সভ্য সমাজ বিনির্মাণে গোলামী যুগের কিছু কিছু আইন সংস্কার অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের বিতর্কিত ৪৯৭ ধারাটি এদেশের প্রতিটি ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের নৈতিক আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা এখানে ব্যভিচারীনি নারীকে ছাড় দেয়া হয়েছে। যা নারীর সম্মান, আত্নমর্যাদা ও নৈতিক অবস্থানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ধারাটি বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সমতার বিধান পরিপন্থী ও লিঙ্গ বৈষম্যের শামিল। এতে নারী ও পুরুষকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। যা একজন নারীর জন্য অপমানজনক। এটা সংশোধন প্রয়োজন। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানের দেশ হিসাবে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের স্বাভাবিক নৈতিকতা বিবর্জিত উক্ত ধারাটি এদেশের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত, বৈষম্যমূলক, অচল, ক্ষতিকর ও বাতিলযোগ্য । দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারাটিতে পরকিয়া প্রেমের ও অবাধ ব্যভিচারের প্রকাশ্য লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। ইংরেজ শাসিত গোলামী যুগের এ আইনটি পাকিস্তান সরকার বহাল রাখে। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশের পরও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারও এ আইনটি অদ্যাবধি বহাল রেখেছে। আমাদের সমাজের নৈতিক ভীতকে পঙ্গু করে দেয়ার লক্ষ্যে লর্ড ম্যাকেলের পরামর্শে বৃটিশ সরকার সাধারণ নৈতিকতা পরিপন্থী এ আইনকে এখানে চালু করে যায়। ফলে আমাদের সমাজের পারিবারিক বন্ধন ও নৈতিকতার ভীত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। উক্ত আইনের বিধান মতে যদি কোন ব্যক্তি অন্য কোনো লোকের স্ত্রী বলে জেনে উক্ত ব্যক্তির (স্বামীর) সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করে (যা নারী ধর্ষণ নয়) তাহলে সঙ্গমকারী ব্যক্তি ব্যভিচারী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হবেন এবং তার অনূর্ধ্ব ০৫ (পাঁচ) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। অনুরূপক্ষেত্রে বিবাহিতা স্ত্রী লোকটি দুষ্কর্মে সহায়তাকারিনী হিসেবে অপরাধী হবেন না। এভাবে উক্ত আইন দ্বারা বিবাহিত স্ত্রী লোকদের স্বামী ছাড়া অপর ব্যক্তির সাথে অবাধ যৌনাচারের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে মাত্র। এখানে ব্যভিচারী নারীকে শাস্তির বিধান থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে যা এদেশের সাড়ে ১৭ কোটি মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসহ সাধারণ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইসলাম ধর্মে জেনাকারী নারী- পুরুষ উভয়েই সমান অপরাধে অপরাধী। ব্যভিচার স্বামীর সম্মতিতে হোক আর অসম্মতিতেই হোক ব্যভিচারী নারী পুরুষ উভয়েই সমান শাস্তির বিধান আমাদের দণ্ডবিধিতে নেই। এখানে শুধু ব্যভিচারী পুরুষের শাস্তির বিধান রয়েছে। এতে বিবাহিতা নারীকে ব্যভিচার তথা পরকিয়া প্রেমে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে মাত্র। একজন ন্যায়বিচার প্রত্যাশী আইনজীবী হিসেবে শরীয়ত বিরোধী এ জঘন্য বিধানের পাপিষ্ট থাবা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে বর্তমান সরকারের নিকট উদাত্ত আহ্বান জানাতে এই আইন সমালোচনার অবতারণা। কেননা উক্ত আইনকে ভিত্তি করে ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিভিশনের প্রায় প্রতিটি নাটকে পরকিয়া প্রেমের বিরক্তিকর কাসুন্দি গেয়ে ব্যভিচারে উদ্বুদ্ধ করে সমাজকে ধ্বংস করতে অশুভ শক্তি সর্বদা তৎপর। স্ত্রী- স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে ‘লীভ টুগেদার’ করাকে কেউ কেউ নারী পুরুষের মৌলিক অধিকার বলার দুঃসাহসও প্রদর্শন করেছে। মানুষ এবং পশুর ব্যবধানকে ঘুচে দেয়াই নাকি জরায়ু স্বাধীনতাকামীদের পরম প্রত্যাশা। সমাজের নৈতিক বাঁধনকে শিথিল করে দেয়াই তাদের লক্ষ্য। হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসুদ (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন যে, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল। এরূপ সাক্ষ্য যে, মুসলিমদের তার জীবন লওয়া অনুমোদিত নহে নিম্ন লিখিত তিনটি ক্ষেত্র ছাড়া যেমন বিবাহিত ব্যভিচারী, জীবনের প্রতিশোধ হিসেবে জীবন এবং দীন (ইসলাম) পরিত্যাগকারী।’ ওল্ড টেষ্টমেন্টেও উল্লেখ আছে, যে লোক অপর কোন লোকের স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করে এমনকি তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করে, সে ব্যভিচারী এবং ব্যভিচারকারিনীকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। অবিবাহিত লোকের যেনা সামাজিক নৈতিকতা ধ্বংস করে কিন্তু বিবাহিত নারী পুরুষের ব্যভিচার দ্বারা সামাজিক নৈতিকতার সাথে সাথে বৈবাহিক জীবনের পবিত্রতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। স্বামী স্ত্রীর স্বর্গীয় সুখ ও বিশ্বাস পবিত্র প্রেমের বন্ধনকে শিথিল করে দেয়। ইসলাম ধর্মে অবিবাহিতদের ব্যভিচারের শাস্তি একশত কষাঘাত এবং এক বৎসরের নির্বাসন, কিন্তু বিবাহিত লোকর ব্যভিচারের শাস্তি পাথর মেরে হত্যা। ইহুদী, খৃষ্টান ধর্মেও বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারীনির ব্যাপারে মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও এধরনের অপরাধকে জঘন্য ও কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করেন। তারা বিশ্বাস করেন এধরনের অপরাধিরা মৃত্যু পরবর্তী নরক যন্ত্রণা ভোগ করবে। এমতাবস্থায় দণ্ড বিধির ৪৯৭ ধারা সংশোধনের কোন বাধা থাকার কথা নয়। এব্যাপারে শুধু সরকারের ইচ্ছাই প্রয়োজন মাত্র। কেননা দণ্ডবিধির উক্ত ধারাটি ইসলামসহ সকল ধর্ম বিশ্বাসের পরিপন্থী। গোলামী যুগের এ আইন ধর্ম বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষের হৃৎপিণ্ডকে চমকে দেয়। পাশাপাশি ভঙ্গ হচ্ছে পারিবারিক শৃংখলা। এ-আইন বহুগামিতায় সমাজ কলুষিত করার হাতিয়ার, কেননা এ আইন ব্যভিচারী নারীকে স্বীয় অপকর্মের অপরাধ থেকে মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্র ও সরকার চরিত্রবান মা বোনদের অপমান করছেন। দেশের সকল ধর্মাবলম্বী নারী পুরুষ এ জঘন্য আইনের পরিবর্তন চায়। আইন উপদেষ্টা, আইন সচিব, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, আইন কমিশন, নারী ও পেশাজীবী সংগঠন, আইনজীবী সমিতি সমূহ এ আইন বাতিলে বা সংস্কারে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আল্লাহর গজব থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্তি দিতে পারেন। এতে সুন্দর পারিবারিক বন্ধনগুলো রক্ষা পাবে। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি ইতিপূর্বে মনুষ্যত্ব বিরোধী জঘন্য পাপিষ্ট আইনটি সংশোধনের জন্য তলবী সভা আহ্বান করে। সভায় সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত এক প্রস্তাবে দণ্ড বিধির ৪৯৭ ধারার সংশোধন পূর্বক ‘যদি কোন স্ত্রী স্বামীর অনুমতিতে বা বিনা অনুমতিতে অন্য পুরুষের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় সেই ব্যভিচারী নারী পুরুষ উভয়ের এবং ব্যভিচারে অনুমতি বা সম্মতি প্রদান করা হলে সম্মতি প্রদানকারী স্বামীরও প্রত্যেকের ১০ (দশ) বৎসর পযর্ন্ত সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান’ চালুর জোর দাবী জানানো হয়। দেশের প্রতিটি আইনজীবী সমিতি এ ধরনের তলবী সভা আহ্বান করে উক্ত আইন পরিবর্তনে নিজেদের দায়িত্ব পালনের চরম পরাকাষ্টা প্রদর্শন করতে পারেন। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় বৃটিশ প্রবর্তিত এ ধরনের বহু আইন রয়েছে যা নৈতিকতা, সামাজিক রীতি-নীতি, ও সকল ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। বৃটিশদের ফেলে যাওয়া এ সকল কালিমালিপ্ত আইনের অন্ধ অনুসরণ করতে তারাও আমাদের বলে যাননি। তবুও আমরা কোন অদৃশ্য সুতার টানে এ সকল গোলামী যুগের মনুষ্যত্ব বিরোধী কালো আইনের ঘানি টেনে যাচ্ছি তা বোধগম্য নয়। বৃটিশের ত্রুটিপূর্ণ এসব আইন অবিলম্বে বাতিল কিংবা সংশোধন না করলে আমাদের পারিবারিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে, সমাজ কলুষিত হবে বহুগামিতায়। এই ধারাটি সকল ধর্মীয় আইনেরও পরিপন্থি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান। ব্যাভিচার সংক্রান্ত দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধারাটি কেন সংশোধনের নির্দেশ দেয়া হবে না রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বিএইচআরএফ অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, পরকীয়ার ঘটনাগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক কারণ জড়িত। তিনি আরও বলেন, দেশের সেসব স্ত্রীর-স্বামী প্রবাসে থাকে তাদের তুলনামূলক বেশি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। দেখা যাচ্ছে যে, কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকরা পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পারিবারিক কলহ থেকে সন্তানকে হত্যা করছে। এ ক্ষেত্রে অবৈধ সম্পর্ক চালিয়ে যেতে কোনো বাধা পেলে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধে তারা জড়িয়ে পড়ছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়ে ছে যে, ‘ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারীদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত কর, আল্লাহর বিধান কার্যকরী করতে ওদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে অভিভূত না করে যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও আর মুমিনদের একটি দল যেন ওদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ (সূরা নূর ২ আয়াত)। এ ছাড়া মহানবী (সাঃ) এর জীবনী মতে উভয়কে বেত্রাঘাতসহ এক বছরের জন্য দেশ থেকে বহিষ্কার করার কথাও বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ইসলাম ধর্মে ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ উভয়ের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নারী পুরুষে ভেদাভেদ রাখা হয়নি। সরকার ২০২২ সালের আসন্ন পবিত্র মাহে রমজানের পূর্বেই আদর্শ বিরোধী আইন দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারাটি সংশোধন করবেন, এটাই লেখকের বিশ্বাস। নইলে দেশবাসী কি ধরে নেবেন অতীতের সরকার গুলোর মতো এ সরকারও দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারার সমর্থক? নারী দিবসের বানীতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা নেত্রী সকলেই ‘সমাজে রসুল মুহাম্মদ (সাঃ) এর আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মানুষের মুক্তির পথ’ মর্মে বিবৃতি দেন। এই বিবৃতি যদি মনের এবং প্রাণের বিবৃতি হয় তাহলে আল্লাহ ও রসুল মুহাম্মদ (সাঃ) এর আদেশ, নিষেধ গুলোর পৃথক পৃথক তালিকা প্রস্তুত করুন। তারপর নিষেধগুলো বর্জন ও আদেশগুলো পালনের আইগত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। জনগণ আপনাদের সাথে থাকবে। আইনজীবী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, তরুণ সমাজ, আলেম, ওলামা, পীর মাশায়েখ, কৃষক, শ্রমিক সকল নাগরিক, আসুন এ জঘন্য পাপীষ্টদের রক্ষা কবচটি বাতিলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসের সংগ্রাম শুরু করি। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী ।











