সমকালের দর্পণ

খ্রিষ্টীয় নববর্ষের যাত্রারম্ভে প্রত্যাশা

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ৫ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

আমার পাঠকদের খ্রিষ্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা। বিগত ২০২৪ সাল অন্যান্য অনেক বছরের মত মানব ইতিহাসে খুব একটা উজ্জ্বল সময় হিসাবে পরিগণিত হবে বলে মনে হয় না। মানুষ বিগত এ বছরটিতেও পৃথিবীর নানা প্রান্তে হন্তারক সময় পার করেছে। গাজায় ইসরাইলীদের নির্বিচার নির্বিকার হত্যাকাণ্ড, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে মানুষের নিস্পৃহতা, আমাদের নিকট প্রতিবেশী মায়ানমারে পক্ষ সমূহের মাঝে ক্রমাগত সংঘাত, মধ্যে নিরীহ মানুষের ভোগান্তি, ল্যাটিন আমেরিকানদের ভাগ্যান্বষণে দলে দলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিমুখে অভিবাসনার্থে যাত্রা। এ যাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রীয় সীমান্ত রক্ষীদের হাতে অজস্রজনের মানবেতর বন্দীত্ব মানুষ হিসাবে আমাদের মোটেও গৌরবন্বিত করেনি বরং হেয় করেছে।

মানব ইতিহাসের লজ্জাজনক অধ্যায় অতীতের মত এখনও মানুষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে মানুষ হত্যার জন্য, মানুষ দিনরাত প্ররিশ্রম করছে আরো শক্তিশালী আরো কার্যকর মারণাস্ত্র আবিষ্কারে।

আফ্রিকা এশিয়ার লক্ষ মানুষকে অভূক্ত রেখে ইউরোপ আমেরিকা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করছে ইসরাইল ইউক্রেনে।

২০২৫ সালের যাত্রারম্ভে কায়মনোবাক্যে কামনা করছি। মানুষ মানুষ হত্যা থেকে নিবৃত্ত থাকুক, মানুষ নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কার থেকে অভুক্ত মানুষের খাদ্য যোগানোতে, শিক্ষার অগ্রগতিতে, চিকিৎসায় ঔষধ যোগানো ইত্যাদিতে আত্মনিয়োগ করুক।

স্বদেশের সামাজিক অসঙ্গতি আমাকে বরাবরই ব্যতীত করেছে। এ অসঙ্গতির কথা গল্পের মত হলেও একটি বাস্তব গল্প দিয়ে তুলে ধরছি। মেয়েটি তার বাবার সাথে অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানে গেছে। ঐ সব অনুষ্ঠানের চাকচিক্য জৌলুস মেয়েটির মনে নানা প্রশ্নের জন্মও দিয়েছে, ‘মানুষের টাকা আছে বলে সে এভাবে তা প্রর্দশন করবে? এভাবে অপচয়ের মাধ্যমে নিজেকে জাহির করতে হবে?’

মেয়েটির বাবা অসুস্থ হাসপাতালের শয্যায়। হাসপাতালের ব্যয় নির্বাহে মেয়েটির চোখে শর্ষের ফুল ভাসে। কেউ সামান্য সাহায্যের হাত বাড়ানোর নাই। হাসপাতালে মেয়েটির বাবার মত অনেক বাবা ভাই বোন মা শুয়ে আছে যাদের আত্মীয় পরিজন হাসপাতালের ব্যয় মিটানোর কথা ভেবে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন। মেয়েটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা তার বাবার দিকে দেখে আর ভাবে এই সমাজের ভিত্তবানরা যদি হাসপাতালের চিকৎসাধীন অসহায় মানুষদের দিকে একটু মানবিক হাত বাড়াতেন তা হলে তার বাবার মত মানুষেরা নিশ্চিত ভাল চিকিৎসা পেতেন, এই পৃথিবীতে হয়ত আরো বেশ কিছুদিন ভালোভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ পেতেন। কিন্ত্তু আমাদের সমাজের বিত্তবানরা এ বিষয়টিতে খুব একটা নজর দিচ্ছেন না। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিখ্যাত ধনকুবের রতন টাটার অনুধাবন আর অনুভূতির বিষয়টি তুলে ধরছি।

এক প্রশ্নকারী রতন টাটাকে জিজ্ঞেস করেন ‘আপনি জীবনে সবচেয়ে যখন সুখি হয়েছিলেন সেই মুহূর্তের কথা কি আপনার মনে আছে?

