রাজনীতির মৌল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হল জনগণের কল্যাণ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে একই আদর্শে বিশ্বাসী রাজনীতিকরা নিজেদের দল গঠনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট বা আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হন। এর বাইরে রাজনীতিতে যোগদান করে জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে স্বীয় স্বার্থ আদায়ে ব্যপ্ত হওয়া যেমন অনৈতিক তেমনি এধরনের প্রচেষ্টা একটি গর্হীত অপরাধও। এটা পরিলক্ষিত হয়েছে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা জনগণের কল্যাণকে প্রধান্য না দিয়ে গরিষ্ঠ সংখ্যকই নিজের আখের গোছানোতে নিজেদের ব্যাপৃত করেন। এটার প্রমাণ তারা সংসদে গিয়ে প্রথমেই দুনিয়ার দামী গাড়িগুলির একটি ডিউটি ফ্রিতে আমদানী করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন, ঢাকা শহরে আবাসিক প্লটটি যত দ্রুত সম্ভব বুঝে নেন, সংসদে নিজেদের বেতন ভাতা নিজেরা বাড়িয়ে নেন, মোবাইল টেলিফোন সেট দুই চার টা থাকলেও সরকারের টা দ্রুত হস্তগত করেন। কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত পাউলু লুলুম্বার একটি বক্তৃতা শুনেছি, সে বক্তব্যের মূল সুর যেন আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনেরও প্রতিধ্বনি।
লুলুম্বা তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন ‘আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যখন ভোটের জন্য আমাদের কাছে আসেন তারা তখন বিনয়ের অবতার, তারা আমরা যা শুনতে চাই তাদের বক্তৃতায় তাই বলেন, আমাদের সমতলে আসার জন্য তারা খালি পায়ে হাঁটেন, তারা আমাদের সাথে আমাদের থালা বাসনে আহার করেন, আমাদের হাতল ভাঙা চায়ের কাপে চাও পান করেন, তারা আমাদের শিশুদের কোলে তুলে নিয়ে চুমু খান, আমাদের সাথে হাসি মুখে সেলফি তোলেন, তারা বলেন, তাদের দরজা সব সময় আমাদের জন্য খোলা”।
‘আমরা রাজনৈতিক নেতাদের উপর আস্থা রেখে আমাদের ম্যান্ডেট তাদের দিই, তারপর আমাদের ম্যান্ডেট পাওয়া নেতাকে প্রয়োজনে ফোন করি, উনারা তখন আর ফোন ধরেন না, ধরেন তাদের পি এস–কর্কট স্বরে তাচ্ছিল্যের সুরে সে বলে স্যার এখন ব্যস্ত – সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন, এর পর রাজপথে আমাদের অপমান করার জন্য উচ্চৈস্বরে সাইরেন বাজিয়ে তারা তাদের কর্তৃত্ব জাহির করেন, তারা যখন ‘হরিবল’ তখনও আমাদের বলতে বাধ্য করেন তারা ‘অনারেবল’।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের রাজনৈতিক নেতা জনপ্রতিনিধিদের অনারেবলই হওয়ার কথা। একসময়ে ইংল্যান্ডের এ্যাংলো স্যাকসন রাজারা নানা বিষয়ে পরামর্শের জন্য সমাজের বিদ্ধগ্ধ – বিজ্ঞজনদের সভায় আমন্ত্রণ জানাতেন, সেই সমাবেশকে বলা হত,‘ওয়েটিনাগেমট’ বা মিটিং অব দি ওয়াইজ। পরবর্তীতে এ ধরনের সভাকে আরো যথার্থভাবে নাম করণের স্বার্থে ল্যাটিন শব্দ ‘র্পালামেন্টিয়াম’ ব্যবহার করা শুরু হয়। এই র্পালামেন্টিয়াম শব্দের ইংরেজী অর্থ কাউন্সিল অব দি গ্রেটম্যান যা বাংলা করলে দাঁড়াবে মহান ব্যক্তিদের সমাবেশ। পরবর্তীতে এই ‘র্পালামেন্টিয়াম’ ই পার্লামেন্টে রূপ নেয়। রূপান্তরের ক্রমধারায় আমাদেরও পার্লামেন্টে হয় কিন্ত্তু এই পার্লামেন্টে মহান ব্যক্তিদের সমাবেশ খুব যে একটা হয়েছে তা নয়। এই না হওয়ার পিছনের কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে এখানে মহানদের চেয়েও মতলব বাজদের সমাবেশ হয়েছে বেশি। দুর্ভাগ্য আমাদের পার্লামেন্টের গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্য পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন, জনগণের মঙ্গলার্থে সদূর প্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন, পার্লামেন্টে আনীত আইনের উপর গঠনমূলক আলোচনা করতেও অক্ষমতার পরিচয় দেন, অধিকাংশই দলবাজি করার মাঝেই পার্লামেন্টে সময় পার করেন। এ হল ব্যক্তির বিবেচনায় প্রযোজ্য। দলের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির নৈতিক অবস্থান আরো নাজুক। দলের উর্ধ্বে উঠে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে এ যাবতকাল দলগুলি দূরদর্শীতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আমি নির্ভীক এবং অকুণ্ঠ চিত্তে বলতে পারি সাম্প্রতিকের ঘটনা সমূহে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির কোনটিই তাদের জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা যথার্থভাবে প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যেমন ঘটেছে তেমনি আন্দোলন পরবর্তী সময়েও ঘটেছে। আরো পরিতাপের বিষয় আমাদের রাজনৈতিক দল সমূহ তাদের কর্মী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রশিক্ষণে সমৃদ্ধ করে রাজনৈতিক অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ারে পরিণত না করে ক্ষেত্র বিশেষে লাঠিয়াল বাহিনীতে বা লুঠেরা শ্রেণিতে পরিণত করেছেন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকালীন আর ৫ আগস্ট পরর্বতী সময়।
রাজনৈতিক কর্মীরা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতার বাড়ি আগুনে পুড়িয়েছেন। এখানে একবারও ভাবার কারো অবকাশ হয়নি যে পোড়ানো বাড়িটির সব বসবাসকারী একই দলের সমর্থক নাও হতে পারেন। একই দলের হলেও বাড়িটিতে নারী শিশু বৃদ্ধ বৃদ্ধা থাকতে পারেন। আমাদের এই শহরের এক সময়ের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মিলনকেন্দ্র ছিল মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবন, সে বাড়িতে আমরা আগুন দিয়েছি, বিএনপি মহানগর শাখার বর্তমান আহবায়ক এরশাদ উল্লার বাড়িতে আমরা আগুন দিয়েছি, পরবর্তীতে ভিডিও’তে দেখেছি প্রজ্জলিত আগুন দেখে মিসেস এরশাদ যখন সজোরে পবিত্র কোরান শরীফ পাঠ করছিলেন সে দৃশ্য যেকোন মানুষের মনে বেদনার রেখাপাত করবে, ডা. শাহাদাতের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, জনাব আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, সে আগুনের লেলিহান শিখার সামনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীরর গাড়ি চালক যখন কাঁদতে কাঁদতে আর্তনাদ করছিলেন ‘আমার স্যার ত নাই আমার স্যারের গাড়িগুলি কেন পুড়িয়ে দিচ্ছেন?’। এ দৃশ্যও ভিডিও ক্লিপে দেখেছি। এখন প্রশ্ন একজন সাধারণ গাড়ি চালকের মনে যে বোধ–বেদনা, তা থেকে উৎসারিত যে চেতনা, তা আমাদের রাজনৈতিক কর্মী বাহিনী কি ধারণ করেন? করেন না। করলে তারা এ বাড়ি সে বাড়িতে আগুন দিয়ে পোড়াপুড়ির সংস্কৃতি চালু করতেন না।
পোড়াপুড়ির এ সংস্কৃতি শুধু এ চট্টগ্রামে নয় বাংলাদেশের নানা প্রান্তেও সংঘটিত হয়েছে, আরো নির্মম নৃশংসভাবে। মাশরাফি বিন মূর্তজা, ক্রিকেটে তার আদরনীয় নাম ‘ম্যাশ’, ফাস্ট বোলার, গতির জন্য মাশরাফিকে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ও বলা হয়, এই সূত্রে গতিময়তা বাড়াতে গিয়ে পায়ের রগ বোধ হয় একটিও আস্ত নাই, সব কটি ছিড়েছে। বাংলাদেশের সফল ক্রিকেট ক্যাপ্টেনদের অন্যতম একজন। সংসদ সদস্য হওয়ার পর তাকে জন মানুষের সাথে অবলীলায় মিশে যেতে দেখেছি। অজাতশক্র এই মাশরাফির নড়াইলস্থ বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিতাপের বিষয় ঐ বাড়িতে মাশরাফি’র আশ্রয়ে আটাশ জনের মত অনাথ শিশুর বাস ছিল, বাড়িটি পোড়ানোর পর সেই অনাথরা আরো অথৈ সাগরে। এ ঘটনার পর মাশরাফির সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া হৃদয় ছোঁয়া স্ট্যাটাসটি আমি পড়েছি, পড়া শেষে শুধু বিমর্ষ বেদনায় ডুবেছি, আকণ্ঠ লজ্জায় নিমজ্জিত হয়েছি।
আমরা পোড়ানোতে যেমন অভিযোগ আনায়নে তেমনি পারঙ্গমতা দেখিয়েছি। এটা এখন যেমন অতীতেও। তামিম ইকবালকে যখন বিশ্বকাপ থেকে নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে হাতুরু, পাপন, সাকিব’রা বাদ দিয়েছিলেন তখন আমি ইউটিউবে কড়া একটি বক্তব্য আপলোড করেছিলাম। এতদসত্ত্বেও একথা বলতে আমি একটুও কুণ্ঠিত হবো না, মাশরাফি, সাকিব, তামিম এরা আমাদের গৌরবের ধন।এদেরকে নিয়ে যখন ইচ্ছে ছিনিমিনি খেলার অধিকার করো নেই। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের কথা একবার ভাবুন কী বলে! কী ব্যাটে! কী দুর্দান্ত পারফরম্যন্স সাকিবের। ভাঙা হাতের তামিমের এক হাতে ব্যাট করতে মাঠে নেমে পড়া এবং দলকে জিতানো। এ সব কখনো ভোলার নয়। আমাদের আরেক গৌরবের কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহাম্মদের কথা দিয়েই বলি-‘আনন্দে চোখে পানি আসার মত ঘটনা আমার জীবনে অনেকবার ঘটেছে। যে ক’বার বাংলাদেশ ক্রিকেটে জিতেছে প্রতিবারই আমার চোখে পানি এসেছে। বাংলাদেশী ক্রিকেটের দুর্দান্ত সব খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ। তারা চোখভর্তি পানি নিয়ে আসার মত আনন্দ একজন লেখককে বারবার দিচ্ছেন। পরম করুণাময় এইসব সাহসী তরুণের জীবন মঙ্গলময় করুক, এই আমার শুভ কামনা’।
আমাদের দুর্দান্ত সব ক্রিকেটারের মধ্যে মাশরাফি, তামিম, সাকিব অন্যতম। নিতান্ত পরিতাপের বিষয় আমরা আমাদের ক্রিকেটের অন্যতম মধ্যমনি সাকিবকেও হত্যা মামলার আসামী বানিয়ে ছাড়ছি, মাশরাফির ঘর পুড়ছি। এসব যারা করছে তাদের অবশ্যই দায়বদ্ধতায় আনতে হবে। বিবেকবান মেধাবী সাংবাদিক এবং সম্পাদক মাহফুজ আনাম তার সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন, যা এ সময়ে অনাঙ্ক্ষকিত। তাঁর পর্যবেক্ষণ সমূহের এখানে পুনরাবৃত্তি অশোয়উক্তি হবে বলে মনে হয় না। তার পর্যবেক্ষণে তিনি বলেছেন, জোর করে সচিবালয়ে ঢুকে এইচএসসি’র বাকি পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য করা, বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় আমলাদের পদোন্নতি দিতে সরকারকে বাধ্য করা, জোর করে বিশ্ববিদ্যালয় সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির বিভিন্ন পদ থেকে শিক্ষকদের অপসারণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিয়োগ প্রাপ্তদের বদলাতে বাধ্য করা, এই ক্রান্তি লগ্নে রাজনৈতিক দলগুলির গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করার তোড়জোর ইত্যাদি শুধু অনভিপ্রেতই নয় অন্তর্বর্তী সরকারের ভীতকে দুর্বল করবে।
তবে আমার দৃষ্টিতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার মাঝে সহিংস জ্বালাও পোড়াও এর সংস্কৃতি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মর জন্য একটি অসহনীয় লজ্জার বাণী বয়ে নিয়ে যাবে। সহিংসতার এই সংস্কৃতি অবিলম্বে বন্ধ হওয়া বাঞ্চনীয়। অন্যথায় খৃষ্টের জন্মেরও ১৭৯০ বছর আগে ব্যবিলনীয় রাজা হামুরাবি প্রণীত বিধি ‘এ্যান আই ফর এ্যান আই’ ‘চোখের বদলে চোখ’, মহাত্মা গান্ধী গত শতকে এই বিধিকে হৃদয় ছোঁয়া এক আবেদনের মাধ্যমে মানব জাতির সামনে তুলে ধরেছেন এইভাবে ‘আমরা যদি চোখের বদলে চোখ নিতে থাকি দেখা যাবে এক সময়ে পুরা পৃথিবাটাই অন্ধের পৃথিবীতে পরিণত হয়েছে’।
চলুন এখন ‘চোখের বদলে চোখ’ এ নীতি পরিহার করি। বরং এখন সময় আমাদের রাজনীতি থেকে সকল প্রকারের দুর্র্বৃত্তায়ন, অপসংস্কৃতি, অপছায়া ঝাটিয়ে বিদায় করার। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে ‘চোখের বদলে চোখ’ এ নীতি অবলম্বন করে পথ চলতে গেলে দেখা যাবে এক সময় পুরা জাতিটাই অন্ধত্বের কবলে পড়ে গেছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।