দেশের সবচেয়ে পরিকল্পিত হাসপাতাল হিসেবে ইম্পেরিয়াল হাসপাতালকে গড়ে তোলা হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেন বলেছেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল অনন্য অবদান রেখেছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং প্রশিক্ষিত নার্স নিয়োগ থেকে শুরু করে বিশ্বমানের নানা পদক্ষেপের ফলে করোনা আক্রান্ত রোগীর সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা ইম্পেরিয়াল হাসপাতালেই প্রদান করা হয়। ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল রোববার দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, শুধু করোনা চিকিৎসায় নয়, হৃদরোগ, শিশু রোগ, গাইনীসহ সব ধরনের রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল অনন্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে কি কি অভাব রয়েছে সবকিছু মাথায় রেখেই এই হাসপাতালটি গড়ে তোলা হয়েছে। বিশেষ করে ইনফেকশন ঠেকানোর জন্য আমাদের বহুমুখী পদক্ষেপই ইম্পেরিয়াল হাসপাতালকে চিকিৎসাসেবায় উচ্চতায় নিয়ে গেছে। দেশের মানুষকে আমরা দেশে চিকিৎসা দেব। বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমিয়ে এনে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করব। সর্বোচ্চ এবং বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করব। এমন কিছু লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করেছি। ইনফেকশন ঠেকানো কিংবা বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবার ব্যাপারে কোনো ধরনের আপোষ করা হয়নি।
চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি আগামী দুয়েক মাসের মধ্যে ‘চট্টগ্রাম ইম্পেরিয়াল কলেজ অব নার্সিং’ চালু করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠান চালুর ব্যাপারে যাবতীয় আয়োজন, বিভিন্ন প্রকারের অনুমতি, নার্সদের ইন-ক্যাম্পাসে থাকার ব্যবস্থা ও শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২৭০ জন নার্সের আবাসনসহ প্রশিক্ষণের বিশ্বমানের এই কলেজ থেকে বিএসসি (নার্সিং) ডিগ্রি প্রদান করা হবে। যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, অচিরেই বাংলাদেশ নার্স রপ্তানি করবে। ফিলিপাইনের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাতই হচ্ছে বিদেশে প্রশিক্ষিত নার্স প্রেরণ। আমাদেরও এই খাতে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। গার্মেন্টসের মতো নার্স রপ্তানি খাত থেকেও আমরা কোটি কোটি ডলার আয় করতে পারব।
হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডা. রবিউল হোসেন বলেন, দেশের মানুষকে দেশেই চিকিৎসা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৯ সালের ১৫ জুন ৪শ শয্যা বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক মানের ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল যাত্রা শুরু করেছিল। করোনার কারণে শুরুতে অনাকাক্সিক্ষত বাধার মুখে পড়েছিলাম। দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষিত আমাদের ২শ জন ডাক্তার ও দক্ষ নার্স সরকারি চাকরিতে যোগদান করে। ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল এই সংকটময় পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে রোগীদের উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা প্রদান করে আসছে।
তিনি বলেন, ২৫টি ক্রিটিক্যাল কেয়ার বেড এবং ২৫টি আইসোলেশন কেবিন বিশিষ্ট সম্পূর্ণ আলাদা একটি কোভিড ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও প্রশিক্ষিত নার্সের সমন্বয়ে ৭০ জনের একটি টিম সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। চট্টগ্রাম শহরের বাইরের রোগীদের জন্য একটি মোবাইল টিমের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেমন মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ, উখিয়া, ভাসানচর থেকে করোনা স্যাম্পল গ্রহণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
হাসপাতালের একাডেমিক কো-অর্ডিনেটর ডা. একেএম আরিফ উদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন চট্টগ্রাম আই ইনফার্মারি ও ট্রেনিং কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান এবং ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স-এর সিনিয়র সদস্য এম এ মালেক। উপস্থিত ছিলেন ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আমজাদুল ফেরদৌস চৌধুরী এবং হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকবৃন্দ।
ডা. রবিউল হোসেন বলেন, করোনা পরিস্থিতির মাঝেও ভারতের প্রখ্যাত হার্ট সার্জন ডা. দেবী শেটির প্রতিষ্ঠিত নারায়ানা হেলথের ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান সমন্বয়ে গঠিত ৪০ জনের একটি টিম গত জানুয়ারি থেকে ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান করছে। গত পাঁচ মাসে এই টিম ২৬টি ওপেন হার্ট সার্জারি, ২৩৯টি বিভিন্ন রকম প্রসিডিউরসহ বহির্বিভাগে সাত হাজারেরও বেশি রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে।
বাংলাদেশে শিশু রোগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় গুণগত মানসম্পন্ন চিকিৎসার ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই উপলব্ধি থেকে ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু রোগ বিভাগ স্থাপন করেছে। যেখানে ৪০ জনের টিমে প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান চিকিৎসাসেবা প্রদান করছেন। এই ইউনিটে প্রিমেচিউর (ওজন ৭০০-১০০০ গ্রাম), নবজাতকদের জন্য ১২টি আলাদা শয্যা রয়েছে। বাংলাদেশে এই প্রথম নবজাতকদের জন্য ডেডিকেটেড অ্যাম্বুলেন্স, যেখানে ডেডিকেটেড মেডিকেল টিম, ডাক্তার, নার্স, ভেন্টিলেটরসহ প্রয়োজনীয় লাইফ সাপোর্টের ব্যবস্থা রয়েছে। এই পর্যন্ত ২শরও অধিক প্রিমেচিউর শিশুর চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়েছে। এই ইউনিটে নিউ বর্ন স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে জন্মগত ত্রুটি ও রোগ যেমন হৃদযন্ত্র, হরমোন, হাড় জোড়া, চোখ, কানের জন্মগত ত্রুটি নির্ণয়ের ব্যবস্থা রয়েছে, যা চট্টগ্রামে এখনো পর্যন্ত ইম্পেরিয়াল হাসপাতালই করে থাকে।
তিনি আরও বলেন, ল্যাব মেডিসিন বিভাগ, বিশেষ করে ক্যান্সার রোগ নির্ণয়ে বায়োপসি ও হিস্টোপ্যাথলজি বিভাগ চট্টগ্রামে অনন্য হয়ে উঠেছে। এমনকি অপারেশন চলাকালীন তাৎক্ষণিক ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য ফ্রোজেন সেকশনের ব্যবস্থা রয়েছে, যা চট্টগ্রামে কেবলমাত্র ইম্পেরিয়াল হাসপাতালই করে থাকে। রোগ নির্ণয়ের এই সুবিধা ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর অপারেশন চলাকালেই বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে সর্বাধুনিক ডুয়েল সোর্স সিটি স্ক্যান মেশিনের মাধ্যমে হার্টের সিটি এনজিওগ্রাম ও ক্যালসিয়াম স্কোরিংয়ের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির আগামী ৫ বছরে হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কার হার নির্ণয় করার সুবিধাও রয়েছে এই হাসপাতালে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনা ও অন্যান্য গুরুতর দুর্ঘটনার রোগীদের চিকিৎসা সম্মিলিতভাবে একই ছাদের নিচে করার তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে ৫টি ডিসিপ্লিন যেমন জেনারেল সার্জারি, নিউরো সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারি, প্লাস্টিক সার্জারি এবং ম্যাক্সিলো ফেসিয়াল সার্জারির সমন্বয়ে একটি টিম নিয়ে ‘ট্রমা সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতেই কেবল আছে। এছাড়া ‘প্রিভেনটিভ অ্যান্ড ফ্যামিলি হেলথ কেয়ার’ এর মাধ্যমে পরিবারের সকল সদস্যের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও শিক্ষামূলক কর্মসূচিসহ বিভিন্ন রোগ প্রাথমিক স্তরে নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রদান করার ব্যবস্থা থাকবে। দক্ষ মেডিকেল টেকনিক্যাল জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল ভবিষ্যতে একটি স্বতন্ত্র প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যাতে করে যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবহার শিক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ও রোগীর পরিচর্যায় সহায়তা হবে।
ক্যান্সার ইনস্টিটিউট প্রসঙ্গে ডা. রবিউল বলেন, ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের মূল পরিকল্পনায় ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা অন্যতম। বর্তমানে ইম্পেরিয়ালে শুধু কেমোথেরাপির মাধ্যমে সব বয়সের ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা করা হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো যেমন কেমোথেরাপি ডে কেয়ার সেন্টার, অপারেশন থিয়েটার, ল্যাবরেটরি ও আনুষঙ্গিক সাপোর্ট সার্ভিসের ব্যবস্থা বর্তমানে ইম্পেরিয়ালে বিদ্যমান। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে আরো প্রায় একশ কোটি টাকা প্রয়োজন। তাই এর কাজ স্থগিত আছে। তবে পূর্ণাঙ্গ ইনফার্টিলিটি সেন্টারের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা সম্পন্ন করা হয়েছে। মহামারীর কারণে আপাতত তা শুরু করা হয়নি।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সের সদস্য এম এ মালেক বলেন, আমরা সেবার মানসিকতা নিয়ে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছি। এখানে কারো ব্যক্তিগত মুনাফার সুযোগ নেই। শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের মানুষ যাতে দেশেই চিকিৎসাসেবা পান তা নিশ্চিত করতেই এই হাসপাতাল গড়ে তুলেছি। বিশ্বমানের চিকিৎসা আমরা এখানেই দিতে চাই। চিকিৎসার জন্য যাতে আর কাউকে বিদেশ যেতে না হয়।
তিনি বলেন, অত্যাধুনিক নানা সুযোগ-সুবিধা আমরা গড়ে তুলেছি। এতে খরচ খুব বেশি বলে মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সমমানের অন্যান্য হাসপাতাল থেকে কম। তিনি বলেন, ইনফেকশন ঠেকানোসহ রোগীর কথা চিন্তা করে আমাদের হাসপাতালে টাওয়াল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিস ওয়ান টাইম ব্যবহার করা হয়। ডিসপোজেবল এসব সামগ্রী ব্যবহারের ফলে খরচ বাড়ে। কিন্তু এরপরও আমরা সমন্বয় করে রোগী যাতে স্বাভাবিক খরচে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা এবং নির্ভুল রোগ নির্ণয় করতে পারেন তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি।