খ্রিষ্টের জন্মের বহু শতাব্দী আগে মিশরীয় তারপর রোমান অতঃপর মোঙ্গল, মোঙ্গলদের থেকে অটোম্যান বৃটিশ, ফ্রান্স এবং সবশেষে ১৯৪৬ সালে সিরিয়া ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সিরিয়ার এই স্বাধীনতা কখনো নির্বিঘ্ন ছিল না। কখনো তুর্কি হুমকি, কখনো ইসরাইল দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি লেগেই ছিল। এ অবস্থা থেকে অনেকটা নিষ্কৃতির লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালে সিরিয়া মিশরের সাথে আরব রিপাবলিক গঠন করে। এ জোট গঠনও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৬১ সালে মিশর সিরিয়া রিপাবলিকের অবসান ঘটে। ১৯৭০ সালে হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতা গ্রহণ করলে সিরিয়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করে। ২০০০ সালে হাফেজ আল আসাদ মৃত্যুবরণ করলে তার সন্তান বাসার আল আসাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বাসার আল আসাদকে তার দীর্ঘ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সময়ে সময়ে কঠোর এবং কখনো নৃশংসতার আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়।
সম্প্রতি বিদ্রোহীদের হাতে সিরিয় প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের পতন হয়েছে। বাসার আল আসাদ রাশিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। উল্লেখ্য নানা চড়াই উৎরাই পাড় করে বাসার আল আসাদ আর তার পিতা হাফেজ আল আসাদ দুজন মিলে দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময় সিরিয়া শাসন করেছেন। তবে পিতা পুত্র উভয়কেই ভূ–রাজনীতির নানা ধকল সইতে হয়েছে। শিয়া, সুন্নি, কুর্দি আবার সুন্নিদের মাঝে দল উপদল ইত্যাদিকেও আসাদ পরিবারকে কঠোর হাতে দমন করতে হয়েছে।
১৭ ডিসেম্বর ২০১০ সালে তিউনিসিয়াকে কেন্দ্রস্থল করে শুরু হয় আরব বসন্ত। আরব বসন্ত শুরু হয় চমকপ্রদ আবার বেদনাদায়ক এক ঘটনার মাধ্যমে। ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ রাস্তার পাশে বসে ফল বিক্রি করছিল মোহাম্মদ বুউয়াজিঝি। পুলিশ তার কাছে ঘুষ চায় রাস্তায় বসে ফল বিক্রির অনুমতি দিতে। মোহাম্মদ বুউয়াজিঝি ঘুষ দিতে অস্বীকার করলে পুলিশ তাকে হেনস্থা করে, এতে ক্রোধে অপমানে বুউয়াজিঝি নিজের গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগায়। মোহাম্মদ বুউয়াজিঝি সে আগুনে মারা যান। এ ঘটনার প্রতিবাদের ঝড় উঠে আরব জগৎএ। এ ঝড়ের নাম আরব বসন্ত। আরব বসন্তের সেই ঝড়ে একে একে টালমাটাল হয়ে পড়তে থাকে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন রাষ্ট্র কাঠামো। তিউনিসিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, মরক্কো, আলজেরিয়া, জর্ডান, কুয়েত, মিসর, বাহরাইন, ওমান, ইরাক, সৌদি আরব, বাহরাইন, লেবানন ইত্যাদি আরব বসন্ত আন্দোলনে তছনছ হতে থাকে। সারা আরব বিশ্ব জুড়ে তখন শ্লোগান ‘আস সাহাব ইউরিদ ইসকাত আন নিজাম’ দি পিপল ওয়ান্ট টু ব্রিং ডাউন দি রিজিম। সোজা বাংলায় এ শ্লোগানের অর্থ হল জনগণ ক্ষমতাসীনদের পরির্বতন চায়।
এই চাওয়ার মাঝে ১৪ জানুয়ারী ২০১১ তিউনিসিয়ান জুয়নুল আবেদিন বেন আলী দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যান। ২৫ জানুয়ারী ২০১১ আরব বসন্ত মিসরে প্রবল বেগে আছড়ে পড়ে। ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১১ সে ঝড়ের কবলে মিসরীয় হোসনী মোবারক বিধ্বস্ত হন, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১১ লিবিয়ার মোয়াম্মার গাদ্দাফী আরব বসন্ত ঝড়ে কাবু হয়ে পড়েন এভাবে ইয়েমেনের আবদুল্লাহ সালেহও বিদায় নেন। ব্যতিক্রম হিসাবে টিকে থাকেন সিরিয়ার বাসার আল আসাদ। ব্যতিক্রম বলছি এই কারণে যারা পশ্চিম থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র ভূমিকায় থাকতে চেয়েছিলেন তারা মোটামুটি সবাই নাই হয়ে যান আসাদ ছাড়া। পশ্চিম মুখি যারা যেমন সৌদি আরব, ওমান, বাহরাইন, কুয়েত, জর্ডান এরা নির্বিঘ্ন টিকে যান।
সেই ২০১১ থেকে আসাদ রাশিয়ার সহায়তায় দিন দিন নিজের ক্ষমতা সংহত করেন। সময়ে সময়ে যখনই কখনো আসাদের উপর বিপদ ঘনিয়ে এসেছে রাশিয়া পাশে দাঁড়িয়েছে সাথে ইরান হিজবুল্লাহ’র মাধ্যমে।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ, হামাসের ইসরাইল আক্রমণ, প্রত্যুত্তরে ইসরাইলীদের গাজার উপর ক্রমাগত ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা, হিজবুল্লাহ’র হামাসের পাশে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় লেবাননের হিজবুল্লাহ অবস্থানের উপর ইসরাইলী ব্যাপক বোমা হামলা ইত্যাদি সিরিয়ার সার্বিক অবস্থানে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ফলশ্রুতিতে আসাদ সিরিয়ায় ভিতর থেকে যেমন তেমনি বাইরে থেকেও সমর্থনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে।
ইউক্রেন যুদ্ধ সামাল দিতে গিয়ে সামরিক এবং কূটনৈতিক দুদিক থেকেই সিরিয়ার চেয়েও স্বীয় অবস্থান সংহতকরণে রাশিয়া অধিক মনোযোগী থাকে। ইরান তার প্রক্সিদের মাধ্যমে ইসরাইলের উপর আঘাত হানতে নিবিষ্ট থাকে। এমন পরিস্থিতিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ভিতরে ভিতরে আসাদ বিরোধী সুন্নি বিদ্রোহীদের মদদ দিয়ে আসাদের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণে উৎসাহিত করে। এরদোয়ানের এ সিদ্ধান্তের পিছনে কাজ করেছে দীর্ঘদিন থেকে সিরিয়া তুরস্ক সীমান্তে ‘কুর্দিস্থান’ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে লিপ্ত আবদুল্লাহ ওরসালানের দল কুর্দিস্থান ওর্য়াকাস পার্টিকে সিরিয়ার মদদ এবং আশ্রয়দানের প্রতিশোধ।
এরদোয়ানের প্রতিশোধের হাতিয়ার ‘হায়াত তাহরির আল সামস’ এর যোদ্ধারা বিদ্যুৎ গতিতে একের পর এক আলেপ্পো, হোমস, লাতাকিয়া এবং পরিশেষে দামাস্কাস তাদের দখলে নিয়ে নেয়। আসাদ ৮ ডিসেম্বর দেশ ছাড়েন রাশিয়ার উদ্দেশ্যে।
সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর আরব বিশ্ব তথা সমস্ত বিশ্বে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে নিঃসন্দেহে। এসব প্রভাবের মধ্যে যে সমস্ত বিষয়গুলি ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হবে বলে প্রতীয়মান তার মাঝে উল্লেখযোগ্য প্রথমত সিরিয়ার নানা প্রভাবাধীন অঞ্চলে বিভক্তি। দৃশ্যমান চারটি অঞ্চলে সিরিয়া বিভক্ত হয়ে পড়তে যাচ্ছে। এর মাঝে তুরস্ক প্রভাবাধীন এ অঞ্চলটি হবে মধ্যসিরিয়া থেকে তুরস্কের উত্তর সীমান্ত এবং জর্ডানের দক্ষিণ সীমান্ত বরাবর, মার্কিন প্রভাবাধীন অঞ্চলটি হবে কুর্দি প্রভাবিত উত্তর পূর্ব সিরিয়া, রাশিয়া প্রভাবাধীন অঞ্চল এবং সিরিয় আলওয়াইট গোষ্ঠী প্রভাবিত অঞ্চল। এ অঞ্চলটি হবে সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় কোস্টাল এরিয়া নিয়ে গঠিত, এ গোষ্ঠীর সাথে ক্ষমতাচ্যুত আসাদের পারিবারিক, ইরান তথা হিজবুল্লাহ এবং ইরাকের সাথে রয়েছে নিবিড় এবং জোরালো সম্পর্ক।
রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য প্রভাব ক্ষুণ্ন হতে দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আসাদের ক্ষমতাচ্যুতির মধ্যে প্রাচ্যে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতির একধরনের বিপর্যয় বললেও অত্যুক্তি হবে না।
ইরান সিরিয়া পরিস্থিতি এবং আসাদের ক্ষমতাচ্যুতির সবচেয়ে বড় শিকার। কৌশলগতভাবে হিজবুল্লাহ হামাসের যে সরবরাহ ব্যবস্থা আসাদের মাধ্যমে সহজতর ছিল তা এখন বিপর্যস্ত। ইরান তার প্রক্সি হিজবুল্লাহ – হামাসের ব্যাপারে ভূ– কৌশলগত এক ধরনের বেকায়দায় থাকবে। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইরানের পূর্বের প্রভাব কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হতে দেখা যাবে।
সিরিয়া পরিস্থিতি লেবানন, ইরাক, জর্ডানসহ সন্নিহিত আরব দেশগুলির উপর প্রভাব বিস্তার করবে। সিরিয়ায় আসাদের পতনে ভূ–কৌশলগতভাবে সবচেয়ে লাভবান ইসরাইল। সিরিয়ার মাধ্যমে হিজবুল্লাহ – হামাসের ইরান থেকে সরবরাহ যেমন প্রতিকূল অবস্থায় পড়েছে তেমনি ইসরাইলকে মোকাবেলা করার ‘এক্সিস অব রেসিসটেন্স’ এও এটি বড় একটি আঘাত। ইসরাইল তড়িৎ গতিতে সিরিয় পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করতে মুহূর্তমাত্র দেরী করেনি। সিরিয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনায় ইসরাইল বিমান এবং মিসাইল আক্রমণ পরিচালনা করেছে। এ আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য সিরিয়াকে সামরিকভাবে পঙ্গু করা, ভবিষ্যৎ এ সিরিয়া যেন কোনো অবস্থাতেই ইসরাইলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে না পারে। এর বাইরে ইসরাইল সিরিয় গোলান হাইট দখলে নিয়ে তাকে ‘বাফার জোন’ হিসাবে গড়ে তোলায় মত্ত। প্রতিবেশী দেশগুলির উপর ক্রমাগত আক্রমণের মাধ্যমে ইসরাইল তার ‘দুর্বল প্রতিবেশী’ নীতি ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। লেবানন, সিরিয়া, এবং ইরাকের মত সার্বভৌম দেশগুলির উপর একের পর এক আক্রমণ বিশ্ব সম্প্রদায় নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে কেবল অবলোকন করেই যাচ্ছে। ইসরালের বেপরোয়া এ আচরণের পিছনে নিঃসন্দেহে আমেরিকা।
আমেরিকার এ ভূমিকার পিছনে স্বার্থ স্পষ্ট। ইসরাইল মধ্যেপ্রাচ্যে যত শক্তিশালী হবে ইসরাইলের মাধ্যমে মধ্যেপ্রাচ্যে আমেরিকা তার প্রভাব বিস্তার করবে। মধ্যেপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক আর স্বৈর শাসিত দেশগুলিতে অস্ত্র বিক্রির প্রসার ঘটানো সহজ হবে, তেল সরবরাহে অবারিত এবং একছত্র প্রভাব বিস্তার নির্বিঘ্ন হবে।
বাসার আল আসাদের ক্ষমতা হারনোতে ভূ রাজনীতি এবং ভূ–অর্থনীতিতে বর্তমান প্রেক্ষাপট কোন কোন দেশ সবচেয়ে লাভবান এবং কোন কোন দেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্লেষণ করলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, সব চেয়ে লাভবান দেশ হল ইসরাইল, আমেরিকা এবং তুরস্ক। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হল ইরান, রাশিয়া এবং ফিলিস্তিন।
সবশেষে আসাদ পরবর্তী সিরিয় ভূ–রাজনীতি নিয়ে এখনো শেষ মন্তব্য করার সময় হয়নি। তুর্কিদের উত্তর সিরিয়ায় কুর্দি অঞ্চলে কুর্দিদের বিরুদ্ধে আসন্ন অভিযান, তুরস্কের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কুর্দিদের প্রতি মার্কিন সহায়তার মাত্রা এবং ক্ষমতাসীন সুন্নি যোদ্ধাদের ইসরাইলের প্রতি গৃহীত মনোভাব থেকে সিরিয় ভূ–রাজনীতির গতি প্রকৃতি নির্ভর করবে।
রাশিয়া এবং ইরানও সিরিয়ার ঘটনা প্রবাহে নির্লিপ্ত থাকবে সে আশা করাও বোকামি হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।