সমকালের দর্পণ

ভারতীয় নির্বাচন কী বার্তা দিল

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ৯ জুন, ২০২৪ at ৮:৪২ পূর্বাহ্ণ

ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ এবং আমাদের নিকট প্রতিবেশী। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিলে ভারতীয় নির্বাচন আমাদের সাধারণ মানুষের জন্য অনেক ঔৎসুক্যের।

ভারতীয় লোকসভায় মোট আসন সংখ্যা ৫৪৩। এই ৫৪৩ আসনের মাঝে নিম্নবর্ণ তথা সিডিউল কাস্টদের জন্য ৮৪ এবং উপজাতীয়দের জন্য ৪৭ টি আসন সংরক্ষিত।

ভারতীয় লোকসভার ১৮ তম নির্বাচন ১৯ এপ্রিল ২০২৪ শুরু হয়। মোট ৭ টি পর্যায়ে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে ১ জুন এ নির্বাচন সমাপ্ত হয়। ৪ জুন ২৪ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়।

উত্তর প্রদেশ ৮৪ টি আসন নিয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী রাজ্য। জন সংখ্যানুপাতে ১ আসনধারী যেমন মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ইত্যাদির মত অনেকগুলি ছোট ছোট রাজ্য বা অঞ্চলও রয়েছে। আমাদের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের আসন সংখ্যা ৪২।

দু একটি ছোটখাট ঘটনা বাদ দিলে ভারতীয় লোকসভা নির্বাচন নিঃসন্দেহে সুষ্ঠু হয়েছে, এখানে মানুষ অবাধে এবং নির্বিঘ্নে তার মতামত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছে। এ সুযোগ পাওয়ার কারণে মানুষের অভিমত মানুষ প্রকাশ করেছে। এ প্রকাশের ধরন যদি বিশ্নেষণ বা ব্যাখ্যা করতে যাই তবে প্রথমেই পশ্চিমবঙ্গ এবং মমতা ব্যানার্জির কথা আলোচনা করতে হবে।

মমতা ব্যানার্জি স্বাতন্ত্র আর সর্বভারতীয় কাঠামোয় পশ্চিমবঙ্গ’কে বরাবরই একটি আলাদা মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছেন। যেমন এনআরসি’র যাতাকলে পড়ে আসামের বাঙালি জনগোষ্ঠী তথা আসামের সাধারণ মানুষ যখন অসহায়ত্বের একেবারে খাদের কিনারে তখন মমতা ব্যানার্জি সেই সব খেটে খাওয়া ক্ষুদ্র চাষী, চা বাগানের শ্রমিক, দিন মজুর, খনি শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে প্রবল প্রতিবাদে উচ্চকণ্ঠ হন। বৃটিশ সাম্রজ্যবাদ সৃষ্ট ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভক্তি বিবাদ এবং বিচারের বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জির রুখে দাঁড়ানো ভারতের মানুষ শ্রদ্ধাভরে অবলোকন করেছে। এর বাইরে সাধারণ মানুষের জন্য তার নানা প্রকল্প সেটি শিক্ষার ক্ষেত্রে, উপার্জনের ক্ষেত্রে, চিকিৎসার ক্ষেত্রে, গৃহ নির্মাণ সবখানেই গণমানুষের হৃদয় ছুঁেয়ছে। এরই ফল ‘বি জে পি’ ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতিকে ভোটারদের প্রত্যাখ্যান। বি জে পি যেখানে উগ্র ধর্মীয় শ্লোগান তুলেছে ‘জয় শ্রী রাম’ বলে সেখানে মমতা’র দল তৃণমূল কংগ্রেস জাতীয়তাবাদের শ্লোগান তুলেছে ‘জয় বাংলা’ বলে। পশ্চিম বাংলার মানূষ উগ্র ধর্মান্ধতাকে পরিহার করে ভোট দিয়েছে তৃণমূল তথা মমতা ব্যনার্জিকে।

ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির একই পরিণাম হয়েছে ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশে। এখানে যোগি আদিত্য নাথের নেতৃত্বে রাজ্যে বিজেপি সরকার। অনেকেই যোগীর গেরুয়া রঙের পরিধান আচার আচরণ দেখে তাকে শ্রী নরেন্দ্র মোদির উত্তর সুরি ভাবা শুরু করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিকের একটি ঘটনা পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি। একটি সেমিনারে যোগদান শেষে ফেরত আসতে মুম্বাই এয়ারপোর্টে পৌঁছে হাতে সময় থাকাতে আমি একটি বইয়ের দোকানে প্রবেশ করি। বহু দিন ধরে খুঁজে না পাওয়া ‘দি হাউজ অব নাগাজ’ বইটির সন্ধান করতে দেখি ‘দি নাগাজ’ আমার চোখের সামনে । দেরি না করে বইটি কিনে লাউঞ্জে আসি। বইয়ের পাতা উল্টিয়ে আমার চোখ চড়ক গাছ। এ নাগা ত সে নাগা নয়। এ নাগারা হিমালয়ের পাদদেশের আজীবন নাঙ্গা বাবারা। নাঙ্গা সন্ন্যাসীদের সেসব নাঙ্গা ছবি দেখে লজ্জা রাখার জায়গা না পেয়ে আবার বইয়ের দোকানে যাই। অনেক বলে, বুঝিয়ে সুজিয়ে সেইলস ম্যানকে রাজি করাই বই বদলের। টি জে এস এর ‘দি ডিজম্যান্টলিং অব ইন্ডিয়া’ বইটি নিই। লাইঞ্জে ফিরে পড়তে বসি। পঁয়ত্রিশ এপিসোডের এ বইয়ের চার নাম্বার এপিসোডে আমার চোখ স্থির হয় ‘নাথু রাম গডসে মার্ডার এস ডিউটি’। পড়তে পড়তে আমি বিস্মিত হয়ে জানি ২০১৫ সালে হিন্দু মহাসভা গডসে কে নিয়ে ছবি রিলিজ করেছে যার নাম ‘দেশ ভক্ত গডসে’ শুধু তাই নয় মিরাটে মহাত্বা গান্ধীর জন্ম দিনে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্য নাথ উদ্বোধন করেছেন ‘গডসে টেম্পল’ এই সূত্রে বহু হিন্দু মন্দিরকে গডসে টেম্পল বলে নাম পরির্বতন করা হয়েছে। গান্ধীর অনেক মূর্তি ভাঙা হয়েছে, এমনকি কোন কোনটির গায়ে ট্রেইটর” কথাও লেখে দেওয়া হয়েছে। মহাত্বা গান্ধীর প্রতি এই অবজ্ঞা এই অপমান উত্তর প্রদেশের ভোটাররা সহজভাবে নেয়নি বলেই মনে হয় উত্তর প্রদেশের ভোটাররা বি জে পি’র দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছেন।

এরই পরিণতি যোগী আদিত্য নাথের দোর্দণ্ড প্রতাপ শাসনের মাঝে প্রয়াত মোলায়ম সিং যাদবের ছেলে শ্রী অখিলেশ যাদব শুধু জিতেননি সারা ভারতকে স্তম্ভিত করে উত্তর প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অকিলেশ বি জে পি’র কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন। অখিলেশ যাদবের এই জয়ের পিছনের কারণ কী? এ প্রশ্নের কারণ খুঁজতে গিয়ে যে কেউ একটু গভীরে গিয়ে দেখলে দেখবেন ঐ একই ঘটনা ধর্মের দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘু, নিম্নবর্ণ মানুষদের প্রতি অবজ্ঞা, নির্যাতন, নিপীড়ন, গো মাংস ভক্ষণের অজুহাতে অসহায় মানুষকে লিনচিং তথা টেনে হেঁচড়ে মেরে ফেলা ইত্যাদি সাধারণ মানুষ ইতিবাচক হিসেবে দেখেনি। ফল বি জে পি’র ভরাডুবি।

ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ভারতের সাধারণ ভোটারর এবার রুখে দাঁড়িয়েছে দারুণভাবে। এবং এটার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাবরী মসজিদ ভেঙে অযোধ্যার যে ফয়জাবাদে রাম মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে বি জে পি’ প্রার্থীর পরাজয়।

