে’। আমেরিকা সর্বাত্বকভাবে তার এই অধঃপতন এবং চীনের উত্থানকে ঠেকানোতে নিজেকে নিয়োজিত করবে এবং এটাই স্বাভাবিক।

এ প্রেক্ষাপটে রাখাইনের থা শোয়ে গ্যাসফিল্ড থেকে নির্বিঘ্নে চীন গ্যাস নিয়ে যাবে হয়তো ভবিষ্যতে আমেরিকা তা চাইবে না, চকপিউ ডিপ সি পোর্টের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর হয়ে চীন অবাধে ভারত মহাসাগরে বিচরণ করবে, হয়তো আমেরিকা তাও চাইবে না। রাশিয়াচীন, মধ্য এশিয়াচীন, মালাক্কা হয়ে চীন, এরপর চীনের চতুর্থ বৃহত্তম জ্বালানি সরবরাহ লাইন হুমকির মুখে পড়বে না, হয়তো আমেরিকা তাও চাইবে না। এই পারস্পরিক চাওয়া না চাওয়ার মধ্যেই ভবিষ্যতে মিয়ানমার বিশেষ করে রাখাইনকে ঘিরে দুই পরাশক্তিধর দেশের সংঘাত দেখা দিতে পারে। সেটা রোহিঙ্গা ইস্যুকে ঘিরে আরও দ্রুততার সঙ্গে ঘনীভূত হতে পারে। এ ধরনের সংঘাতময় দৃশ্যপটে ভারত চীনের সঙ্গে তার বর্তমান ভূরাজনৈতিক অবস্থার আলোকে আমেরিকার পক্ষ নিলে তা এই অঞ্চলের জন্য আরও জটিল কঠিন এক আঞ্চলিক নিরাপত্তার সংকট তৈরি করবে।

ভূরাজনীতির বিষয়ে আগ্রহী পর্যবেক্ষকমাত্রই এটা লক্ষ করে থাকবেন, চীন ক্রমশ তার ভূকৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগোচ্ছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড এ ক্ষেত্রে চীনের ঘোষিত বাহন। চীনের মত রাখাইনকে ঘিরে ভারতেরও রয়েছে ভূরাজনীতি এবং ভূঅর্থনৈতিক স্বার্থ। এই স্বার্থের উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে কালাদান মাল্টি মোডাল মাল্টি ট্রানজিট প্রকল্প। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য তার পূর্ব্বাঞ্চলের সাথে সহজ যোগাযোগ স্থাপন। মায়ানমারের সাথে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে সেভেন সিস্টারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির বিদ্রোহী তৎপরতা দমন এবং নিয়ন্ত্রণে রাখা। এক সময় ‘ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি অব আরাকান’ এর দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অভিযানে উত্তরপূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গেরিলা দলের বিপুল সংখ্যক অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী জব্দ করতে সক্ষম হয়েছিল। এই অভিযানে উলফা, পি এল এ, এবং এন সি এন (কে) গেরিলা গোষ্ঠীর ৫০ জন সদস্য নিহত হয়। এক সময় পারস্পরিক সম্মতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী নাগা গেরিলা গোষ্ঠির বিরুদ্ধে মায়ানমারের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনাও করে। এসব অর্জনকে বিবেচনায় রেখে ভারত মায়ানমারের উপর চীনের প্রভাব খর্ব করার মরিয়া প্রচেষ্টায় রত। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে ইতিমধ্যে ভারত থাম্মুকাল্লেমান্দালয় সংযোগ সড়ক ও গড়ে তুলেছে। মায়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন জ্বালানী তেল, গ্যাস ইত্যাদির সহজ লভ্যতা নিশ্চিত করাও ভারতের অন্যতম ভূঅর্থনৈতিক লক্ষ্য। রাখাইন অঞ্চলকে ভিত্তি করে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা এবং সহজ যাতায়াতের মাধ্যমে তা তার পূর্বাঞ্চলে সরবরাহ নিশ্চিত করাও রাখাইনকে ঘিরে ভারতের অন্যতম লক্ষ্য।

চীন তার ভূকৌশলগত স্বার্থে মায়ানমারকে সাথে নিয়ে ভারতকে যেন বেকায়দায় ফেলতে না পারে সে চেষ্টা ভারত বরাবরই করে এসেছে। ভারত তার লুক ইস্ট নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মায়নমারের সীমান্তবর্তী মনিপুরের মোরে শহর থেকে শুরু করে মায়ানমারের উপর দিয়ে থাইল্যান্ডের মায়ে সোট শহর পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করে তাতে তিন দেশকে সংযুক্ত করেছে। উল্লেখ্য মায়ে শোট মায়ানমারথাইল্যান্ডের স্থল বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। এছাড়াও ভারতের রয়েছে মায়ানমারের বাজার দখলের সদূর প্রসারী পরিকল্পনা।

ভারত তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে মায়ানমার সেনাবাহিনীর উপর চীনের প্রভাব হ্রাস করার প্রচেষ্টা বহু দিন ধরে করে আসছে। এ প্রচেষ্টায় মায়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভারত সময়ে সময়ে তার কৌশল পরিবর্তনে ব্রতী হয়েছে। ভারত তার লুক ইস্ট নীতিতে মায়ানমার যে তাকে আসিয়ানের সাথে সম্পর্কযুক্ত করার দ্বার এটি সব সময় বিবেচনায় রেখেছে। এর কারণ মায়ানমারের সাথে ভারতের রয়েছে জল এবং স্থল সীমান্ত যা ভারতের জন্য আসিয়ানের সাথে সরাসরি যোগাযোগের পথ অবারিত করতে পারে। ভারতমায়ানমারের এই পারস্পরিক সমর্থন এবং সৌহার্দ্যের পিছনে রয়েছে পারস্পরিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ।

মায়ানমার সেনাবাহিনীকে ভারতের সমর্থন দানের আরো নানাবিধ উদ্দেশ্য বিদ্যমান। এসব উদ্দেশ্যেও মাঝে রয়েছে একদিকে মায়ানমার সেনাবাহিনীর উপর চীনের প্রভাব খর্ব করা এবং অন্যদিকে আরাকানে প্রাপ্ত গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাস পাওয়া নিশ্চিত করা। বলাবাহুল্য ভারত তাদের শিলগুড়ি নেক ব্যবহার করে রাখাইন অঞ্চল থেকে গ্যাস সুবিধা গ্রহণ করছে। ইতিমধ্যে ভারত রাখাইনের (আরাকান) সিটওয়ে (আকিয়াব) বন্দর থেকে কালাদান নদীর মাধ্যমে মায়ানমারের চিন স্টেটের প্লেটোয়া হয়ে মিজোরামের আইজল পর্যন্ত নৌপথ চালুর সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছে। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিটের ঝক্কিঝামেলা বাদ দিয়ে সহজে তাদের পূর্বাঞ্চলের সাথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। কিন্তু রাখাইনের বর্তমান সংকট ভারতকে তার এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত করবে। এমন পরিস্তিতিতে ভারত বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার মাধ্যমে তার পূর্বাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতে ব্রতী হবে। এটি আমাদের সড়ক পরিবহনের উপর বিদ্যমান চাপকে অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। বিষয়টি আমাদের এখন থেকে বিবেচনায় রাখা উচিৎ।

রাখাইন সংকট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অনিশ্চয়তার তিমিরে নিক্ষেপ করেছে। বিশাল একটি হতাশ জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ শিবির জীবন যেকোনও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সহায়ক। কফি আনান প্রায় ৬ বছর আগে এ বিষয়ে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। তার সাবধান বাণী ছিল এরকম, রাখাইন অঞ্চলের বিরাজমান সমস্যা অচিরে সমাধান না করলে এর থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি বাংলাদেশমায়ানমারকে শুধু নয় বরং পুরা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াকে সংকটের তিমির খাদে নিপতিত করবে। রাখাইন সমস্যা সমাধানে আমরা কোনও ফলপ্রসূ উদ্যোগ এর মধ্যে লক্ষ্য করিনি বরং আরাকান আর্মি এবং মায়ানমার সেনাবাহিনীর বর্তমান সংঘাত এ অঞ্চলের জন্য আরো নতুন এবং জটিলতর সংকটকে উসকে দিয়েছে যা আমাদের জন্য আশা নয় বরং শঙ্কার জন্ম দিয়েছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপোশাক শিল্পের অদম্য জালালউদ্দিন
পরবর্তী নিবন্ধচুনতি লাইটহাউস ও ক্লাব একাত্তরের অমর একুশে বিতর্ক প্রতিযোগিতা