প্রধানমন্ত্রীর ভারত–চীন সফর থিংক–দি আনথিংকেবল!
লেখার অনেক বিষয় এখন সামনে। হামাস–ইসরাইল যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব, হিজবুল্লাহ–ইসরাইল সংঘাতের মুখামুখি অবস্থান, যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টি’র বিপুল বিজয়, ইরানে সংস্কার পন্থী’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া, আমেরিকার র্ন্বিাচনী বৈতরণী পার হতে এক বুড়িকে আরেক বুড়ির চাচী শাশুড়ি ডাকা, মার্কিনীদের এক চীন নীতি থেকে ক্রমশ সরে এসে তিব্বত এবং তাইওয়ানে নানা উস্কানিমূলক তৎপরতা, ইউরোপে বিশেষ করে ফ্রান্সে ডান পন্থীদের উত্থান হতে হতে সবাইকে হতবাক করে বামদের বিজয় ইত্যাদি। এসব বিষয়কে একপাশে রেখে চীন, ভারত আর এ দুদেশের সাথে আমাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতাকে প্রাধান্য দিয়ে আজকের লেখা।
সম্প্রতি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরপর দুবার ভারতে রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন। একবার ভারতের নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, এটি ৯ জুন ২০২৪ এবং দ্বিতীয় বার পূর্ব নির্ধারিত রাষ্ট্রীয় সফর, এটি ২১–২২ জুন ২০২৪ এ অনুষ্ঠিত হয়। ৮ জুলাই থেকে ১১ জুলাই ২০২৪ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চীনে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পরপর ভারত এবং চীন সফর আমার কাছে এক বিশেষ বার্তাবাহক। উল্লেখিত দুটি দেশই জ্ঞান বিজ্ঞান, ইতিহাস–ঐতিহ্য, সভ্যতা–দর্শন, শিক্ষা–সংস্কৃতি ইত্যাদিতে বিশ্বে শীর্ষ স্থানীয়। বর্তমান অর্থনৈতিক অর্জন এবং অগ্রগতির মানদণ্ডেও দেশ দুটি একেবারে সম্মুখ সারিতে।
ভারতের যেমন বিশ্ব সভ্যতা সংস্কৃতিতে অবদান রাখার রয়েছেন কৌটিল্য, অশোক, বিবেকানন্দ, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ তেমনি চীনের রয়েছে সানজু, কনফুসিয়াস, লাওজি, জাঙ জাই, মাও ঝেদং। ভারতের যেমন আছে তাজমহল তেমনি চীনের রয়েছে মহা প্রাচীর। ভারত সেই আদি থেকে এখন পর্যন্ত যেমন তার সুর, সুবাস আর রং ছড়িয়েছে, যা থেকে অন্যরা সৃষ্টির উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা ধারণ করেছেন তেমনি চীনও কখনো কাগজ কখনো বারুদ আবিষ্কার করে বিশ্ব সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে নব নব দিগন্তে। এ দুটি দেশের সভ্যতা ক্রমবিকাশের মাধ্যমে বিশ্বকে করেছে ঋদ্ধ।
তবে একথাও সত্য বিংশ শতাব্দীর শেষ এবং এক বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এ দুটি দেশ নানা ধরনের ভূ–রাজনীতির জঠিলতার আবর্তে এখন ঘুর্ণায়মান। প্রায়ই দেশ দুটি এখন পরস্পরের মুখামুখি, এটি বন্ধুত্বের মেলবন্ধনের জন্য নয় শক্রতার রক্তচক্ষু ধারণ করে প্রতিশোধ স্পৃহায়।
আমাদের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে এ দুটি দেশের সাথে এ যাবত আমরা একটি অনুকরণীয় ভারসাম্য রক্ষা করে আসতে পেরেছি। এটি পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেমন সত্য তেমনি নানা আন্তর্জাতিক বিষয়ের ক্ষেত্রেও প্রণিধান যোগ্য।
এসব কিছু মনে রেখেও, এ দুটি দেশের সাথে আমাদের বেশ কিছু স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দীর্ঘদিন থেকে সমাধানের অপেক্ষায়।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২১–২২ জুন ভারত সফরের সময় দুদেশের মধ্যে ১০ টি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ গুলি হল, বাংলাদেশ–ভারত ডিজিটাল পার্টনারশিপ, ভারত–বাংলাদেশ গ্রিন পার্টনারশিপ, সমুদ্র সহযোগিতা ও সুনীল অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ও ওষুধ সংক্রান্ত পুরানো সমঝোতা নবায়ন, ভারতের ইন–স্পেস এবং টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা, দুই দেশের রেল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সংযোগ সংক্রান্ত সমঝোতা, সমুদ্রবিষয়ক গবেষণায় সমঝোতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে সমঝোতা এবং কৌশলগত ও অপারেশনাল খাতে সামরিক শিক্ষা সহযোগিতায় ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজ ওয়েলিংটন এবং মিরপুরের মধ্যে সমঝোতা।
এ সমঝোতা সমূহের কোথাও দীর্ঘ প্রতিক্ষিত তিস্তার বিষয়ে কোনও উল্লেখ নেই। আশ্চর্যের বিষয় হল আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফিরার পরদিনই পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তিস্তা সংক্রান্ত বিষয়ে সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে দীর্ঘ এক পত্রের মাধ্যমে তিস্তার জল নিয়ে কোনও ধরনের সমঝোতার ব্যাপারে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির চিঠির বিষয়টি তৃণমূল কংগ্রেস সদস্যরা ভারতীয় পার্লামেন্টে আলোচনার মাধ্যমে সেদেশের শাসন ব্যবস্থায় ফেডারেল স্পিরিটের বিষয়টিও উল্লেখ করেন এবং এ ব্যাপারে তাদের রাজ্যের আপত্তির বিষয়টির পুনঃরাবৃত্তি করেন। তিস্তার ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়িয়েছে তা হল, বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ভারত একটি বিশেষজ্ঞ/কারিগরী টিম পাঠাবে। এর সারমর্ম হল তিস্তার ব্যাপারটি অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে গেল। কৌশলগত এবং অপারেশনাল বিষয়ে সামরিক সহযোগিতার বিষয়টি দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে এটি নিশ্চিত চীনের দিক থেকে এটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হবে না। ভূ–রাজনীতি এবং ভূ–কৌশলের জটিল কঠিন পথে এখন বাংলাদেশকে চলতে হচ্ছে এব্যাপারে সন্দেহের এখন আর কোনও অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ চীন–ভারতের বর্তমান সম্পর্কের বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থান। চীনকে ঘিরে পাশ্চাত্য ভূ–রাজনীতি এবং কৌশলে নানা জটিলতার সৃষ্টিতে মগ্ন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভারতও স্বীয় স্বার্থে এসব উদ্যোগে জড়িয়ে পড়েছে। যেমন ইন্দো–প্যাসিপিককে ঘিরে ‘কোয়াড’এ, দক্ষিণ চীন সাগরকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীনের সাথে অনেকটা মুখোমুখি উদ্যোগে ভারতের অংশগ্রহণ, সাম্প্রতিকের আমেরিকান সিনেটে পাশ হওয়া ‘প্রমোটিং এ্যা রেজুলেশান টু দি তিব্বত চায়না ডিসপিউট এ্যাক্ট’ ইত্যাদিতে ভারতের উৎসাহ প্রদান। কারণ ‘প্রমোটিং এ্যা রেজুলেশান টু দি তিব্বত চায়না ডিসপিউট এ্যাক্ট’ পাশ হওয়ার পর আমেরিকান সিনেটের সাবেক স্পিকার ন্যানসি পেলোসির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামার সাথে সাক্ষাৎ করেন পরে এই প্রতিনিধি দলটি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী’র সাথেও সাক্ষাৎ করেন। এ থেকে আমেরিকা যে তার পূর্বের ঘোষিত এক চীন নীতি থেকে সযত্নে সরে যাওয়ার পথ বের করতে সচেষ্ট হয়েছে তা চীনের বুঝতে বাকী থাকার কথা নয় একই সাথে ভারতও যে এ উদ্যোগে সায় দিচ্ছে তা চীন ধরে নিয়েছে হয়ত। এরই ফলশ্রুতি ভারত–চীনের সম্পর্ক দিনে দিনে জটিল থেকে জটিলতর রূপ ধারণ করছে। অরুণাচলের বিশাল এলাকা চীনের দখল করে নেওয়া, সাম্প্রতিকের পুরা অরুণাচলকে চীন কর্তৃক প্রচারিত মানচিত্রে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দেখানো, ডোখলাম’এর সংঘর্ষ ইত্যাদি তারই প্রকাশ।
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন চীন সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তখন রাশিয়া সফরে। ২০২১ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারত সফর করেন। সেই থেকে ফিরতি সফর হিসাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরে যাওয়া কূটনৈতিক রীতি অনুযায়ী অপেক্ষমাণ। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং পাশ্চাত্যের বিশেষ করে আমেরিকা’র রাশিয়ার উপর আরোপিত কঠোর নিষেধাজ্ঞার ফলাফল পর্যবেক্ষণে ভারত সময় নেয়। দেখা গেল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাশিয়া না একঘরে হয়েছে না অর্থনৈতিক ভাবে কাবু হয়েছে। বরং ব্লুমবার্গ এবং সি এন এন’এর হিসাব অনুযায়ী ২০২৪ এর জুন মাসেই জ্বালানী এবং গ্যাস থেকে রাশিয়া রিভিনিউ আয় করেছে ৯.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পূর্ববর্তী বছরের একই সময় থেকে ৫০% বেশি।
ইতিমধ্যে কূটনৈতিক মহলে কিছুটা হলেও ধারণা জন্মে ভারত পাশ্চত্যাভিমুখি হয়েছে। এটি ভারতীয় নীতি নির্ধারকরাও অনুধাবন করেছেন হয়ত। অনুমিত হয় এরই ফলশ্রুতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান রাশিয়া সফর। শ্রী নরেন্দ্র মোদি’র এই সফরে ভারত স্পষ্টতই তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে। এর একটি প্রচলিত বাজার মূল্য থেকে কম দামে দীর্ঘ মেয়াদি জ্বালানী সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, চীনের সাথে দ্বন্দ্বে রাশিয়ার সরব সমর্থন না পেলেও নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা এবং প্রমাণ করা ভারত পাশ্চাত্যের দিকে পুরাপুরি ঝুঁকে পড়েনি। এমন জটিলতার আবর্তে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর। চীনের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক চাওয়া–পাওয়ার বিষয় যেমন রয়েছে তেমনি ভূ–রাজনীতির কিছু বিষয়ও আছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মায়ানমারের রাখাইন অঞ্চলকে ঘিরে এখন চীন– ভারত ভূ–রাজনীতির খেলায় মত্ত। এ ভূ–রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে ভূ–অর্থনীতি ঘিরে। ভূ–অর্থনীতির কেন্দ্রে রয়েছে ভারতের ‘কালাদান মাল্টি মোডাল মাল্টি ট্রানজিট প্রজেক্ট’ এবং চীনের ‘মায়ানমার–চায়না ইকনমিক কড়িডোর’ এবং ‘চকপিউ ডিপ সী পোর্ট’।
রোহিঙ্গা আগত অঞ্চল রাখাইন এখন মায়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। রোহিঙ্গাদের এ প্রেক্ষাপটে প্রত্যাবাসন করতে হলে রাখাইনে স্থিতিশীলতা অত্যাবশ্যক। চীন তার ভূ– কৌশলগত কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হলে রোহিঙ্গা সমস্যায় হয়ত উদ্যোগী হবে নয়ত নয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে চীনকে কতটুকু আস্থায় আনতে পারেন তা এ সফর শেষে অনুমান করা যাবে। তবে ভারত– বাংলাদেশ সম্পর্ক এখানেও অবিবেচ্য থাকবে না।
তিস্তার বিষয়টি হয়ত এবার চীনেও অনালোচিত। এটি বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্বে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে। এ বিষয়টির একটি সমাধানে আসা গেলে তা ভারত–বাংলাদেশের বিদ্যমান একটি দীর্ঘ বিষয়ের সমাধানের মাধ্যমে দু দেশের সম্পর্কের একটি বিষপোড়া বিদূরিত হত।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী চীনের প্রেসিডেন্ট শি পিং এর বেল্ট রোড ইনেসিয়েটিভ এর বাইরে আরো উদ্যোগে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নিয়েছিল। এর একটি ‘জি ডি আই’ অপরটি ‘জি এস আই’। প্রথমটি গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ দ্বিতীয়টি গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ। বাংলাদেশ সঙ্গত কারণে ‘জি এস আই’ তে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কিন্ত্তু দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করেও ‘জি ডি আই’এও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ বিষয়টি বাংলাদেশের ব্যাপারে চীনকে তেমন ইতিবাচক বার্তা দেবে বলে মনে হয় না।
এ লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম ভারত–চীন জটিল ভূ–রাজনীতির আর্বতে। আমাদের এই দু’দেশের সাথেই স্বার্থ বিদ্যমান। এমন পরিস্থিতিতে কিশোর মাহবুবানির বই ‘হ্যাজ চায়না ওয়ান?’ এর এক জায়গায় পড়া একটি বাক্য এখানে তুলে ধরতে চাই, তিনি উল্লেখ করেছেন, দীর্ঘ মেয়াদি কৌশল প্রণয়ন করতে অনেক সময় ‘থিংক দি আনথিংকবল’ অর্থাৎ অচিন্তনীয়কে চিন্তায় স্থান দিতে হয়। এ কথাটি মনে রেখে ভাবছি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি তার প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা নিয়ে আমাদের দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে পারেন না তাহলে আমাদের টানাপোড়নের সমস্যারও সমাধান হয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।