ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের প্রদেশসমূহ :
ভারত – বাংলাদেশ চলমান সম্পর্ক – ৬
আসাম: উলফা’র স্বাধীনতার স্বপ্ন সদূরে মিলালেও কারাগারের বাইরে থাকা নেতাদের সদূরের সেই স্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়ায়। এরই ফলশ্রুতি চট্টগ্রামে সংঘটিত ‘দশ ট্রাক অস্ত্র’ কাণ্ড। এ অস্ত্র উলফা’র সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তার দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন “এ অস্ত্র উলফা’র জন্য আনা হয়েছিল”। এটাও আরো স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানের সাথে উলফা’র সামরিক প্রধান পরেশ বড়ুয়ার উপস্থিতি। ১ এপ্রিল ২০০৪ সালে সি ইউ এফ এল ঘাটে নামানোর সময় দশ ট্রাক অস্ত্রের এ চালান পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এ অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ার তথ্য প্রমাণ বেরিয়ে আসতে থাকে। উলফা’র সামরিক প্রধান পরেশ বড়ুয়ার ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
এ ঘটনা স্পষ্ট প্রমাণ করে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা সমূহের কোনো না কোনো একটি পক্ষ ‘ডাবল এজেন্ট’ এর কাজ করেছে। যার ফলশ্রুতি অস্ত্রের চালান ধরা পড়া। এটি ছিল উলফা’র জন্য মারাত্মক এক বিপর্যয়। গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডের ইতিহাসে দ্বিচারিতার নিকৃষ্টতম এক উদাহরণ। একই সাথে স্বাধীন সার্বভৌম দুটি দেশের পারস্পরিক সর্ম্পকে টানাপোড়েন সৃষ্টির অকল্পনীয় এক দৃশ্যপট।
পরবর্তীতে এ অস্ত্র মামলায় আদালত কর্তৃক পরেশ বড়ুয়া সহ ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়।
আওয়ামী লীগ এবং বি এন পি বাংলাদেশের দুটি সরকারই একদিকে আশ্রয় নেওয়া উলফা নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর এবং অন্যদিকে অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে উলফা’র পিঠে চূড়ান্তভাবে ছুরিকাঘাত করে। সেই রক্তক্ষরণে উলফা ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আর এভাবেই ১৯৭৯ সালে উলফা’র শুরু করা স্বাধীনতার আন্দোলন ২০১৫ সালে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে এক শান্তি সমঝোতার আড়ালে আসামের মাটিতে কবরস্থ হয়।
উলফা’র প্রভাব তিরোহিত হতেই আসাম জুড়ে সাম্প্রদায়িকতার একই সাথে বিদেশী বাঙালি তথা বাঙালি মুসলমানদের আসাম থেকে উৎখাতের এক নির্মম উন্মাদনার সৃষ্টি করা হয়। এটি এই একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ভারতের মত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এক কলঙ্কময় ইতিহাসের সৃষ্টি করেছে।
ভারতীয় রাজনীতির গণতান্ত্রিক এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে শ্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা র্পাটি (বি জে পি) র্স্ব ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিষবাষ্প ছড়াতে থাকে। এরই ফলশ্রুতি ২০১৬ সালে আসামে বি জে পি’র সরকার গঠন।
Democracy makes the power of the state especially dangerous. Since its rulers can claim that their policy is derived from the will of the people, and therefore in the general interest’
জে এফ ফিগসের এই উদ্ধৃতির মর্মার্থ হলো, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে দুর্বিনীত করে তুলতে পারে। এই ব্যবস্থায় শাসকেরা ধরে নেয়, তাদের ক্ষমতা জনগণের রায় উৎসারিত এবং তারা যা করছে, তা জনগণের মঙ্গলার্থে। ভারতের আসাম রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে ফিগসের বক্তব্যকে আমার প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মান হয়।
পৃথিবীতে মানুষ যুগে যুগে স্থানচ্যুত হয়েছে বা স্থান ত্যাগ করেছে। এটা ঘটেছে যখন কোনো প্রবল প্রতিপক্ষ দ্বারা সে আক্রান্ত হয়ে বাধ্য হয়েছে তার জায়গাজমি স্থায়ী আবাস ছেড়ে যেতে, তখন তার স্থানচ্যুতি ঘটেছে। আবার মানুষ প্রতিকূল অবস্থায় বসবাস করতে করতে কোনো সময় তার সামনে যখন সুযোগ আসে, তখন সে জীবিকার তাড়নায় নতুন বসতির আশায় অনিশ্চিতের পথে পা বাড়ায়। এখানে প্রথমটি অনিচ্ছায় আর দ্বিতীয়টি স্বেচ্ছায়। তবে উভয় ক্ষেত্রেই মানুষকে নতুন পরিবেশ–পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অশেষ দুর্ভোগ–দুর্যোগ পোহাতে হয়।
আসামে যেসব মানুষ ১৮ শতকের শেষার্ধে এবং ১৯ শতকের প্রথমার্ধে নতুন বসতি আর জীবিকার আশায় ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাড়ি জমান, তারাও প্রকৃতির শত প্রতিকূলতার মধ্যে সেখানে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে। একদিকে বৈরী পরিবেশ, বিশেষ করে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, অন্যদিকে বার্মিজদের অত্যাচার–নিপীড়নে আসাম তখন অনেকটা জনশূন্য বিরান অঞ্চল।
In Assam over four fifth of the cultivable waste lands remained untouched by plough at the close of the last century. The local authority encouraged immigrants into both the Brahmaputra and the Surma vallys. They invited people from outside Assam and offered rent free Waste land for a turn of years. গত শতকের শেষাশেষিতেও আসামের পাঁচ ভাগের চার ভাগ জমি ছিল অনাবাদি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ব্রহ্মপুত্র ও সুরমা উপত্যকার মানুষদের আসামে পুনর্বাসনে প্রণোদিত করে। তারা আসামের বাইরে থেকেও মানুষদের বর্গাবিহীনভাবে কয়েক বছর অনাবাদি জমি চাষের জন্য প্রলুব্ধ করে আসামে নিয়ে এসে বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করে।
বর্তমানে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) ক্ষমতাসীন। ভারত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র। ভারতে বহু জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। নানা বর্ণ, ধর্ম, জাতিগোষ্ঠীর বহুধা ধারার মাঝে ভারতের শক্তি নিহিত।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি’র বিদায়ী ভাষণের মূল সুরও ছিল এটিই। বহু বর্ণ আর গোত্রের মাঝে এযাবৎকাল ভারত তার শক্তির আধার খুঁজে পেয়েছে। অনেক তারের সমাহার হলেও সেতার যেমন সম্মিলিত ব্যঞ্জনায় এক মোহন সুর সৃষ্টি করে, তেমনি ভারতও তার নানা জাতি গোষ্ঠী বর্ণ ধর্ম গোত্রের সমাহারে তার জাতীয় চরিত্রে এক এবং অভিন্ন ধারায় গ্রন্থিত হয়ে আপন শক্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে এসেছে। সময়ে সময়ে এর ব্যতিক্রম ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহ ও কাশ্মীর। ভারতের বিগত সরকারসমূহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে এসব অঞ্চলের সমস্যাসমূহ ভালোই সামাল দিয়েছে।
কিন্ত্তু ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তি বিশেষ করে ভারতীয় জনতা পার্টি (বি জে পি) ক্ষমতায় আসার পর ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দীর্ঘ দিনের সহাবস্থানের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়। সম্প্রতি (১৫ এপ্রিল ২০২১) রাহুল গান্ধীর পশ্চিম বঙ্গের বিধান সভা নির্বাচনী প্রচারে দেওয়া বক্তব্যে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন “আগে বিদেশী অতিথিরা এসে আমাকে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ভারতে নানা ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নানা রাজ্য কিন্ত্তু সমগ্র ভারত একই লক্ষ্যে।
বিজেপি ক্ষমতায় আসার নিমিত্তে ভারতে সাম্প্রদায়িক নীতিকৌশল গ্রহণ করে। এ কৌশলের ফলে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান। বিজেপি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে অতীতে যেমন বাবরি মসজিদ ইস্যু সৃষ্টি করে ক্ষমতায় আসার সোপান সৃষ্টি করে, তেমনি ক্ষমতারোহণ করে তা পাকাপোক্ত করার জন্য সাম্প্রদায়িকতার চরম বর্ম ধারণ করে। ইউটিউবের বদৌলতে দেখা ৫ জুন ২০১১ লন্ডনে এক প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠানে একজন ভারতীয় প্রশ্নকর্তা অরুন্ধতী রায়কে প্রশ্ন করতে গিয়ে বলেন, আপনি বরাবরই ভারতের কঠোর সমালোচনা করেন। ভারতে বাক্স্বাধীনতা আছে বলেই আপনি আপনার মতামত অবলীলায় প্রকাশ করতে পারছেন। অথচ আপনি যদি চীনে জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে আপনি এ সুযোগ পেতেন না। জানি না, কিসের থেকে আপনার এই ভারতবিদ্বেষী মনোভাব গড়ে উঠেছে। ভারতকে আপনি হিন্দু ইজমের জন্য সমালোচনা করেন। অথচ দেখুন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী একজন শিখ (ড. মনমোহন সিং), ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির সভানেত্রী একজন খ্রিষ্টান (সোনিয়া গান্ধী), খ্রিষ্টান মিশনারিরা অঢেল অর্থ ব্যয় করে ভারতে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করছেন। মনে রাখবেন, ভারতের অখণ্ডতা সর্বাগ্রে। এ প্রসঙ্গে আপনাকে অনুরোধ করব, আপনার পছন্দ বা যা আপনাকে মুগ্ধ করেছে, ভারতের এ রকম তিনটি বিষয় উল্লেখ করুন। এটি করলে আপনার শ্রোতা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
উত্তরে অরূন্ধতী বলেন, ‘ভারতে রয়েছে পৃথিবীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশ। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী আমাকে মুগ্ধ করেছে তাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতায়। এই দরিদ্র মানুষেরা তাদের জীবন দিয়ে শক্তিশালী করপোরেট শক্তির মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে, যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই দরিদ্র মানুষেরা পৃথিবীকে সভ্যতার অর্থকে পুনর্মূল্যায়নে প্রভাবিত করছে (Redifine Civilization ) সুখের প্রকৃত অর্থ কী তা অনুধাবন করতে, (Redifine Happiness ) আধুনিকতার মর্মার্থ কী, তা উপলব্ধি করতে–এসব আমাকে মুগ্ধ করেছে (Redifine Modernism )’। অরুন্ধতী এ পর্যায়ে প্রশ্নকর্তার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি বলেছেন, আমি চীনে জন্মগ্রহণ করলে এই বাক্স্বাধীনতা পেতাম না। এটা সত্যি। আর এটাও সত্যি, আমি এখানে মানুষের দুর্দশার প্রতিযোগিতার কথা বলতে আসিনি। আমি ভারতের বাক্স্বাধীনতার কথা বলছি’। (চলবে)
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।