মায়ানমার সেনাবাহিনী তার জন্মলগ্ন থেকেই সে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ দমনে রত। এ বিদ্রোহের পিছনে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। সে প্রেক্ষাপটের আলোকে আরাকান তথা বর্তমানের রাখাইন স্টেটে মায়নমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মাঝে চলমান সংঘাত এবং সংঘর্ষের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্ব–যুদ্বের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত আরাকান তথা বর্তমান রাখাইন স্টেটে রোহিঙ্গা এবং রাখাইনদের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান ছিল। বৃটিশরা রোহিঙ্গাদের রাখাইন তথা অগ্রসরমান জাপনিজদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। বৃটিশরা জাপানিজদের আক্রমণে আরাকান থেকে নিজেদের পশ্চাদাপসরন ঘটালে জাপানিজ এবং রাখাইনদের হাতে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হন। সেই থেকে রাখাইন এবং রোহিঙ্গাদের মাঝে বৈরিতার শুরু। এই ঘটনার আগ পর্যন্ত সংঘর্ষ সংঘাত হয়েছে বার্মার তথা বার্মিজ এবং রাখাইন তথা মগদের মাঝে।
আরো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিষয় রাখাইন স্টেটে মায়নমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মাঝে চলমান সংঘাত এবং সংঘর্ষের পিছনে কাজ করে এসেছে। বিষয়টি হল শান স্টেটের পানলুঙ শহরে ১৯৪৬ সালের মার্চে জেনারেল অং সানের আহবানে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল বৃটিশদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হবে। স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতিসত্তা সমূহের স্বাধীনসত্তা যেমন শান, কাচিন, মন, চিন, আরাকান স্বীকার করে নেওয়া হবে অথবা জাতিসত্তা সমূহের সম্মতিতে সম্মিলিত অংশগ্রহণে একটি লুজ ফেডারেল পদ্ধতির সরকার গঠিত হবে।
১৯৪৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় পানলুঙ সম্মেলন। এ সম্মেলনে আরাকানের কোনো প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেনি। ১৩ জন শান, ৬ জন কাচিন প্রতিনিধি ৩ জন চিন এবং কারেনদের ৪ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। কারেন প্রতিনিধিরাপূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুলে পানলুঙ সমঝোতায় স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সভা ত্যাগ করেন।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্ব মুহূর্তে জেনারেল অং সান নিহত হন। এই সাথে পানলুঙ সমঝোতাও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে।
১৯৬১ সালের জুন মাসে শান স্টেটের রাজধানী থং জি’তে আরাকানিজদের আহবানে অন্য আরো ৮টি অ বামার জাতিসত্তার একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠক থেকে জাতিসত্তা সমূহ তাদের স্বাধীনতার দাবীতে উচ্চকণ্ঠ হন।
জেনারেল নে উইন তখন মায়ানমার সামরিক বাহিনী প্রধান এবং ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে। জেনারেল নে উইন এ দাবীর পিছনে মায়ানমারের বিলুপ্তির আশঙ্কা অনুধাবন করেন।
২ মার্চ ১৯৬২ জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যূথানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন।
এর পর থেকে মায়ানমারে একের পর এক জেনারেলের শাসন চলে আসছে। জেনারেল নে উইন এর পর জেনারেল শ মং, এর পর জেনারেল থা শোয়ে বর্তমানে জেনারেল মি অং।
মায়ানমারের রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের যুক্তি হল, মায়ানমারে জাতীয় পর্যায়ে কোন নেতা সৃষ্টি হয়নি, যিনি ১২৪ টি সংবিধান স্বীকৃত জাতিসত্তাকে নেতৃত্ব দেবেন। সামরিক বাহিনীই একমাত্র সক্ষম প্রতিষ্ঠান যারা জাতিকে নেতৃত্ব দিতে এবং ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে।
সামরিক বাহিনী এ বোধ এবং বিশ্বাস থেকে রাষ্ট্র শাসন করতে গিয়ে যে কাজটি যে ভুলটি দীর্ঘ দিন থেকে করে এসেছে তা হল দেশের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধহীনতা। নিয়ম অনুযায়ী সামরিক বাহিনী তার ঊর্র্ধ্বতন তথা কমান্ডের প্রতি দায়বদ্ধ। মায়ানমারে যুগের পর যুগ সামরিক বাহিনীর শাসনে সামরিক বাহিনী জনগণের নিকট দায়বদ্ধ তো নয়ই বরং জনগণই সামরিক বাহিনীর কাছে জবাবদিহিতার গ্যারাকলে। ফলশ্রুতিতে মায়ানমারের সাধারণ জন মানুষের মাঝে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে থাকে।
