সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের প্রদেশসমূহ : ভারত-বাংলাদেশ চলমান সম্পর্ক

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তোড়ে ৫ আগস্ট ২৪ বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হয়। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং ভারতীয় সরকারের মাঝে সম্পর্কের কিছুটা শীতলভাব পরিলক্ষিত হয়। ৭ আগস্ট ২০২৪ ভারতীয় এন ডি টিভি’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অনেকটা সতর্ক বাণী উচ্চারণের মত করে বলেন “India’s north-east, West Bengal and Myanmar will be affected if Bangladesh becomes unstable ” অর্থাৎ বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে তা ভারতীয় পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গ এবং মায়ানমারকেও অস্থিতিশীল করে তুলবে। বার্তাটা সংশ্লিষ্টদের জন্য খুবই কঠিন এবং ব্যাপক। কঠিন যেহেতু ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চলের স্থিতিশীলতা ভারতের জন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয় সেহেতু সেখানে অস্থিতিশীলতার বিষয় উঠে আসলে সেটি নিশ্চিতভাবে ভারতের জন্য কঠিন বার্তাই বহন করবে। ব্যাপক এজন্য এতদঞ্চলের স্থিতিশীলতা পারস্পরিক নির্ভরশীল। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই হয়ত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী রাজনাথ সিং লৌক্ষ্ণ’্‌এ সেন্ট্রাল কমান্ড হেডকোয়ার্টস, এ আয়োজিত “শক্ত আউর সুরক্ষিত ভারত” সেমিনারে সেদেশের উর্ধ্বতন সেনা কমান্ডারদের দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ দেন। দিক নির্দেশনামূলক সে ভাষণের এক পর্য্যায়ে রাজনাথ সিং বলেন ..ongoing Russia-Ukraine and Israel- Hamas conflicts and the current situation in Bangladesh, and exorted the commanders to analyse these episodes, predict the problems that country may face in the future, and stay prepared to deal with the ~unexpected”. ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বক্তব্যের সারমর্ম, “রাশিয়া – ইউক্রেন, ইসরাইল – হামাস যুদ্ধ, বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতা আপনাদের পর্যালোচনা করতে হবে, এবং সে অনুযায়ী ভবিষ্যৎ এ “অকল্পনীয়” পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্ত্তুত থাকতে হবে।

শ্রী রাজনাথ সিং এর এ বক্তব্য বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতি সচেতন সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এ প্রসঙ্গে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন “ও I am surprised but not concerened ” আমি আশ্চার্যান্বিত হয়েছি তবে শংকিত নই।

সাম্প্রতিকের এসব কথা চালাচালির বাইরেও সদূর অতীতেও আমাদের র্পা্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতীয় পূর্বাঞ্চল নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের মাঝে বহুবার জল ঘোলা হয়েছে। এই ঘোলা জলে মাথা চাড়া দিয়েছে কখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনী, কখনো মিজোরামের মিজোরা, কখনো নাগাল্যান্ডের নাগারা, কখনো ত্রিপুরার টি এন ভি’র এ টি টি এফ কখনো আসামের উলফা বিচ্ছিন্নতাকামী গোষ্ঠী, আবার কখনো দশ ট্রাক অস্ত্র। এ প্রসঙ্গে আরো আলোচনার পূর্বে ভারতীয় পূর্বাঞ্চল লীয় রাজ্য সমূহের সম্যক পরিচিতি এবং ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা কিছু বিষয় তুলে ধরা বাঞ্চনীয়।

মণিপুর। মণিপুরের দক্ষিণ পূর্ব জুড়ে মায়ানমারের সাথে প্রায় ৩৫২ কিঃ মিঃ আন্তর্জাতিক সীমারেখা রয়েছে। এর উত্তরে নাগাল্যান্ড, পশ্চিমে আসাম আর দক্ষিণে মিজোরাম। মণিপুর বলতেই আমরা বাঙালীদের মানসপটে ভেসে উঠে মণিপুরি নৃত্য, মণিপুরের বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বর্তমানে মণিপুরের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, বিরাজমান সহিংসতা ভারতীয় রাজনীতিকে টালমাটাল করে রেখেছে। সমতলের মেইতি আর পাহাড়ের কুকিদের মাঝে চলমান সংঘর্ষ মণিপুরকে ইতিমধ্যেই অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সংবাদ ভাষ্য অনুযায়ী মণিপুরের কিছু কিছু অঞ্চল তাদের স্বাধীনতার দাবিও তুলেছে।

নাগাল্যান্ড। নাগাল্যান্ডের উত্তরপূর্বে অরুনাচল, দক্ষিণে মণিপুর উত্তর পশ্চিমে আসাম এবং পূর্বে মায়ানমার। এই নাগাল্যান্ড বলতে সর্ব্বাগ্রে আমরা ‘এন এস সি এন’ বা ন্যাশনাল স্যোসালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড এবং ড. ফিজোকেই জানি। এ দুটি সত্তা নাগাল্যান্ডের অধিকার আদায়ে সব সময়েই উচ্চকন্ঠ ছিল।

১৮৪০এর পূর্বে নাগারা নাগাদের মত করে দুর্গম পাহাড়ে বসবাস করত। বহির্বিশ্বের সাথে নাগাদের যোগাযোগ বলতে ছিলই না। বহিরাগতদের নাগারা তাদের অদম্য সাহস আর দুর্দমনীয় যুদ্ধ কৌশলের সাহায্যে নাগাল্যান্ড থেকে দূরে রাখে।

বৃটিশদের কাছে নাগাল্যান্ডের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক তেমন গুরুত্ব ছিল না। তবে ভারতীয় পূর্বাঞ্চল এবং বার্মার সাথে যোগাযোগ করিডোর হিসেবে বৃটিশদের কাছে নাগাল্যান্ডের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ লক্ষ্য অর্জনে নাগাদের বশে আনতে বৃটিশদের লেগে যায় চল্লিশ বছরেরও অধিক সময়। স্বশস্ত্র যুদ্ধে নাগাদের বশে আনতে বৃটিশদের এই প্রানান্ত চেষ্টায় এক সময় তারা অবলম্বন করে ভিন্ন কৌশল। এ কৌশলের ফলশ্রুতি বৃটিশদের হাত ধরে ১৯ শতকে নাগাল্যান্ডে খৃষ্টান মিশনারীদের আগমন। শুরু হয় নাগাদের মাঝে খৃষ্ট ধর্মের প্রচার এবং প্রসার। মুন্ডু শিকারী, উলঙ্গ নাগারা দলে দলে নিজেদের হাজার বছরের ধর্ম আচার-আচরণ, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ত্যাগ করে খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করা শুরু করে। ধর্মান্তরিতের এই সময়কে বৃটিশরা সুকৌশলে নাগাদের মনস্তত্তে প্রোত্থিত করে এক অমোঘ স্বর্গীয় দীক্ষা যার ফলশ্রুতি নাগারা এই ধর্মান্তরিতের সময়কে আখ্যায়িত করে From darkness to light অর্থাৎ অন্ধকার থেকে আলোয় অভিযাত্রা বলে।

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ ১৪ আগস্ট নাগারা নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে। সেই থেকে নাগারা ১৪ আগস্ট কে তাদের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ভারত সরকার বিষয়টি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। এ থেকে সৃষ্টি হয় নাগাল্যান্ডের ইতিাসে এক বিষাদ করুন অধ্যায়।

র্মাচ ১৯৫২ সাল। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু এবং নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিলের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ডঃ ফিজো ভারতীয় প্রধান মন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু’র সামনে নাগাদের জন্য স্বতন্ত্র আবাস ভূমির যুক্তি এবং জোর দাবি তুলে ধরেন।

নেহেরু এর প্রতিউত্তরে সদম্ভে ঘোষণা করেন : “Whether heavens fall or India goes into pieces and blood runs red in the country, whether I am here or any one else, Nagas will not be allowed to be Independent” অর্থাৎ প্রলয় বয়ে যাক, ভারত খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাক, দেশ জুড়ে রক্তগঙ্গা বয়ে যাক, আমি প্রধানমন্ত্রী থাকি বা না থাকি তাতে কিছু যায় আসে না কিন্তু নাগাদের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া হবে না”।

নেহেরুর এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়া হিসাবে নাগারা ১৯৫৬ সালের ২২ শে মার্চ ফেডারেল রিপাবলিক অব নাগাল্যান্ড গঠন করে। নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বেপরোয়া নাগা নেতারা ১৯৫৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার র্সাভিসেস ইন্টিলিজেন্ট বা আই এস আই’ এর সাথে কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে।

ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চলে প্রভাব বলয় বিস্তারে এবং ভারতকে কৌশলগত চাপে রাখার জন্য নাগাদের সাহায্যার্থে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে ইতিমধ্যে চীনা গোয়েন্দা সংস্থাও যুক্ত হয়।

১৯৫৬ সালে ভারত সরকার সমগ্র নাগা হিলকে উপদ্‌্রুত এলাকা ঘোষণা করে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ভারতের তৎকালীন সেনা প্রধান প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহর লাল নেহেরুর কাছে স্বীয় মতামত তখন এভাবে তুলে ধরেছিলেন :

the than Chief of Army Staff General KS Thimaya in a stormy meeting told Nehru candidly that Òit required political wisdom rather than military might to solve the Naga problems ”. ভারতের তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল কে এস থিমাইয়া প্রধানমন্ত্রী নেহেরুকে নাগাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক দূরর্দশিতার আলোকে সমাধানের পথ খোঁজার মতামত ব্যক্ত করেন।

“ Nehru, slightly ruffled, said `what are the soldiers meant for or words to that effect . এর জবাবে রাগতস্বরে নেহেরু থিমাইয়াকে জিজ্ঞেস করেন তাহলে সেনাবাহিনী কি জন্য? Thimmaya did what he was expected to do নেহেরুর মনোভাব বুঝতে পারেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

The Indian Army was moved in to the Naga Hills of Assam to tame the tribesmen in March 1956. That was how the Naga Hills later to be known as Nagaland, became IndiaÕs first counter insurgency theatre . মার্চ ১৯৫৬ নাগা বিদ্রোহ দমনে আসামের নাগা পার্বত্যাঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে। আর এভাবেই রচিত হয় আসামের নাগা হিলস থেকে নাগাল্যান্ড সৃষ্টির এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি থিয়েটার। (চলবে)

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসত্য প্রকাশের প্রজ্বলিত মশাল দৈনিক আজাদী
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে