ড. ফিজোর নেতৃত্বে নাগাদের সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রায় দশ বছর পর আসামের লুসাই হিলের মিজোরা বিদ্রোহের মশাল জ্বলে। প্রকৃতির সন্তান মিজোদের প্রকৃতিই যেন মাথা তুলে তাদের অধিকার আদায়ে ঠেলে দেয়। এ ঘটনা গল্পের মত হলেও সত্য।
গধঁঃধস (মাউতাম) – প্রকৃতির এক বিচিত্র খেয়ালের নাম। পাহাড় বেষ্টিত মিজোরামের দুই তৃতীয়াংশজুড়ে আছে বাঁশঝাড়। প্রকৃতির লীলাভূমি মিজোরাম। কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতি পঞ্চাশ বছর অন্তর অন্তর মিজোদের পাহাড় আর সমতলকে অপরূপ রূপে সাজানোর জন্য এখানে সেখানের হাজরো বাঁশ ঝাড় ফুলে ফুলে সেজে ওঠে।
বাঁশ ফুল প্রচুর প্রোটিন সমৃদ্ধ। মিজোরামের কালো ইঁদুরের দল মহানন্দে বাঁশ ফুল ভক্ষণ করতে থাকে। এতে ইঁদুরদের প্রজনন ক্ষমতা বেড়ে যায় বহুগুণ। ফলে লক্ষ লক্ষ ইঁদুর জন্ম নেয়। এই লক্ষ ইদুঁরের বাঁশ ফুল খাওয়া শেষ হলে পঙ্গপালের মত তারা খাদ্যের জন্য ইতিউতি করতে থাকে। এক সময় দলে দলে ইঁদুর নেমে পড়ে খাদ্যের সন্ধানে। তারা মিজোদের মাইলের পর মাইল ফসলের মাঠ উজাড় করে। গোলার ফসল ক্ষেত খামার কিছুই আস্ত রাখে না। ফলশ্রুতিতে মিজোরামে দেখা দেয় চরম খাদ্যাভাব তথা দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষ দমনে আসামের তৎকালীন রাজ্য সরকার এবং দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকার চরম ব্যর্থতা এবং অবহেলা প্রদর্শন করে। এখানে উল্লেখ্য ১৮৯৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত মিজোরা নাগাদের মত স্বাধীন সত্তা নিয়ে বসবাস করছিলেন, সে সময়ের বৃটিশ ভাইসরয়ের প্রতিনিধি মিজোরামকে আসামের সাথে সংযুক্ত করেন।
১৯৫৯–৬০ সালে মাউতাম জনিত দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার প্রতিবাদে তরুণ এক মিজো ব্যাংক করণিক লালডেঙ্গা গড়ে তোলেন মিজোরামে মিজো ন্যাশনাল ফেমিন ফ্রন্ট The Mizo National Famine Front বা মিজো দুর্ভিক্ষ নিবারণ ফ্রন্ট। এই লাল ডেঙ্গার নেতৃত্বে মিজো তরুণরা মিজোরামের প্রত্যন্ত পাহাড়ী অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত মিজোদের প্রতি সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। দলে দলে মিজো তরুণরা লালডেঙ্গার এই উদ্যোগে অংশগ্রহণ করে। দুর্ভিক্ষ প্রশমিত হয়। লালডেঙ্গা ১৯৬১ সালে মিজো ন্যাশনাল ফেমিন ফ্রন্ট থেকে ফেমিন শব্দটি বাদ দিয়ে একে “মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট” নাম দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করেন। এরই মাঝে লালডেঙ্গা গোপনে তৎকালীন পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। সেই যোগাযোগ সূত্রে মিজো তরুণদের কয়েকটি দল অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে। ১৯৬৫ সালে লালডেঙ্গার এই মরিয়া প্রচেষ্টা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা উদঘাটন করে। লালডেঙ্গা গ্রেফতার হন। আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা সেইসময়ে নাগাদের প্রবল সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ মোকাবেলায় ব্যস্ত ছিলেন। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় লালডেঙ্গাকে বন্দী রেখে মিজোদের মাধ্যমে আরো একটি ফ্রন্ট খোলা বোকামি হবে ধরে নিয়ে তিনি লালডেঙ্গাকে মুক্তি দিয়ে দেন।
লালডেঙ্গা বিমলা প্রসাদ চালিহা’র সেই কৌশলে কাবু হননি।
২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬ সামরিক প্রশিক্ষণে সুদক্ষ মিজো গেরিলারা “অপারেশন জেরিকো” নাম দিয়ে লালডেঙ্গার নেতৃত্বে মিজোরামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হানে। প্রথম আক্রমণেই তরুণ দুর্ধর্ষ মিজোরা বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে আইজলের সরকারী কোষাগার, বেতার কেন্দ্র সহ বিভিন্ন পুলিশ স্টেশন দখল করে নেয়, একই সাথে লালডেঙ্গার গেরিলা দল মিজোরামের অন্য গুরুত্বপূর্ণ শহর লেংলে’ও দখল করে। লালডেঙ্গার এই অভিযান তেমন কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। ভারতীয় কতৃপক্ষ ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকটা হতবাক হয়ে পড়ে। ১৯৬২ সালে চীনের সাথে যুদ্ধে ভারতের অনেকটা নাজুক অবস্থা এবং ১৯৬৫ সালের পাক –ভারত যুদ্ধ এমন প্রেক্ষাপটে মিজোদের এই আকস্মিক আক্রমণ ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। এক সপ্তাহ’র মধ্যেই ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ন শক্তিতে মিজোদের ওপর প্রতি আক্রমণ পরিচালনা করে। ভারতীয় সেনা বাহিনীর এই প্রবল প্রতি আক্রমণে মিজোরা পিছু হটে। লালডেঙ্গা সহ দলে দলে মিজো যোদ্ধার দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাধারণ মিজোদের ঘরবাড়ী ধ্বংস করে তাদের গুচ্ছ গ্রামে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করে। গুচ্ছ গ্রামগুলি অবস্থান নির্ধারণ করা হয় রাস্তার ২০ থেকে ৫০ কিঃ মিঃ মধ্যে। মিজোদের প্রচন্ড বিদ্রোহ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর তড়িৎ পাল্টা অভিযান দুটিরই ক্রমশ বেদনার এক যবনিকাপাত ঘটে। কোন পক্ষের জন্য কোন হাততালি ছাড়া। এ ঘটনায় মিজোদের সাথে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দূরত্ব বাড়ে।
১৯৬৭ সালে ভারত সরকার মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতদসত্তেও মিজোরা তাদের সশস্ত্র আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশে রুপান্তরিত হলে মিজোরা ইতিপূর্বের পূর্ব পাকিস্তানের সব ঘাঁটি হারায়। র্পা্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে “অপারেশন ঈগল” নামে ভারতীয়দের প্রবল আক্রমনে মিজোরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অপারেশন ঈগল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ করে র্পা্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে অনেকটা অপঠিত এক ইতিহাস।
আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ যে সব তিব্বতিদের চীনাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নেপালে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল, ১৯৬২ সালে চীন – ভারত যুদ্ধের পর পরই তাদের ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাতে রেখে সি আই এ নেপাল ত্যাগ করে। এর পর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল উবান তিব্বতীদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এইসব তিব্বতিদের পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত করার জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি চাইলে, শ্রীমতি গান্ধী তিব্বতিদের উদ্দেশ্যে লেখেন “We can not compel you to fight a war for us but the fact is that … In a way, it is like the way the Chinese are treating the Tibbetian in Tibet, we are facing similar situation. It would be appreciated if you could help us fight the war for liberating the people of Bangladesh”. “আমরা আমাদের যুদ্ধ করতে আপনাদের জোর করতে পারি না … তবে বিষয়টি এরকম আপনারা তিব্বতিয়রা যে রকম চীনাদের দ্বারা নিপীড়িত ঠিক তেমনিভাবে বাঙালীরাও পাকিস্তানীদের দ্বারা নির্যাতিত, এ যুদ্ধে আপনারা অংশগ্রহণ করলে তা প্রশংসিত হবে”। অল্প কিছুদিনের মাঝে “অপারেশন ঈগল” নামে তিন হাজার তিব্বতীয় “স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স” মিজোরামের “দেমাগ্রি” অঞ্চলে অবতরণ করে এবং ক্রমান্বয়ে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে পাকিস্তানী ৯৭ স্বতন্ত্র ব্রিগেড এবং ২ কোমান্ডো ব্যাট্যালিয়নের মুখামুখি হয়ে যুদ্ধ করে। এ যুদ্ধে তিব্বতীয়দের অন্যতম শিকারে পরিণত হয় মিজো যোদ্ধারা যারা পাকিস্তানীদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। এতে করে ভারত তার দুটি লক্ষ্য একই সাথে অর্জন করে। পাকিস্তানী এবং মিজোদের নিধন। “ফ্যান্তমস অব চিটাগাং, দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ” এবং “সি আই এ’ সিক্রেট ওয়ার ইন তিব্বত” এ দুটি বই এ এবিষয়গুলি সবিস্তারে বর্ণিত আছে।
নানা ঘাত প্রতিঘাতের পর ১৯৭২ সালে ভারত সরকার মিজো অঞ্চলকে আসাম থেকে আলাদা করে ভারতীয় ইউনিয়ন টেরিটরির মর্যাদা দেয়। বাংলাদেশ আর মায়ানমারের মাঝামাঝি এই অঞ্চলে ১৯৬৬ – ১৯৮৬ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামে কত মিজো তরুণ যে জীবন দিয়েছে তার হিসেব শুধু মিজোরামের দুর্গম অরণ্যই জানে।
রক্তে রক্তে মিজোরাম যখন রঞ্জিত তখন ৩০ এপ্রিল ১৯৮৬ ভারত সরকার এবং মিজো ন্যাশনার ফ্রন্টের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত সরকার মিজোরামকে তাদের ২৩ তম রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে, বিনিময়ে সশস্ত্র মিজোরা অস্ত্র সমর্পণ করে। লালডেঙ্গার এম এন এলএফ–এর মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ, মায়ানমার আর আসামের মিজো অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠন। লালডেঙ্গার পাশাপাশি ব্রিগেডিয়ার সাইলোও স্বতন্ত্র মিজোভূমির ডাক দেন তবে তা ভারতীয় সংবিধানের আওতায় একটি অঞ্চল হিসাবে।
বহু মিজো তরুণের অকাতর আত্মাহুতির পর অবশেষে লালডেঙ্গার এম এন এল এফ আর সাইলোর মিজোরাম পিপলস পার্টি মিশে যায় যথাক্রমে ভারতীয় কংগ্রেস আর জনতা পর্াটিতে।
ভারতের কৌশল প্রনেতাদের লালডেঙ্গার অপূর্ণ স্বপ্ন জানা না থাকার কথা নয়। তাই যখনই বাংলদেশে মিজোদের স্বপ্ন পূরণের কোন ধরনের অনুকূল কোন হাওয়া বইতে দেখেন তখনই ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা অতিরিক্ত স্পর্শ কাতর হয়ে পড়েন। বাংলাদেশ–ভারতের সম্পর্ক বিবেচনায় এ বিষয়টি মনে রাখলে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় কোন ভুলবুঝাবুঝির অবকাশ থাকবে না। (চলবে)
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক