সমকালের দর্পণ

রাজনীতির তামাশার গল্প

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ২১ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৫৩ পূর্বাহ্ণ

পাঠকদের জন্য আমি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমার দেখা তামাশার গল্প তুলে ধরছি। গল্পের লীলাভূমি চকরিয়াপেকুয়া। রাজনীতিতে এ গল্প হয়ত আগামী বহু বছর তামাশার গল্প হয়েই থাকবে।

গল্পটা শুরু করি। মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক (অব.)। তিনি শিক্ষা জীবনে অনন্য অর্জনের অধিকারী। সামরিক জীবনে তার মেধা বিকশিত হয় ঈর্ষণীয়ভাবে। ১৯৯৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেনারেল ইবরাহিম সামরিক বাহিনী থেকে তার চাকরি হারান। জেনারেল ইবরাহিমের নেতৃত্বে পার্বত্য খাগড়াছড়িতে এক অস্থির সময়ে আমার কাজ করার সুযোগ হয়। তিনি তার কর্মকৌশল এবং কাজের প্রতি নিবেদিত প্রাণের জন্য আমার সমীহের একজন কমান্ডার ছিলেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমিতেও জেনারেল ইবরাহিমের সাথে আমার কাজ করার সুযোগ হয়। আমি যখন মায়ানমারে কর্মরত সেখানেও জেনারেল ইবরাহিম সফর করেছেন এবং একান্তে আমাদের অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ হয়। সে আলোচনা এখানে হয়ত অপ্রাসঙ্গিক। লেখালেখি এবং টিভি টক শোতেও জেনারেল ইবরাহিম একটি স্বকীয় অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।

এরই মধ্যে জেনারেল ইবরাহিম বিএনপি’র অঙ্গ সংগঠন হিসাবে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল গঠনের উদ্যোগ নিয়ে দারুণভাবে ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে তিনি কল্যাণ পার্টি নাম দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেনএটি আমরা সবাই জানি। সে দল নিয়ে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক মোর্চায় শরীক হন। শরীক বললে ভুল হবে তিনি সেই মোর্চায় খুবই সক্রিয় ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি বিএনপি জোট থেকে বিএন পি’র মহারথি নেতাদের ডিঙ্গিয়ে হাটহাজারী আসন থেকে মনোনয়নও লাভ করেন।

রাজনৈতিক সচেতন মহলকে হতবাক করে জেনারেল ইবরাহিম জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেন। কয়েকদিন পর সবাইকে আরো হতবাক করে তিনি চকরিয়া আসন থেকে নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্যে মনোনয়ন পত্র জমা করেন। সাধারণ্যে তখন আলোচনা প্রবল ‘হালদা পাড়ের ইবরাহিম’ চকরিয়া কেন! হাটহাজারী বা ঢাকা সেনানিবাস নয় কেন? সে উত্তর জেনারেল ইবরাহিম দিয়েছেন ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধামুক্তিযুদ্ধের সময় আমার কোন এলাকা ছিল না, এখনও নাই’। এর উত্তরে যদিও বলা যায় আপনি আপনার ব্যাটালিয়নের বাইরে এক পা এগিয়ে কোথাও তো কোনও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন একথা বলতে পারবেন না। অথচ এখন জোটের বাইরে দলের বাইরে গিয়ে নির্বাচন। তাও আবার যে এলাকার সাথে অতীতের কোনও সম্পর্ক বা শিকড় আপনার নেই। জেনারেল ইবরাহিমকে খ্যাতনামা সাংবাদিক মুন্নি সাহা এই প্রশ্নটি একটু অন্যভাবে করতে দেখেছি। তিনি প্রশ্ন করেন ‘আপনি কোথাকার ভোটার’?

তখন আওয়ামী লীগ থেকে চকরিয়ায় সাংসদ জনাব জাফর আলম। জাফর আলমকে আমি আগে থেকে চিনতাম তার নামে। সাক্ষাৎ হয় কাকতালীয়ভাবে। সাতকানিয়ায় নোমান গ্রুপ বলে বড়সড় একটি শিল্প মালিকের বিশাল আকারের একটি মাদ্রাসা কমপ্লেক্স রয়েছে। সে মাদ্রাসাকে ঐ শিল্প গ্রুপ একটি কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার অনুষ্ঠানে আমি আমাদের তৎকালীন মাননীয় শিক্ষা উপমন্ত্রী (বর্তমান শিক্ষা মন্ত্রী)’র সফর সঙ্গী হয়ে ঐ অনুষ্ঠানে যোগদানের সুযোগ পাই। অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার আলেম ওলামা মাদ্রাসা শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। নানা গুণীজন তাদের জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রেখে যাচ্ছিলেন। তাদের বক্তব্যে নোমান সাহেবের প্রশংসার ফুলঝুরি। সেটাই সে অনুষ্ঠানে স্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান ছিল।

সাংসদ জাফর আলম বক্তৃতা দিতে ওঠেন। ছোটকাট একজন মানুষ। তিনি বক্তৃতা শুরু করলে আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলাম সেই ছোটকাট মানুষটি হঠাৎ এক বিশাল ব্যপ্তি ধারণ করেন। তার দৃপ্ত এবং ভরাট কণ্ঠে তিনি বলতে থাকেন ‘যে মানুষটি না হলে এদেশের স্বাধীনতা হত না, যে মানুষটি তার জীবনের সোনালী অধ্যায়ের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন করেছেন, যে মানুষের বদৌলতে আজ নোমান সাহেব নোমান গ্রুপ সেই মানুষটি বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা এ অনুষ্ঠানে এ পর্যন্ত একবারও তার নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করিনি। অথচ নোমান সাহেবের প্রশংসায় আমরা মুখে ফেনা তুলছি! জাতির জনকের প্রতি এই কি আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধ?’