ভারতীয় জনতা পার্টির প্রচার প্রচারণা ইত্যাদির মধ্যমনি নিঃসন্দেহে শ্রী নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচনের ডামাঢোলে তিনি একসময় ঘোষণা করেন তিনি মানুষ নন ভগবানের পুত্র। এটিও সাধারণ ভোটাররা ভালোভাবে নিয়েছেন বলে মনে হয় না।

একসময় শ্রী জরহর লাল নেহেরু তার দলের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিলেন, অটল বিহারী বাজপেয়ী’র ক্ষেত্রেও প্রায় তাই হয়েছিল। একই ঘটনা হালে শ্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষেত্রেও হয়েছে। কিন্ত্তু পার্থক্য হল জরহর লাল নেহেরু বা অটল বিহারী বাজপেয়ী নিজেকে কখনোও দলের ঊর্ধ্বে ভাবেননি। কিন্ত্তু শ্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেকে দলেরও ঊর্ধ্বে ভাবতে গিয়ে নিজেকে ঐশ্বিরিক ভাবতে শুরু করে তার ঘোষণাও দিয়ে বসেন। এটিও সাধারণ মানুষ তথা ভোটাররা ইতিবাচক হিসাবে নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয় না। বাবরি মসজিদ ভেঙে ঐ একই স্থানে রাম মন্দির নির্মাণ ইত্যাদিও ভারতীয় ভোটারদের মাঝে খুব একটা অনুকূল প্রভাব বিস্তারে শ্রী মোদি সক্ষম হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয় না।

বরং এভারের ভোট দেখে মনে হয় ভারতীয় ভোটাররা ভিতরে ভিতরে বি জে পি’কে অভিসম্পাতই করেছেন। এর কারণ মানুষে মানুষে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্তি, এন আর সি’র মত অমানবিক আইন কার্যকরণে এবং অন্যান্য রাজ্যেও তা প্রচলনের ঘোষণা ইত্যাদি। অন্যদিকে কংগ্রেসের মধ্যমনি শ্রী রাহুল গান্ধীকে সংসদ থেকে বহিষ্কারে তার প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি, সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে রাহুল গান্ধীর ভারত জোড় পদ যাত্রায় মানুষের প্রতি মানুষের ভাতৃত্ববোধ ভালোবাসা, ধর্মীয় হিংসা বিদ্বেষ নয় মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আয় বৈষম্যের অবসান ঘটানোর কথা জোরালোভাবে তুলে ধরে তিনি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন বলে মনে হয়।

রাহুল গান্ধীকে মোদি সরকারের দেওয়া কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী দেখেও আমাদের অনেক কিছু শিখার আছে বলে আমার মনে হয়েছে। যাদের দেখার তারা দেখলেই হল।

রবিবার ৯ জুন ২৪ শ্রী নরেন্দ্র মোদি রেকর্ড তৃতীয়বার পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেবেন, তবে একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে নয়, এন ডি এ জোটের নেতা হিসাবে। নরেন্দ্র মোদি নিঃশ্চিতভাবে জানেন তার আগের অবস্থান তিনি হারিয়েছেন।

এ জোটে দুই ঘাঘু রাজনীতিক বিহারের নীতিশ কুমার এবং অন্ধ্রের চন্দ্র বাবু নাইডু ভবিষ্যৎ এ কেমন আচরণ করেন তার উপর মোদি সরকারের ভভিষ্যৎ নির্ভর করবে। কারণ শ্রী নরেন্দ্র মোদি এখন ‘ফ্রম মেজরিটি টু মার্চি’। এটাও পথ চলতে শ্রী নরেন্দ্র মোদিকে মনে রাখতে হবে, পূর্ববর্তী নির্বাচন থেকে তার জোটের আসন নেমে এসেছে ৩৬০ থেকে ২৯৩ এ। আর কংগ্রেস জোটের আসন ১১০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৩৪।

শেষ কথা ভারতীয় ভোটাররা তাদের ভোটের মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে তা হল বিভক্তি নয় ঐক্য সহমর্মিতা, হানাহানি নয় সকল ধর্ম বর্ণ গোত্রের মেল বন্ধনের মাঝেই ভারতের ভবিষ্যৎ।

লেখক: সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে