‘সব সময় নিজের ভেতরের শক্তিকে পরিচর্যা করতে হবে’

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ১২ নভেম্বর, ২০২৪ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব গৌরবের ৬৫ বছর উদযাপন করছে। গত ৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হলো ক্লাবের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর জেসমিন আক্তার। সভাপতিত্ব করেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট খালেদা আউয়াল। কবি মর্জিনা আখতারের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন সাবেক যুগ্ম সচিব শিক্ষাবিদ ড. জয়নাব বেগম, ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিনাত আজম, সম্পাদিকা বোরহানা কবির, সম্মেলন আহ্বায়ক পারভিন জালাল, সাবেক রোটারী গভর্নর এম এ আউয়াল, কলামিস্ট কাজী রুনু বিলকিস। অনুষ্ঠানে সমবেত সংগীতে অংশগ্রহণ করেন রুহী মোস্তফা, প্রফেসর সালমা রহমান, নাজনীন আরা শান্তা, পারভিন জালাল, খন্দকার ইসমত আরা, শাহানা আক্তার জাহান, রেহেনা আক্তার জাহান, মর্জিনা আখতার, সুলতানা নুরজাহান রোজী, আক্তার বানু ফেন্সী, নাসরিন সরোয়ার মেঘলা, ডা. হাফসা সালেহ, মিনু আলম, লায়লা ইব্রাহিম বানু, ফারহানা হক, আশরাফুন্নেসা। কবিতা আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী আয়েশা হক শিমু ও নাসিমা শওকত। চমৎকার এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পেশার বিশিষ্ট নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন।

এই নগরে নারীদের এমন এক সংগঠনের সগৌরবে এগিয়ে যাওয়া অত্যন্ত আনন্দের। দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে যাঁরা এই সংংগঠনের সঙ্গে ছিলেন ও আছেন, তাঁদের সবাইকে আমরা স্মরণ করছি ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।

আমরা জানি, শত প্রতিকূল পরিস্থিতি ডিঙিয়ে একটা মেয়েকে কাজ করতে হয় এ সমাজে। বলা যায়, শিশুকাল থেকে মেয়েরা পীড়নের শিকার। সে মেয়ে বলে তাকে বঞ্চিত করা হয় ভালো কিছু থেকে। সে মেয়ে, তাই তাকে সব সহ্য করতে হয়। সে শারীরিকভাবে দুর্বল। তাই তার প্রতিবাদ চলে না। সে ভয় পায়, তাকে ভয় দেখায়। হাজার বছর ধরে চলছে তার ওপর অত্যাচার। এতো বঞ্চনা, এতো লাঞ্ছনা সত্ত্বেও সে এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিকে। পৃথিবীতে চিরকাল ধরে চলছে শোষণ। শক্তিমান শোষণ করে দুর্বলকে, ধনী শোষণ করে গরিবকে, আর সবাই শোষণ করে তাকে। কারণ সে মেয়ে। পৃথিবীতে সে সবচেয়ে শোষিত। পৃথিবীতে বহু মানুষের স্বাধীনতা নেই। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতাহীন হচ্ছে সে। কারণ সে মেয়ে। মেয়েরা পৃথিবীর অর্ধেক, সভ্যতার অর্ধেক। সভ্যতার অর্ধেক মেয়েদের সৃষ্টি। ভবিষ্যৎ সভ্যতার বড়ো অংশ সৃষ্টি হবে তাদের প্রতিভায়। এতো দিন মানুষ কাজে লাগিয়েছে তার অর্ধেক প্রতিভা, অর্থাৎ ছেলেদের প্রতিভা। ভবিষ্যতে মেয়ে আর ছেলের মিলিত প্রতিভায় বিকশিত হবে মানুষ। পৃথিবী হয়ে উঠবে আরো সুন্দর, আরো কল্যাণময়। শিশুকাল থেকেই যদি ছেলে শিশু ও কন্যা শিশুর মধ্যে ব্যবধান দূর করা যায়, যদি তাদের বোঝানো যায় যে তারা সবাই একই পরিবেশে একই মাত্রায় বেড়ে উঠবে, তাহলে এর ফল গ্রহণ করবে সমাজ। সৌভ্রাতৃত্ব, সহধর্মিতা, সহমর্মিতা ও বোঝাপড়ার অগ্রগতি সাধনের মধ্যেই সার্বিক কল্যাণ নিহিত। এই বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে মাবাবাকে। সচেতন হতে হবে ঘরের অভিভাবককে।

স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আজ বিশ্বব্যপী স্বীকৃত। মাঝে মধ্যে ছন্দপতন হলেও দুর্দান্ত গতিতে এগিয়েছে আমাদের প্রিয় দেশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলছে আমাদের নারীরা। বাস্তবতা আর নানা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এদেশের নারীরাও আজ এক জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নারীও সমান অংশীদার। পুরুষের পাশাপাশি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারিগর হিসেবে তারা দাঁড়িয়ে গেছে সমান শক্তিতে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই বাংলাদেশের নারীর সংগ্রামী পথচলার আখ্যান সুপ্রতিষ্ঠিত। সেই আলোকে রাজনীতিতে নারীর পদচারণা বহু আগে থেকেই। তৃণমূল পর্যায়ে অর্থাৎ স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও নারীরা এগিয়ে এসেছেন। সরাসরি নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে অংশ নিচ্ছেন।

শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার ‘১৯৭০৭১’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে সময়ে দেশের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশের কিছু বেশি। সরকারের শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৯২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে যা বর্তমানে (ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৫১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সর্বমোট শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ছাত্রী। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংখ্যা কমে সর্বমোট সংখ্যার ৩৮ শতাংশ আছে ছাত্রী। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিসিএনএর পরিচালক ফাহমিদা হক তাঁর এক লেখায় বলেছেন, বাংলাদেশই দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম দেশ হিসেবে সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা অর্জন করেছে। এমনকি মাধ্যমিক শিক্ষায়ও আমাদের এই সাফল্য রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮ মিলিয়নের মধ্যে ৯৭.৯১ শতাংশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, যাদের ৫০.৯ শতাংশ আবার মেয়ে। আর মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণের হার ৫৩ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালেও দেখা যায়, মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা উন্নতির দিকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২০ সালে মোট শিক্ষার্থীর ৪৫.২৭ শতাংশ ছিল মেয়ে শিক্ষার্থী। আমাদের কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪৬ শতাংশ নারী বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, যা জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে বেশি। বর্তমানে মেয়েরা নিজের জন্যে পড়ালেখা করে। নিজ পায়ে দাঁড়াতে, পুরুষের সমানতালে হাঁটতে নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। মেধা আর প্রজ্ঞা দিয়ে নারীরা ঘরে বাইরে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে যে, সুযোগ পেলে নারীরাও সব পারে।

আসলে মেয়েদের জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত উপবৃত্তির ব্যবস্থা চালু করায় বর্তমানে বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের ভর্তির হার উন্নীত হয়েছে ৯৭.৭ শতাংশে, যেখানে ১৯৯০ সালে এই হার ছিল মাত্র ৬১ শতাংশ। নারী শিক্ষকের হারও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। শিক্ষা প্রশাসনেও এখন অনেক নারী কর্মরত আছেন।

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রে নারীর এগিয়ে যাওয়ার চিত্রই লক্ষ করি আমরা। সংবাদপত্র বা মিডিয়া ইত্যাদি চ্যালেঞ্জিং কাজে নারীদের পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাহিত্য, সংস্কৃতির সকল শাখায় নারীর উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো। বিবিএসএর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে দেশে কর্মক্ষেত্রে নারী ছিল ৪ শতাংশ। এই হার ১৯৮০ সালের দিকে ৮ শতাংশ ও ২০০০ সালে ২৩.৯ শতাংশ, তবে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণে ২০১০ সালে বেড়ে ৩৬ শতাংশ হয়। সর্বশেষ ২০১৬১৭ জরিপে নারী হিস্যা ৩৬.৩ শতাংশ। বলা যায়, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। প্রায় ১৬ হাজার ৭০০ নারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ৮০ শতাংশের বেশি নারী। সব মিলিয়ে নারীর অগ্রযাত্রা আশাপ্রদ। আমরা এই অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে চাই।

মোট কথা, সরকারি ও বেসরকারি যে সকল উদ্যোগ রয়েছে তা সমন্বয়ের মাধ্যমে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার প্রয়াস আমরা প্রত্যক্ষ করি। নারীর কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন হলে ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায়’ নারীর অবদান আরও বলিষ্ঠ হবে বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করি, সর্বত্র নারী অংশগ্রহণ বাড়ালেই কেবল চলবে না, নারীর গুণগত উন্নয়নও জরুরি। কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন, লিঙ্গসমতা, নারীবান্ধব নিরাপদ পরিবেশসহ সকল বৈষম্য দূর করতে পারলেই নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা এরং সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। দেশের অর্ধেক জনসম্পদকে বাদ দিয়ে দেশ সাফল্যের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। তবে এজন্য নারীদেরও ভূমিকা পালন দরকার।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মেয়েদের সব সময় নিজের ভেতরের শক্তিকে পরিচর্যা করতে হবে। নিজের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগাতে হবে। জীবনের সব জায়গায় সমস্যা থাকে। সমস্যাকে ভয় পেলে চলবে না। সমস্যা জয় করে নিতে হবে।’

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;

ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘দরদীয়ারে বন্ধু’ : মরমী সুফীবাদের অনন্য দর্শন
পরবর্তী নিবন্ধউপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়ে পরিবর্তন ঘটানোর আশ্বাস ফারুকীর