জাফর আলমের সেই বক্তব্যে পুরা সমাবেশে পিনপতন শব্দ। তার প্রতি আমার সমীহ জাগে। জাফর আলমকে তার বক্তৃতা শেষে আমি অকুণ্ঠচিত্তে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি।

সেই জাফর আলমকে তার দল মনোনয়ন দেয়নি। সেটা আমার বিবেচ্যও নয়। জাফর আলমের মনোনয়ন না পাওয়ার পর তার ব্যাপারে ইতিবাচক নেতিবাচক অনেক কথা কানে আসে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে প্রার্থী করেন সালাউদ্দীন সিআইপি’কে। তিনি অন্য নামেও সে অঞ্চলে সমধিক পরিচিত। তার প্রার্থীতা ঋণ খেলাপির দায়ে বাতিল হয়। নিজ দলের সংসদীয় কমিটিকে ভুল তথ্য দিয়ে মনোনয়ন গ্রহণ এবং সে মনোনয়ন বাতিল হওয়ার জন্য জনাব সালাউদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধে তার পার্টি কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এমন খবর এখনও আমাদের কানে আসেনি। নাকি জেনারেল ইবরাহিমকে জিতিয়ে আনার জন্য স্বেচ্ছায় তিনি ঋণ খেলাপি হয়ে প্রার্থীতা বাতিল করিয়েছেন সে প্রশ্নও থেকে যাবে মানুষের মনে।

তামাশার রাজনীতি জমে উঠে যখন দেখা গেল আওয়ামী লীগের বাতিল হওয়া প্রার্থী আওয়ামী লীগের তখন বর্তমান সাংসদ জনাব জাফর আলমের বিরুদ্ধে কল্যাণ পার্টির প্রার্থী জেনারেল ইবরাহিমের পক্ষে সদলবলে প্রচারে নামেন। সে তামাশায় নানা তাপে চাপে নির্বাচনের দিন মাঝপথে জনাব জাফর আলম নির্বাচিত হওয়ার আশার হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন।

তামাশার দ্বিতীয় দৃশ্যপট। ‘বোয়ালখালিচান্দগাও’ এর সাংসদ জনাব মোসলেমউদ্দিনের মৃত্যু হলে সেখানে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব নোমান আল মাহমুদকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়। জনাব নোমান সাংসদ নির্বাচিত হন। ইতিমধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হয়।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বোয়ালখালিচান্দগাও’ আসনে জনাব নোমান আল মাহমুদকে পুনরায় মনোনয়ন দেয়। ইতিমধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার ভিত্তিতে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের ২৬ টি আসন ছেড়ে দেয়। চট্টগ্রাম ৮ তথা ‘বোয়ালখালিচান্দগাও’ আসনটিও এই ভাগাভাগিতে পড়ে। জাতীয় পার্টি জনাব সোলায়মান আলম শেঠ’কে এ আসনে মনোনয়ন দেয়। ‘হালদা পাড়ের ইবরাহিম’ চকরিয়া কেন? একই প্রশ্ন ‘বোয়ালখালিচান্দগাও’তেও উঠে। চকবাজারের সোলায়মান এখানে কেন! কিছু করার নেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। পার্টির সিদ্ধান্তে জনাব নোমান আল মাহমুদকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে হয়।

জনাব নোমান আল মাহমুদকে উপর্নিবাচন এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ উভয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়। উল্লেখ্য জনাব ছালামও এই দুইবারই মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। আরো উল্লেখ্য তিনি বিগত মেয়র নির্বাচনেও মনোনয়ন চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ তাকে কোনওটিতেই মনোনয়ন দেয়নি। যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল তিনি নেই আর যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি তিনি রয়ে যান এবং নির্বাচিতও হন। অন্যদিকে এই আসনে জনাব ছালামের রাজনৈতিক বিচরণ এবং গ্রহণযোগ্যতা জাতীয় পার্টির প্রার্থীর চেয়ে বহু শত গুণ বেশি। বিষয়টি জানা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ত কোনও এক দুরাশার ছলনায় অথবা ২৬ এর বলে বুক বেঁধেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল উনার জামানত নেই আর ২৬ গিয়ে দাঁড়ায় ক্রিকেট বা ফুটবল টিমে। এখন দেখা যাক জনাব গোলাম কাদের এই টিমকে নিয়ে কী খেলা খেলেন।

রিডার ডাইজেস্টের জোকসটা দিয়ে লেখাটা শেষ করি

As a Russian citizen, I am confused about why it takes America so long to get a definitive result from their election – we know our results months in advance!

রাশিয়ান হিসাবে আমি বুঝে উঠতে পারছি নাআমেরিকানরা তাদের দেশের ভোটের ফলাফল জানতে এত সময় নেয় কেনআমরা ত আমাদের দেশের ভোটের ফলাফল কয়েক মাস আগেই জেনে যাই’। লেখক : কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে