গল্ফ মাঠে খেলার সময় আমার এক গল্ফ পার্টনার আমাকে প্রসঙ্গক্রমে একটি গল্প শুনিয়েছিলেন। সেই গল্প আমার এ লেখার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে বলে শুনা সেই গল্প দিয়ে এ লেখাটি শুরু করছি। গল্প হল ‘পথের উপর সিংহ মামা বসে আছেন, আর ঐ পথ দিয়েই খরগোশকে তার বাড়ি যাওয়ার পথ পাড়ি দিতে হবে। পিছু হঠারও কোনও উপায় নাই, এরই মাঝে সিংহ মামা খরগোশকে দেখে ফেলেছে। এখন সিংহের হাত থেকে বাঁচার উপায় কী? একটু ভেবে নিয়ে খরগোশ একটি উপায় বের করে। সেই উপায় হল সিংহ মামাকে সম্মান দেখাতে দেখাতে কোনও রকমে প্রাণ নিয়ে পথ পাড়ি দেওয়া। মামা সালামু আলাইকুম, মামা সালামু আলাইকুম, মামা সালামুআলাইকুম এভাবে বিনয় আর সম্ভাষণ জানাতে জানাতে খরগোশ সিংহ মামার সামনে দিয়ে পথ প্রায় পাড় হয়ে যায় যায়, তখন সিংহ খরগোশকে উদ্দেশ্য করে বলে কেন এত সালাম? কেন এত বিনয়? আমার ত সেই দাঁতও নাই থাবাতেও আগের সেই জোর নাই! এবার খরগোশ ঘুরে দাঁড়ায় বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে তা হলে হারামজাদা এতক্ষণ আমার পথের উপর বসে থেকে আমাকে এভাবে ভয় দেখালি কেন?
আমার মনে হয় বিশ্বের সচেতন মানুষদের এখন জাতিসংঘের ব্যাপারে গল্পের সিংহ মামার মত কিছু একটা ভাবার সময় বোধহয় চলে এসেছে।
প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ্বের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষকারী মানব জাতি ভবিষ্যতে এধরনের নৃশংসতা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে উঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে এসে সে সময়ের মানুষেরা দেখেছে নাগাসাকি হিরোসিমার নিরাপরাধ মানুষেরা কীভাবে পারমানবিক বোমার প্রচণ্ড বিস্ফোরণের লেলিহান শিখায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়েছে। মানুষেরা দেখেছে আধিপত্য বিস্তারে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ কীভাবে একের পর এক জনপদ নিশ্চিহ্ন করেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল সানফ্রান্সিসকোয় বিশ্বের ৫০ জাতি একটি আলোচনা বৈঠকে মিলিত হয়। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল ২৫ জুন ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা পত্র বা চ্যার্টার্ড গৃহীত হয়। এরই সূত্র ধরে ২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ যাত্রা শুরু করে। এরই মাঝে ৬ এবং ৯ আগস্ট ১৯৪৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের নাগাসাকি এবং হিরোসিমায় পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করে। এ নিদারুণ বোমার শিকারে পরিণত হয়ে জাপানের প্রায় আড়াই লক্ষ বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। জাতিসংঘ তার যাত্রারম্ভের এই নির্মমতার, মানব সভ্যতার প্রতি এই হুমকি আর বর্বরতার বিরুদ্ধে শাস্তি হিসাবে কোনও ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণে নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
এই ব্যর্থতার পিছনের কারণ জাতিসংঘ তার আঁতুর ঘরেই নিজেকে বিকলাঙ্গ করে ফেলে। এ বিকলাঙ্গতার নাম ‘ভেটো পাওয়ার’। পাঁচটি পরাশক্তি জাতিসংঘের যাত্রারম্ভে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ভেটো নামক এই মারণাস্ত্রটি নিজেদের করে নেয়। ‘ভেটো’র বলে ভেটোধারী দেশ দুনিয়ার সবদেশ একদিকে গেলেও একটি ভেটো’য় তাদের সব আয়োজন মতামত, মূল্যহীন করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। একটি হাত উঠলে একশ হাতের আর কোনও মূল্য নাই।
এটা বিশ্ববাসী একবার নয় বহুবার প্রত্যক্ষ করেছে। জাতিসংঘের জন্ম লগ্নতেই বিশ্ব দেখেছে প্যালেস্টাইন থেকে লক্ষ প্যালেস্টাইনীকে উদ্বাস্ত্তু করা হয়েছে। সেই থেকে তারা এখনও উদ্বাস্ত্তু। প্যালেস্টাইনের একটি প্রজন্ম উদ্বাস্ত্তু হিসাবে ইতিমধ্যেই জীবন সায়াহ্নে। এদের সামনে জাতিসংঘ কখনো আশা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি না তখন না এখন। ইতিমধ্যে গাজায় ছত্রিশ হাজার নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এই ছত্রিশ হাজারের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিশু। গাজায় ইসরাইল অবরোধের মাধ্যমে, খাদ্য সরবরা্হ বন্ধ করে লক্ষ মানুষকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি ধ্বংস করে সেখানে অন্ধকার বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে, হসপিটালের উপর বোমা বর্ষণের মাধ্যমে গাজার চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করেছে, আশি ভাগ বাসস্থান ধ্বংসস্ত্তুপে পরিণত হয়েছে, নির্বিচার বোমাবর্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নিশ্চিহ্ন করে গাজার ছাত্র–ছাত্রীদের শিক্ষা বঞ্চিত করার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে, বিশ্ববাসীর সামনে গাজায় ইসরাইলী সৈন্যরা দিনের পর দিন গণহত্যা সংগঠনে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। গাজার উপর অবিরাম–নির্বিচার বোমাবর্ষণ সারা বিশ্ব দেখেছে অসহায় দৃষ্টিতে। জাতিসংঘ সেখানে কার্যকর কোনও ভূমিকাই রাখতে পারেনি।
১ এপ্রিল ২০২৪ ইসরাইল দামেস্কস্থ ইরানী দূতাবাস আক্রমণ করে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক সমস্ত রীতি নীতির উপর একেবারে চপেটাঘাত। ইরান বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয় এমনকি ঘটনাটির নিন্দাও জানায়নি। অথচ জাতিসংঘ সনদের ৫১ ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে ‘Article 51 of the Charter thus recognizes the existence of an inherent right of self defence in the case of an armed attck by one State against another State’ জাতিসংঘ সনদ ৫১ ধারা বলে কোনও একটি দেশ কর্তৃক অন্য একটি দেশ সামরিক আক্রমণের শিকারে পরিণত হলে তবে আক্রান্ত দেশ স্বভাজাতভাবেই প্রতি আক্রমণের অধিকার সংরক্ষণ করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরে অন্য একটি দেশের এবং আরো একটি সার্বভৌম দেশের কূটনৈতিক মিশনে সামরিক অভিযান পরিচালনায় নিন্দা জানাতে ব্যর্থতা শুধু জাতিসংঘের অকর্মন্যকেই তুলে ধরেনি বরং আক্রান্ত দেশকে প্রতিক্রিয়া এবং প্রতি আক্রমণ চালাতেও বাধ্য করে। এরই ফলশ্রুতি ছিল ১৩ জুনের ইরান কর্তৃক ইসরাইলে ব্যাপক ড্রোন এবং মিসাইল হামলা।
সাউথ আফ্রিকার আবেদনের প্রেক্ষাপটে আই সি জে বা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস, (এ আদালত জাতিসংঘ কর্তৃক রাষ্ট্রের বিচার করার ম্যান্ডেট প্রাপ্ত) দীর্ঘ শুনানির পর ২৪ মে ২০২৪ এক রায়ে ইসরাইলকে অবিলম্বে গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় চলমান যুদ্ধাভিযান বন্ধ এবং সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার নির্দেশ প্রদান করে। এই আদেশের প্রতি ইসরাইল সামান্যতম ভুলক্রুটিও না করে বরং রাফাতে হামলা জোরদার করে। এমনকি আশ্রয় নেওয়া নিরুপায় সাধারণ মানুষদের তাবুতে হামলা করে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। জাতিসংঘ তার সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায়কে কীভাবে ভুলুণ্ঠিত করা হল তা অক্ষমের দৃষ্টিতে শুধু অবলোকন করেছে।
আই সি সি বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট, (এ আদালত জাতিসংঘ কর্তৃক ব্যক্তির বিচার করার ম্যান্ডেট প্রাপ্ত) ২০ মে ২৪ আই সি সি তার ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসাবে এক আবেদনে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়াউভ গ্যালান্ট এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির জন্য আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকদের প্রতি আবেদন জানায়।
আবেদনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌশলী করিম খান নির্বিচার নিরাপরাধ মানুষ হত্যা, খাদ্যকে মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা, গণহত্যার মত অপরাধে সম্পৃক্ততার অপরাধে তাদের শাস্তির আওতায় আনার নিমিত্তে এই গ্রেফতারি পরওয়ানার আবেদন জানান।
করিম খান অপর এক আবেদনে হামাস প্রধান এয়াহিয়া সিনওয়ার, সামরিক প্রধান মোম্মদ দায়েফ, রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়ার বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরওয়ানার আবেদন জানান। এদের বিরুদ্ধে করিম খান হত্যা মানুষকে জিম্মিকরণ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করার অভিযোগ এনেছেন।
আই সি সি’র এ পদক্ষেপে ইসরাইল তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। তবে ইসরাইল থেকেও আমেরিকার প্রতিক্রিয়া ছিল আরো লক্ষ্যণীয়। তারা ‘আই সি সি’ কে নিষিদ্ধ করার কথা উল্লেখ করে এবং ‘সন্ত্রাসী সংগঠন হামাস এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইসরাইল’ কে একই পাল্লায় মাপা হয়েছে বলে ‘আই সি সি’ বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে। অথচ নির্মম পরিহাস এই কয়েক মাস আগে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে আই সি সি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে আমেরিকা তাকে বিপুলভাবে স্বাগত জানায়। লক্ষ্যণীয় উভয়ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা অনুল্লেখ্য।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এখনও প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গার বসবাস। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে নিপীড়ন, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, বাড়িঘর হারা এইসব মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। রোহিঙ্গারা কোনও যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না। তাদের জাতিগত পরিচয়ই তাদের একমাত্র অপরাধ। বি বি সি’র সাংবাদিক রবার্ট ফনিয়া যাদের দুর্দশার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন ‘রোহিঙ্গারা এমন এক হতভাগ্য জাতি গোষ্ঠী, যারা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত, যেখানে আশ্রিত সেখানেও অনাকাঙ্ক্ষিত। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ব্যাপারেও চরম ব্যর্থ। ‘ভেটো’ জাতিসংঘকে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারেও কোনও দৃশ্যমান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ করেছে।
অন্যান্য দেশের মত প্রতিবছর বাৎসরিক বনভোজনে যাওয়ার মত আমাদের দেশ থেকেও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য বিরাট এক দল নিউইর্য়কে গমন করেন। জাতিসংঘে মাসব্যাপী বক্তৃতা পর্ব চলে। দেখা যায় কম গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির বক্তৃতার সময় হল ফাঁকা, কেউ কেউ থাকলেও অনেকেই ঘুমকাতুরে থাকেন। অনেক কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচান্তে আমাদের মত দেশগুলির বিরাট প্রতিনিধি দলের বহর দেশে ফিরেন তেমন কিছু অর্জন ছাড়া।
জাতিসংঘ নামক ‘ভেটো’দের এই ক্লাবকে এখন আমূল পরিবর্তনের দাবী তুলতে হবে। সেটি বাংলাদেশের মত ভূক্তভোগি দেশগুলি থেকে হতে পারে। না হয় প্যালেস্টাইন, আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার অসহায় মানুষেরা মরবে, তাদের সম্পদ অকাতরে লুঠ হবে আর জাতিসংঘ একেকটি বিবৃতি পাঠ করে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাবে।
লেখক : প্রবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।