উত্তরে রতন টাটা বলেন ‘আমি জীবনে সুখের চারটি ধাপ অতিক্রম করেছি এবং অবশেষে আমি সুখের অর্থ বুঝতে পেরেছি’।

প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে অর্থ ও মূল্যবান জিনিসপত্র সঞ্চয় এবং সংগ্রহ করলাম, আমি বুঝতে পেরেছিলাম এই জিনিসগুলির প্রভাব সাময়িক এবং মূল্যবান জিনিসগুলির দীপ্তি ক্ষণস্থায়ী।

এরপর আসে বড় প্রকল্প পাওয়ার তৃতীয় ধাপ। আমি ভারত এবং আফ্রিকার ডিজেল সরবরাহের ৯৫% এর মালিক। আমি ভারত এবং এশিয়ার বৃহত্তম ইস্পাত কারখানার মালিকও। কিন্ত্তু এতেও আমি যে সুখের কথা ভেবেছিলাম তা পাইনি।

চতুর্থ ধাপটি ছিল যখন আমার এক বন্ধু আমাকে ২০০ চলৎশক্তিহীন শিশুর জন্য হুইল চেয়ার কিনতে বলেন এবং জোরাজুরি করছিলেন আমি যেন তার সাথে ঐ শিশুদের মাঝে হুইল চেয়ার বিতরণ করতে যাই। আমি শিশুদের মাঝে হুইল চেয়ার বিতরণ করি। শিশুরা হুইল চেয়ারে বসে হাঁটা শুরু করে। আনন্দে তারা উৎসব মুখর হয়ে উঠে, আমার মনে হচ্ছিল হঠাৎ তারা যেন পিকনিকে মেতে উঠেছে। আমি তাদের চোখে মুখে এক অপূর্ব স্বর্গীয় আভা দেখতে পাই। আমি সেদিন আমার মাঝে সত্যিকারের সুখ অনুভব করেছি।

আমি সে অনুভূতি নিয়ে যখন অনুষ্ঠান স্থল ত্যাগ করতে যাব তখন এক শিশু আমার পা চেপে ধরে। আমি পা ছাড়াতে গেলে সে আরো জোরে আমার পা চেপে ধরে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। আমি শিশুটির দিকে ঝুঁকে তার আর কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করি, উত্তরে সে যা বলে তা আমাকে শুধু চমকেই দেয়নি বরং জীবনের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিও পুরাপুরি বদলে দিয়েছে, শিশুটি আমার পা শক্ত করে ধরে রেখে বলতে থাকে ‘আমি তোমার মুখ মনে রাখতে চাই যাতে তোমার সাতে স্বর্গে দেখা হলে তোমাকে চিনতে পারি এবং তোমাকে ধন্যবাদ দিতে পারি’ ঐ শিশুটির কথা ধর্তব্যে নিয়ে আমাদের অনুধাবন করতে হবে, এই জগৎ এবং পার্থিব যাবতীয় কাজকর্ম ত্যাগ করে কেন তোমাকে স্মরণ করা হবে? কেউ তোমার মুখ দেখার জন্য স্বর্গে উদগ্রীব হয়ে থাকবে? কেন? এই কেনর মাঝে উত্তর আছে যাবতীয় সুখের।

এবার পার্থিব জগৎ এ ফিরে আসি। ২০ জানুয়ারি ২০২৫ ডোনাল্ট ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিতে যাচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী খাটানোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমাহীন। এ প্রেক্ষাপটে বারাক ওবামা ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিচ্ছিলেন তখন মালয়েশিয় প্রধানমন্ত্রী ড. মহাথির মোহাম্মদ ওবামার উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন যা আমি বাংলা করে সে সময় একটি দৈনিকে চাপিয়েছিলাম। সে খোলা চিঠিটি ট্‌্রাম্প’এর জন্য আরো বেশি প্রযোজ্য মনে করে এবং নতুন বছরে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা হিসাবে তার অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরলাম।

প্রিয় প্রেসিডেন্ট, আমি আপনার নির্বাচনে আপনাকে ভোট দিতে পারিনি। একজন মালয়েশিয়ান হিসাবে বিষয়টি সম্ভবও ছিল না। তবে আমি নিজেকে আপনার নির্বাচনী এলাকায় একজন ভোটার হিসাবে গণ্য করি, কারণ আপনার গৃহীত সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে আমাকে এবং আমার দেশকে সমান ভাবে প্রভাবিত করবে। আমি আপনার পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। আপনার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক পরিবর্তন একান্ত অপরিহার্য। কারণ আমেরিকা এবং আমেরিকানরা পৃথিবীতে বর্তমানে ঘৃণার পাত্রে পরিণত, এমনকি ইউরোপিয়ানরাও এখন আমেরিকানদের ঔদ্ধত্যকে পছন্দ করে না। পৃথিবীর অনেক দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য এক সময় আমেরিকানরা পৃথিবীতে সম্মানের পাত্র ছিলেন।

মানুষ নতুন বছরেনতুন কর্মযজ্ঞের শুরুতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি কর্ম তালিকা প্রণয়ন করেন। নিশ্চয়ই আপনিও ইতিমধ্যে তা করেছেন। আমি সবিনয়ে আপনার পরিবর্তনের পথ পরিক্রমায় অর্ন্তভুক্তির জন্য কিছু বিষয় তুলে ধরছি।

প্রথমত মানুষ হত্যা বন্ধ করুন। আমেরিকানরা তাদের অভীষ্ট হাসিলে মানুষ হত্যায় মোটেও কার্পণ্য করে না। এ হত্যা যজ্ঞকে আমেরিকানরা বলে যুদ্ধ। এ যুদ্ধ প্রচলিত যুদ্ধ নয়যাতে প্রশিক্ষিত এক যোদ্ধা আরেক যোদ্ধাকে হত্যা করে। আপনাদের বর্তমান যু্‌দ্ধ সে রকম নয়। এখন যুদ্ধে লক্ষ নিরীহ নিরপরাধ মানুষ মারা যায়। এমনকি একটি দেশ ধ্বংসও হয়ে যায়। যু্‌দ্ধ আদিম, সমস্যা সমাধানে গুহা মানবদের পন্থা। আপনি অস্ত্র নির্মাণ এবং আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় যুদ্ধ পরিহার করুণ।

দ্বিতীয়ত: আপনাদের অর্থ আর অস্ত্রে ইসরাইলী হত্যাকারীদের প্রতি পক্ষপাতমূলক সমর্থন বন্ধ করুন। গাজায় আপনাদের যুদ্ধ বিমান অসহায় মানব সন্তানদের নির্বিচার হত্যা করে চলেছে।

তৃতীয়ত: অর্থনৈতিক অবরোধ অনাকাঙ্ক্ষিত, এ অবরোধ যে সব দেশের উপর আরোপ করা হয় তারা ত আপনার দেশের বিরুদ্ধে প্রতি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। আপনাদের অবরোধের কবলে খাদ্য আর ঔষধের অভাবে এক ইরাকেই ৫ লক্ষের উপর শিশু মারা গেছে, হাজারো বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়েছে। এ নির্মমতা থেকে ঘৃণা ছাড়া আপনারা আর কিইবা অর্জন করেছেন?

চতুর্থত: আরো বেশি নিপুন আরো বেশি কার্যকরভাবে মানুষ মারার অস্ত্র আবিষ্কার থেকে আপনাদের বিজ্ঞানীদের নিবৃত্ত করুণ।

পঞ্চমত: আপনাদের অস্ত্র প্রস্তুকারীদের অস্ত্র তৈরি করা থেকে নিরুৎসাহিত করুণ। বিশ্বব্যাপী অস্ত্র বিক্রয় এবং রপ্তানী থেকে নিবৃত্ত থাকুন। অস্ত্রের জন্য পাওয়া অর্থ গরীব মানুষকে বঞ্চিত করে দেওয়া। এ অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র রপ্তানী একেবারে নৈতিকতা বিরোধী অধর্ম।

ষষ্ঠত: পৃথিবীর সব দেশকে গণতন্ত্রের দীক্ষা দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। গণতন্ত্র আমেরিকার জন্য যে রকম উপযোগী অন্য অনেক দেশের জন্য হয়ত তা নাও হতে পারে। গণতন্ত্র কায়েমের জন্য মানুষ হত্যা অনুচিত। আপনারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে একনায়কদের চেয়েও বেশী মানুষ মারার জন্য দায়ী, তারপরও এ ক্ষেত্রে আপনাদের সফলতা আসেনি।

সপ্তমত: ক্যাসিনো ভিত্তিক অর্থনৈতিক কারবার বন্ধ করুন। অদৃশ্য অর্থের লেনদেন সহ সাধ্যের বাইরে আপনাদের ব্যাংকগুলির বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান বন্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। আপনাদের ব্যাংকগুলির উপর নজরদারী জোরদার করুন। অসাধু ব্যাংকারদের সাজা নিশ্চিত করুন।

অষ্টমত: পৃথিবীর জলবায়ূ রক্ষায় প্রণীত সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদন করুন।

নবমত: জাতিসংঘের উপর আস্থা রাখুন একে সম্মান দেখান।

আপনি যদি আমার উত্থাপিত বিষয়গুলির কয়েকটিও বাস্তবায়ন করেন তাতেও ইতিহাসে এক মহান প্রেসিডেন্ট হিসাবে আপনি গণ্য হবেন, আমেরিকানরা পুনরায় তাদের সম্মান ফিরে পাবে আর বিশ্বব্যাপী আমেরিকান দূতাবাসগুলি তাদের নিরাপত্তায় তোলা উচ্চ কাঁটা তারের বেড়াগুলি নামিয়ে ফেলার অবকাশ পাবে’।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমামা, আমার বাদল মামা
পরবর্তী নিবন্ধওলীরা হচ্ছেন আল্লাহ প্রেরিত রাসুল (দ.) এর প্রতিনিধি