অন্যদিকে বিভিন্ন স্টেট বা ডিভিশনগুলি বা জাতিগোষ্ঠীর মাঝে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের অভিপ্সা সঞ্জাত মানসিকতা থেকে তাদের মাঝে সশস্ত্র সংঘাতে হাঁটার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। অধিকার অর্জনের অভিপ্সা সঞ্জাত আকাঙ্ক্ষার ফলশ্রুতি শান স্টেটে শান ন্যাশনাল আর্মি, কারেন স্টেটে কারেন ন্যাশনাল আর্মি, কাচিন স্টেটে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি, চিন স্টেটে চিন ন্যাশনাল আর্মি, রাখাইন সেটটে আরাকান আর্মি ইত্যাদি। এই সব বিদ্রোহী গোষ্ঠী মায়ানমার সামরিক বাহিনীর সাথে নিজেদের অধিকার আদায়ে অবিরাম এবং ক্রমাগত যুদ্ধরত। এরই ধারাবাহিকতা রাখাইনে আরাকান আর্মি।
আরাকানে রাখাইনরা সুদীর্ঘ কাল ধরে বার্মিজদের বিরুদ্ধে বৈরী মনোভাব পোষণ করে আসছে। এই বৈরীতা সময়ে সশস্ত্র সংঘাতেও রূপ নিয়েছে। চিন বাইনের বিদ্রোহ তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
আরাকান আর্মি। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে ২৬ জন আরাকানিজ তরুণের উদ্যোগে কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মির সহায়তায় কাচিন স্টেটের লাইজায় গঠিত হয়। বর্তমানে আরাকান আর্মি ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজর সদস্যের শক্তিশালী একটি বাহিনী। আরকান আর্মি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত জোট গঠন করে এ যাবৎ তাদের যুদ্ধ পরিচালনা করে যাচ্ছে। শুরুতে এ জোট নর্দান এ্যালায়েন্স হিসাবে পরিচিতি লাভ করলেও বর্তমানে তা ব্রাদারহুড হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এ জোটের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে তাং ন্যাশনাল আর্মি, কাচিন ইনডিপেন্ডেন্ট আর্মি।
বর্তমানে চিন স্টেটের প্লাটোয়াকে সামরিক সদর দপ্তর করে আরাকান আর্মি তাদের সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে।
২০২৪ এ মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য খুবই উল্লেখযোগ্য এবং দৃশ্যমান। আরাকান আর্মি এরই মাঝে মিনবু, ম্রাউ, পকতো, বুথিডং, মংডো ইত্যাদির মত উল্লেখযোগ্য অঞ্চলের বাইরেও সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ্যানস্থ পশ্চিমাঞ্চলীয় সেনা সদর দপ্তর ‘ওয়ের্স্টান কমান্ড হেডকোয়ার্টার’ ও দখলে নিয়েছে।
এই অবস্থায় দৃশ্যত আরাকান অঞ্চলে মায়ানমার সামরিক বাহিনী এক ধরনের নাজুক এবং বির্পযয়কর অবস্থায় নিপতিত।
এখন দেখার বিষয় এমন কঠিন পরিস্থিতিতে মায়ানমার সামরিক বাহিনীর জন্য আরাকান আর্মি’র বিরুদ্ধে নেওয়ার মত কী কী পথ খোলা আছে এবং সেসব তারা কীভাবে গ্রহণ করবে।
অতীতে দেখা গেছে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি ‘মানারপ্লাউ’ কে সদর দপ্তর করে কাচিন স্টেট কে প্রায় স্বাধীন করে ফেলেছিল। এ অবস্থায় মায়ানমার সামরিক বাহিনী তাদের সামরিক কূটকৌশলের মাধ্যমে মানারপ্লাই এ কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মিকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে। ‘চিনদুইন’ নদী কাচিনদের রক্তে সেসময় বহুদিন রঞ্জিত ছিল। শান’দের বিরুদ্ধেও মায়ানমার সামরিক বাহিনী বার বার তাদের প্রভাব ধরে রাখতে পেরেছে।
অতি সম্প্রতিও ‘পি ডি এফ’ বা ন্যাশনাল ইউনিটি গর্ভমেন্টে’র সৈন্যরা গুরুত্বপূর্ণ সাগাইং ডিভিশন প্রায় দখলে নিয়ে ফেলেছিল। মায়ানমার সেনাবাহিনী তাদের পাল্টা আক্রমণে ‘পি ডি এফ’ কে সাগাইং থেকে বিতাড়িত করেছে।
এখন আরাকানে যুদ্ধরত পক্ষগুলো কার বিরুদ্ধে কে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি আরাকান আর্মি বাংলাদেশ–মায়ানমার সীমান্তের প্রায় পুরাটাই তাদের দখলে বা প্রভাবে নিতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সমস্যার পাশাপাশি বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্তে সমস্যার মাত্রা বহু মাত্রিকতায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বহু মাত্রিকতার এ দৃশ্যপটে বাংলাদেশের জন্য নতুন নতুন আরো বেশ কিছু কঠিন সমস্যা সামনে আসবে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। যুদ্ধমান পক্ষগুলির সশস্ত্র সদস্যদের বাংলাদেশে আশ্রয়ের প্রচেষ্টা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর বিনিময়ে বাংলাদেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে অস্ত্র সরবরাহের প্রলোভন। কারণ জাতিসংঘ ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে ‘আরাকান দুর্ভিক্ষ পীড়িত একটি অঞ্চলে পরিণত হতে যাচ্ছে’ এর কারণ হিসাবে জাতিসংঘের অভিমত সেখানে উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যবস্থা দুটিই ভেঙে পড়েছে। (চলবে)
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।