উইম্যান ইন লিডারশিপ : এ্যাসিভিং এ্যান ইক্যুয়েল ফিউচার ইন এ্য কোভিড ফ্রি –১৯ ওয়ার্ল্ড। এই বার্তা নিয়ে এবারে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস—২০২১।
২০২১ এর অতিমারী তথা কোভিড-১৯ এ পুরো বিশ্বে এবং দেশে নারীরা শুধু জীবন ও জীবিকা নিয়ে নয়–তাদের প্রত্যেকটি মুহূর্ত ছিল সংগ্রামের। কি ঘরে কি বাইরে যা প্রমাণ করেছে ইতিহাসের পাতায় নারীর অবদান স্বীকৃতি না পেলেও সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে নারী শুধু সমাজের বিকাশে নয় সংগ্রামে বা আন্দোলনে বা যে কোন দুর্যোগে নারীকে যেমন বহুমুখী যন্ত্রণা বেদনা বা সহিংসতার শিকার হতে হয়েছে তেমনি সংকট মোকাবিলায় নারী লড়েছে প্রাণপণে।
কোভিড -১৯ এ নারীরা সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে স্বাস্থ্যসেবায়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় তেমনি পারিবারিকভাবে আগলে রেখেছেন সংসারকে আবার নানাভাবে মানবতার সেবায়ও নেতৃত্বেও দেখিয়েছেন অসাধারণ কৃতিত্ব। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার মতো সামরিক ক্ষমতাধর দেশগুলো যেখানে মহামারি ঠেকাতে হিমশিমে সেখানে নারী সরকার প্রধানরা কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কারণে করোনা মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছেন –যেমন তথ্য গোপন না করা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রযুক্তির ব্যবহার আর নাগরিকদের প্রতি ভালোবাসা। জার্মানির অ্যাঙ্গোলা মার্কেল, নিউজিল্যান্ডের জেসিন্ডা এডেন, আইসল্যান্ডের ক্যাটরিন ইয়াকোরস্টিডিটি, ফিনল্যান্ডের সানা মেরিন, নরওয়ের এনা সেলবার্গ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রথম দিক থেকে নানাভাবে আন্তরিকতা ও দৃঢ়তা অবস্থানে ছিলেন। নারী নেতাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ, ভাষণের সাথে সংকট মোকাবিলায় তাঁদের স্নেহ ও মমতা প্রতিষেধক টিকা হিসেবে কাজ করেছে।আর করোনা প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারেও একজন মহীয়সী নারী ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আবার পরম বেদনায় দেখেছি এই করোনাকালে ও নারীরা কিভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর এখনও জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে বিশেষত দেশের তৃণমূল পর্যায়ের নারীরা কিভাবে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে।
কখন থেকে এই দিবসের শুরু! একটা সময়ে এ দিবসের নাম ছিলো আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস হিসেবে প্রতি বছর পালিত হতো ৮ মার্চে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস।এ দিবসের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের ইতিহাস। শুরুটা ১৮৫৭ সালে যখন অধিকার আদায়ে রাস্তায় নেমেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সূঁচ কারখানার নারী শ্রমিকেরা। অভিযোগ অনেক। কাজের অমানবিক পরিবেশ, মজুরি বৈষম্য, নির্দিষ্ট শ্রম ঘণ্টা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেঠেল বাহিনীর দমন নিপীড়ন –অবশেষে ধারাবাহিক ভাবে নারী সমাজের প্রতিবাদ আন্দোলন এবং ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের সোস্যাল ডেমোক্রেটিক নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত প্রথম নারী সমাবেশ। নেতৃত্বে জার্মান নারী নেতা ক্লারা জ্যাটকিন। ১৯১০সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন কোপেনহেগেনে যেখানে বিশ্বের ১৭টি দেশের একশত প্রতিনিধির যোগদান। আর এ সম্মেলনে প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত দেন ক্লারা জেটকিন। অবশেষে ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের জন্যে বিভিন্ন দেশকে আহ্বান জানায় রাষ্ট্রসংঘ। কোভিড পরবর্তী বিশ্ব হবে এক পরিবর্তিত নতুন বিশ্ব।এক অন্য ভুবন। প্রত্যাশা আমাদের নারী ও পুরুষের সমতার পৃথিবী যা আনবে শান্তি ও সহাবস্থানের মাধ্যমে সার্বিক উন্নয়ন বিশেষত মানব জাতির উন্নয়ন। ২০৩০ সালের প্ল্যানেট ৫০-৫০। সাস্টেন্যাবেল গ্রোথ এর পাঁচ নাম্বার ধারার সেই শর্ত এখনো অর্জিত হয়নি। কোভিড–১৯ এর অতিমারীতে যুক্ত হয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ। এখনো নানাভাবে বৈষম্যের শিকার নারী যার শুরু পরিবার থেকে এবং জাতীয় পর্যায়ে তথা পুরো বিশ্বে। দেশের সংবিধানে প্রতিটি জাতক স্বাধীন। সমস্ত মৌলিক অধিকার নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই সমানভাবে ভোগ করার অধিকার রয়েছে। এতে কোন ভিন্নতা নেই। নারী কোনভাবেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নয়।যে কোন অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন ভিন্নতা নেই। তাহলে পরাধীনতা কোথায়!
রাষ্ট্র প্রদত্ত সার্বিক স্বাধীনতা দেওয়া হলেও কেন নারীর নিরাপত্তাহীনতার সংকট! তাহলে কি আমাদের চিন্তাধারার মধ্যেই কোথাও কোন একটা সংকট গেছে! যে কারণে নানা সুবিধা থাকা সত্ত্বেও নারী নিজেকে পরাধীন মনে করার একটা ক্ষেত্র খুঁজে পাচ্ছে। কী সেই সংকট! আমার কাছে মনে হয় নারী মুক্তি ভাবনার প্রধান সংকট এই যে,নারীকে যতোটা নারী ভাবি বা মূল্যায়ন করি ততোটা মানুষ মনে করি না। ফলশ্রুতিতে নারীর সমস্যা যতোটা নারী কেন্দ্রিক হচ্ছে ততোটা ব্যক্তিক হচ্ছে না। অথচ নারী ও পুরুষ মিলেই সভ্যতার বিকাশ, পরিবার অথচ সমাজে নারী ও পুরুষ এই দুটোইতো শ্রেণি আছে। আর এ দুয়ে মিলেই তো সমাজ বা রাষ্ট্র। সমাজ গঠনের দায় দুজনের এবং দুজনেই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে কেন নারীর স্বাধীনতা অধিকার বা নিরাপত্তা নিয়ে কেন বিভাজন! কেন বৈষম্য! তাহলে কি আমরা এই গভীর সত্যিকে কি অনুধাবন করছি না বা সদিচ্ছার কারণেই এই সংকট! নারীদের ক্ষেত্রে আরও একটা সংকট হচ্ছে চিন্তাবদ্ধতা। চিন্তার মুক্তি যদি না ঘটে তাহলে কেউই পরাধীনতার অনিবার্য শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। স্বাধীনতা উভয়ের তথা নারী ও পুরুষের ব্যক্তি সত্তার উত্তরণ। যা অর্জনে নিজেকে তার উপযুক্ত আধার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে লক্ষ্যে প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, নিজের প্রতি সম্মান রেখে বিবেক ও সততার সাথে নিজেকে তৈরি করা। আর প্রয়োজন সুশিক্ষা ও প্রজ্ঞাজনিত চেতনা। একই সাথে নানামুখী চ্যালেঞ্জ বা প্রতিকূলতা অর্জনে সাহসী হওয়া।তবে এক্ষেত্রে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে তৈরি করতে হবে নারীবান্ধব পরিবেশ।
পরিশেষে বলি-কোভিড পরবর্তী পৃথিবীতে সংগ্রামে ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়,শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে এবং সার্বিকভাবে নারী পুরুষ সমতায় গড়ে উঠবে এক নতুন পৃথিবী। এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : সাহিত্যিক, গবেষক; সাবেক অধ্যক্ষ,
আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ।