সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১০ নভেম্বর, ২০২৪ at ৪:৪৬ পূর্বাহ্ণ

ফিলিস্তিনের এক অসীম সাহসী যোদ্ধার কাব্যিক আহ্বান

বেশ সময় নিয়ে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের প্রদেশসমূহ এবং ভারত – বাংলাদেশ চলমান সম্পর্ক নিয়ে লেখাটি লিখছিলাম। এর মাঝে এমন এমন ঘটনা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে ঘটে যাচ্ছে যেগুলি পাঠকদের সামনে তুলে না ধরতে পারা পাঠকদের কাছে এক ধরনের দায়বদ্ধতার ভারে আক্রান্ত থাকার মত। এ তাড়না থেকেই ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চল নিয়ে লেখাটির সাময়িক বিরতি টেনে এ লেখাটি লিখছি। সমস্ত পৃথিবীকে অনেকটা তাচ্ছিল্যের অতলে ঠেলে ফেলে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে গাজা’য় যেমন ইসরাইল নির্বিচারে মানুষ হত্যায় মত্ত তেমনি লেবাননেও চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ।

প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক অরুন্ধতী রায়ের কথায় ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি নির্মমভাবে ফুঠে উঠেছে এভাবে It grew up like a protected child in a wealthy home whose parents smile proudly as it commits atrocity upon atrocity. অর্থাৎ ইসরাইল আমেরিকার বিষয়টি এমনই যেন ধনাঢ্য পরিবারের বিচার আচারের ঊর্ধ্বে বেড়ে উঠা এক সন্তান সে যত নিষ্ঠুরতা যত নির্মমতা আর অত্যাচারই চালাক না কেন তার বাবা মা তাতে খুশীতে কেবল হাততালিই দিয়ে যাচ্ছে।

ফিলিস্তিনকে নিয়ে ইতিপূর্বেও আমি বেশ কিছু লেখা লিখেছি, পত্র পত্রিকায় তা প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকদের এ নিয়ে বেদনার্ত অনুভূতি প্রকাশ আমাকে আরো বেশী বেদনায় নিমজ্জিত করেছে। নিমজ্জনের এ ঘোর না কাটতেই ফিলিস্তিন প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম সাহসী যোদ্ধা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যু সংবাদ অন্য অনেকের মত আমাকেও বেদনায় নীলকন্ঠ করেছে। পরবর্তীতে ঝরহধিৎ’ং চড়বঃরপ ডরষষ নামে ইয়াহিয়া সিনওয়ার’এর ফিলিস্তিনিদের প্রতি কখনো হার না মানার এক কাব্যিক আহবান যা আমি প্রথম আরবীতে বুঝে উঠতে পারিনি পরে এর ইংরেজি অনুবাদ শুনে আমি অনেকটা অভিভূত এবং বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। একজন মানুষের তার মাতৃভূমি,স্বীয় জাতিসত্তার স্বাধীনতা অর্জনে দায়বদ্ধতা এবং সেই দায়বদ্ধতা থেকে উৎসারিত সংকল্প জীবন বিলিয়ে দিতেও কতটা অকুন্ঠিত করতে পারে সিনওয়ার’এর জীবন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে। ইয়াহিয়া সিনওয়ার’এর কাব্যিক এই আহবান আমি নিশ্চিত ফিলিস্তিন’এর বর্তমান নয় অনাগত প্রজন্মকেও স্বাধীনতা অর্জনে প্রতিবাদী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করবে। ইয়াহিয়া সিনওয়ার’এর এই আহবান ছিল হামাসের প্রধান হিসাবে। এই কারণে দু এক লাইনে হামাস’এর পরিচয় তুলে ধরে ইয়াহিয়া সিনওয়ার এর কাব্যিক আহবানটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।

ইহুদিবাদী ইসরাইলের ফিলিস্তিনীদের প্রতি ক্রমাগত অত্যাচার নিপীড়নের প্রতিবাদে শেখ আহাম্মদ ইয়াসিন ১৯৮৭ সালে হামাস গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। ইসরাইলীরা শেখ আহাম্মদ ইয়াসিনকে হত্যা করলে তার উত্তরসূরি হিসাবে আবদুল আজিজ রানতাসি হামাস’এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উত্তাধিকারের এই ধারায় পরবর্তীতে ইসমাইল হানিয়া এবং ইয়াহিয়া সিনওয়ারদের হামাসের নেতৃত্বে আসীন হওয়া এবং জীবন বিলিয়ে দেওয়া।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার’এর কাব্যিক সেই আহ্বান।

আমি ইয়াহিয়া, স্বদেশভূমি থেকে বিতাড়িত

আশ্রয় শিবিরের এক শরণার্থী

যার স্বপ্নের জীবন এক অশেষ যুদ্ধে

রুপ নেয়, তার সন্তান।

এই শব্দাবলী যখন আমি রচনা করছি

তখন আমার শৈশব জীবনের প্রত্যাশা থেকে

সুর্দীঘ জেল জীবন সব কিছুই সামনে

এমনকি এ মাটিতে ঝরে পড়া

প্রতি ফোটা রক্ত আমার চোখে ভাসছে ।

১৯৬২ সালে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে

আমার জন্ম, যখন ফিলিস্তিন হত বিধ্বস্ত

এক স্মৃতি, রাজনীতিকদের টেবিলের

মানচিত্রে ফিলিস্তিন তখন অপসৃয়মান প্রায় ।

আমার জীবন আগুন আর ভস্মের মাঝে

গড়ে ওঠা। জীবনের পথ চলার শুরুতেই

আমি অনুধাবন করি দখলদারিত্ব এক স্থায়ী কারাগার

ছাড়া কিছুই নয়।

জীবনের শুরুরতেই আমি বুঝেছি

এখানের জীবন কোন সাদামাটা যাপনের জন্য নয়

মুক্তির কাঙ্ক্ষিত জীবন সুদীর্ঘ সংগ্রামের

একথা আত্মস্থ করে প্রত্যেক জীবন এখানে

হতে হবে অবিচল এক সংকল্পের।

দখলদারদের প্রতি যে শিশুটি একদিন প্রথম পাথর

ছুড়ে মেরেছিল সেই আমি আপনাদের

আহবান জানাচ্ছি, আমি জানতাম

ঐ পাথরই নীরবে আমাদের রক্তক্ষরণ দেখা

পৃথিবীর প্রতি আমাদের প্রতিবাদের উচ্চারিত শব্দ।

আমি গাজার রাস্তায় চলতে চলতে শিখেছি

একজন মানুষকে পরিমাপ করা হয়

তার দীর্ঘ যাপিত জীবন দিয়ে নয়,

বরং মাতৃভূমির প্রতি তার অবদান দিয়ে

আমার জীবন ছিল কারাগারের,

সংগ্রাম আর যুদ্ধের, বেদনার আর আশার।

১৯৮৮ সালে আমি প্রথম কারাগারে নিক্ষিপ্ত হই

এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত হই। আমি কারান্তরালে কখনো

ভয়ে ভীত হইনি। ঐ অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠের প্রতিটি

দেওয়ালে একেকটি জানালা ভেসে উঠেছে আমার চোখে,

ঐ জানালা দিয়ে আমি দূরে দিগন্ত

দেখেছি, কারাপ্রকোষ্ঠের কপাটের প্রতিটি

রড আমার চোখে মুক্তির আলো ছড়িয়েছে,

আমাকে স্বাধীনতার পথ দেখিয়েছে।

কারাগারেই আমি উপলব্ধি করেছি

ধৈর্য শুধু একটি গুণই নয় একটি অস্ত্রও

এ যেন বিন্দু বিন্দু জল শুষে নিয়ে

সিন্ধুকে আত্মস্থ করা। আপনাদের প্রতি আমার

আহবান কারাগারের বন্দীত্বকে ভয় পাবেন না

এটি আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ যাত্রা পথের

একটি সোপান মাত্র।

২০১১ সালে বন্দী বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে

ওয়াফা আল আহরাব কারগার থেকে আমি

যখন মুক্তি পাই, তখন আমি আগের সেই

আমি ছিলাম না। আমি আরো দৃঢ়চেতা,

অবিচল বিশ্বাসের ধারক তখন

যার বিশ্বাস জন্মে আমরা আমাদের

ঈপ্সিত স্বাধীনতা অর্জনে শেষ

রক্তবিন্দু ঢেলে দিতেও কুন্ঠিত হব না।

আপনাদের প্রতি আমার আহবান

নিজের সম্মান আর গৌরবের প্রতি

অবিচল থাকবেন।

নিজের স্বপ্নকে কখনো মরে যেতে

দেবেন না।

শত্রু চেষ্টা করবে আমরা যেন

আমাদের প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে

সরে আসি, আমরা যেন সুদীর্ঘ

এক আলোচনার ছলনায় মত্ত হই।

আমার আহবান যা আপনার

নায্য অধিকার কখনো তাতে

আলোচনায় আপোষ করতে যাবেন না।

শত্রু আপনার সংকল্পবদ্ধতাকে

অস্ত্রের চেয়েও বেশী ভয় করে

প্রতিরোধ শুধুমাত্র একটি অস্ত্রই নয়,

এটি আমাদের প্রতিমুহূর্তের

শ্বাস প্রশ্বাসের মত, ফিলিস্তিনের

প্রতি ভালোবাসারই অংশ।

প্রতিরোধ আগ্রাসন আর দখলদারিত্বের

বিরুদ্ধে আমাদের সংকল্প উৎসারিত

প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা।

আমার আহবান শহীদদের রক্তের

প্রতি আপনারা দায়বদ্ধ থাকবেন,

তারা রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার

পথ রচনা করেছেন।

রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ

আর কূটনীতির কূটচালে তাদের আত্মত্যাগ

বৃথা যেতে দেবেন না।

আপনাদের প্রতি আমার আহবান

সেইসব শহীদদের রক্তের

প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন যারা

তাদের রক্তের বিনিময়ে এক

কণ্টকাকীর্ণ পথে চলতে চলতে

আমাদের স্বাধীনতার পথ রচনা করেছেন।

তাদের আত্মত্যাগ রাজনীতি আর

কূটনীতির কূটচালে ব্যর্থ হতে দেবেন না।

(চলবে)

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের প্রথম নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যান ফজল করিম স্মরণে