অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জসমূহ
৫ আগস্ট এবং ৯ আগস্ট ২০২৪ যথাক্রমে ‘ডয়েচে ভেলে’ এবং চ্যানেল ২৪ কর্তৃক অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জসমূহ সম্পর্কে আমাকে যে সব প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং আমি যা উত্তর দিয়েছি সে সমস্ত বিষয় আমার পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরছি। আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্ব অনুসারে যেভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করছি সেভাবে ক্রমানুসারে এখানেও আলোচনা করছি।
অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থনের ভিত্তি বা সার্পোট বেস। একটি ছাত্র আন্দোলনের ফলশ্রুতি আমাদের বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার। এই সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। তবে এটা সত্য শপথ গ্রহণের পর এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিরোধী ছোট বড় অনেক দলের সমর্থন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি রয়েছে, কোটা আন্দোলনকারীরা তো আছেনই। দিন যেতে রাজনৈতিক দলগুলি স্ব স্ব কর্মসূচী নিয়ে আগানোর বা স্বীয় এজেন্ডা অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে অর্জনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারে, তেমন অবস্থায় মতের অমিল হলে রাজনৈতিক দল বা দল সমূহ অন্তর্বর্তী সরকার থেকে ক্রমশ সমর্থন প্রত্যাহার করে নিজ নিজ পথে চলায় উদ্যোগী হবে। এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারকে তার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সামরিক বাহিনীর শরণাপন্ন হতে হবে। এটি বাস্তব সত্য এবং এ ধ্রুব সত্যকে বিবেচনায় রেখে অন্তর্বর্তী সরকারকে সামরিক বাহিনীর সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে পথ চলতে হবে। এই ভারসাম্য রক্ষা করা আমার দৃষ্টিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ।
দ্বিতীয়ত শিল্পমালিক এবং ব্যবসায়ীদের মাঝে আস্থা ফিরানো। ইতিমধ্যে কারণে অকারণে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় আগুন সন্ত্রাস চালানো হয়েছে। এতে বিশেষ করে পোশাক শিল্প মালিকদের অনেকের মাঝে এক ধরনের মনস্ত্তাত্ত্বিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এই অস্থিরতার পিছনে সম্ভাব্য কারণ, তারা বিদেশী ক্রেতাদের কাছ থেকে যে ডেলিভারি আদেশ পেয়েছেন তা সময়মত সরবরাহে সক্ষম হবেন কিনা। দ্বিতীয়ত বিরাজমান অস্থিরতার কারণে বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে ভবিষ্যৎ এ তৈরি পোশাক নিতে আগ্রহী হবে কিনা। এর বাইরেও অন্যান্য শিল্প মালিকদের অনেকের মাঝেও এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সার্বিকভাবে শিল্প মালিক শিল্প উদ্যোক্তাাদের মাঝে আস্থা ফিরানোও এই সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
তৃতীয়ত আইন শৃংঙ্খলা। ছাত্রদের আন্দোলন পরবর্তী সারাদেশে আইন শৃ্ঙ্খলার মারাত্মক অবনতি হয়েছে। দেশের থানাগুলি উচ্ছৃঙ্খল স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অগ্নি সংযোগের শিকারে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থায় পুলিশের মনোবলে তা যেমন বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে আবার একই সাথে থানাগুলির প্রশাসনিক, যেমন যানবাহন যোগাযোগ, অনেক ক্ষেত্রে দলিল দস্তাবেজ ও ধ্বংস হয়েছে। পুলিশের মনোবল ফিরানো এবং প্রশাসনিকভাবে তাদের সক্ষম করে তোলার কাজটিও এই সরকারকে সামলাতে হবে। একই ধরনের ঘটনায় দেশের নানা প্রান্তেও মানুষ সন্ত্রস্ত অবস্থায় বাস করছে। অগ্নিকাণ্ড এবং লুটপাটের শিকার মানুষের মাঝে আস্থা ফিরানো সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে ইতিমধ্যেই দাঁড়িয়েছে।
চতুর্থত অর্থনীতি। এ খাতে অধ্যাপক ইউনূসকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের অনেক আশা। এ প্রসঙ্গে আশার কারণ পাশ্চাত্যের সাথে তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার বিশেষ একটি সম্পর্ক র্স্বজন বিদিত। সেই সম্পর্কের সূত্রে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি ইতিবাচক ক্ষেত্রে বিচরণের সুযোগ পাবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশা। তবে চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিশেষ করে ব্যাংক খাত একেবারে ‘লডর বডর’ অবস্থায়। বাংলাদেশে ব্যাংক খাত অনেকটা ব্যক্তি বিশেষের আজ্ঞাবহ হিসেবে চলেছে। পরিচালকরা নিজেদের সামান্য পুঁিজ বিনিয়োগ করে লক্ষ লক্ষ মানুষের হাজার কোটি টাকা জামানতকে নিজেদের সম্পত্তি বিবেচনায় সমানে লুটপাট করেছে, সি পি ডি’র হিসাব অনুযায়ী এর পরিমাণ বিগত ১৫ বছরে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০১৭ সালে পূর্ববর্তী পরিচালনা পর্ষদ থেকে অনেকটা জোর পূর্বক অধিগ্রহণের পর দৈনিক প্রথম আলো’র ১৪ আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শুধু মাত্র এস আলম গ্রুপই ৫০,০০০ কোটি টাকা লোপাট করেছে। এরকম পাচার হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা এবং এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে ব্যাংক খাত তথা আর্থিক খাতকে সুশাসনের আওতায় আনা এই সরকারের জন্য ফরজ কাজ।
পঞ্চমত পররাষ্ট্রনীতি। ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র এই তিন বৃহৎ শক্তির বাংলাদেশকে ঘিরে ভূ–রাজনৈতিক স্বার্থ বিদ্যমান। তারা স্ব স্ব দৃষ্টিকোণ থেকে স্বীয় স্বার্থ সংহত করতে তৎপর হবে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারসাম্য রেখে অভিষ্ট লক্ষ্যে পথ চলা কম দুঃসাধ্য হবে না। এক্ষেত্রে তিস্তা, পূর্ব ভারতীয় রাজ্যসমূহের বিষয় আশয়, ইন্দো–প্যাসিফিক, বঙ্গোপসাগর ঘিরে নানা ভূ–রাজনীতিও এ সরকারের সামনে আসবে।
ইন্দোপ্যাসিফিকের ব্যাপারে সাম্প্রতিকের বাংলাদেশের অবস্থান কোন কোন পরাশক্তির পছন্দ নয় এটা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি। এ বিষয়টিও অন্তর্বর্তী সরকারকে মাথায় রাখতে হবে। এখানে আরো বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় পূর্ব ভারতীয় রাজ্যসমূহের বিষয়ে ভারত সব সময় বাংলাদেশের অবস্থানের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবে। কারণ সদূর অতীতে আমাদের র্পা্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চল নিয়ে দুটি দেশের অভিজ্ঞতা কারোর জন্যই সুখকর নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস ইতিমধ্যে একটি অত্যন্ত সদূর প্রসারী বক্তব্য প্রদান করেন। তার এই বক্তব্যের মূল কথা, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে সন্নিহিত অঞ্চল সমূহ তথা ভারতের পূর্বাঞ্চলেও সে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ সোজা কথায় আমার ঘরে আগুন লাগলে তুমি প্রতিবেশী তোমার ঘরও নিরাপদ থাকবে না।
ষষ্টত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ভারসাম্য বজায় রাখা। যেহেতু এ সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেহেতু সরকারকে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে, তবে তার অর্থ এই নয় সরকারকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে কোনো প্রকার ছাড় দিতে হবে। রাজনৈতিক দুর্র্বৃত্তায়নকে শক্ত হাতে দমন করা এ সরকারের সামনে সব সময় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস ইতিমধ্যেই একটি নীতি নির্ধারণীমূলক বক্তব্য রেখেছেন, তার বক্তব্যে তিনি বলেছেন ‘হিন্দুর অধিকার, মুসলমানের অধিকার চাইয়েন না, মানুষের অধিকার চান। আইন একটা। আইনের শাসন ঠিক হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে’।
এই যদি সরকারের মানসিক অবস্থা হয় তবে আমরা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ভারসাম্যের একটি নিশ্চয়তা পাই এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রেও।
রোহিঙ্গা সমস্যা। আমাদের সন্নিহিত মায়ানমারের রাখাইন স্টেট থেকে নির্মমভাবে বিতাড়িত হয়ে ১০ লক্ষের উপর রোহিঙ্গা প্রায় ৭ বছর আমাদের দেশের অভ্যন্তরে বসবাস করছে। রোহিঙ্গাদের এই অবস্থান আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি, পরিবেশ এবং অর্থনীতির উপর এক বিরাট হুমকি এবং চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। উল্লেখ্য মায়ানমারের রাখাইন অঞ্চলকে ঘিরে রয়েছে বৃহৎ শক্তিশালী দেশগুলির ভূ–রাজনীতি। এ ভূ–রাজনীতির কবলে পড়া রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আপাত দূরুহ কাজ হবে বলে মনে হয়। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সমস্যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি সমস্যা হয়ে থাকবে। স্বার্থান্বেষী যেকোনো পক্ষ রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধিতে সচেষ্ট হলে তাতে তেমন আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না। ঠিক একইভাবে অন্তর্বর্তী সরকার এ সমস্যা সমাধান করার কোনো ধরনের দ্বার উন্মোচন করার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে তা এ সরকারের জন্য ভবিষ্যৎ এ অর্জনের একটি মাইল ফলক হিসাবে বিবেচিত হবে।
র্পা্বত্য চট্টগ্রাম। সাম্প্রতিকের কুকি চিন এবং তারও আগের র্পা্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি, ইউনাটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইত্যাদি দলগুলির বিদ্রোহী তৎপরতা পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুল্লেখ্য হলেও এখনো বিদ্যমান আছে। কোনো পক্ষ ভূ–রাজনীতি মাথায় রেখে এ অঞ্চলে নতুন করে স্বার্থ হাসিলে উদ্যোগী হলে তা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য নতুন এবং অভাবনীয় এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে।
সংস্কার কর্মসূচী। র্স্বশেষে উল্লেখ করছি বলে এ বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং এটি এই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সব চেয়ে গুরুত্ববহ। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুতে কোটা আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্রমে তা আরো নানা বিষয় এমনকি শেষ পর্যন্ত তা রাষ্ট্রের নানা দিক সংস্কারের দাবীতে এসে উপনীত হয়। এর মধ্যে আমার কাছে র্ন্বিাচন কমিশন, বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিশ্ব–বিদ্যালয়গুলির সর্বোচ্চ পদে নিয়োগ দান ইত্যাদি বিষয়ে সংস্কার কর্মসূচী এবং এর বাস্তবায়ন বরাবরই এ সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে থাকবে বলে প্রতীয়মান। সবশেষে অবাধ গণতান্ত্রিক পরিবেশে একটি সুষ্ঠু র্ন্বিাচন আয়োজনের মাধ্যমে র্ন্বিাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তানন্তরই হবে এই সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।