আমাদের এই পৃথিবীটা এক সময় শ্যামল সবুজ ছিল। সব কিছু সুন্দর ভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে চলতো। বিজ্ঞানের ক্রম বর্ধমান উন্নতিতে দেশে দেশে দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের বিকাশ ঘটে। মানুষের জীবনে চাহিদাও বাড়তে থাকে। সুন্দর এই পৃথিবীটা দিন দিন পরিবেশ দূষণে আক্রান্ত হচ্ছে। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, মাটি দূষণ, রাসায়নিক দূষণ সহ নানাভাবে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। বিজ্ঞানের উন্নতি আমাদের জীবনকে বেগবান ও গতিশীল করেছে অনেক কিছুর সৃষ্টি হয়েছে, ভিন গ্রহে বাস করার ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আবার সবুজ পৃথিবীর জন্য নতুন সমস্যাও তৈরি হয়েছে।
প্লাস্টিক সহজে বহন ও ব্যবহার করা যায়, সস্তা ও সহজে পাওয়া যায় তাই এই কৃত্রিম তন্তু দৈনন্দিন মানব জীবনের সাথে দারুণভাবে মিশে গেছে। কিন্ত প্লাস্টিক বর্জ্য পচনশীল নয়। এটা শত শত বছর মাটি ও পানিতে পচনহীনভাবে থাকে ফলে প্রকৃতির স্বাভাবিক চক্র নষ্ট করে দীর্ঘ মেয়াদী পরিবেশ দূষিত করছে।
পলিথিন ১৯৩৩ সালে ইংল্যান্ডের নর্থউইচে ইম্পারিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের এক কারখানায় দুর্ঘটনাক্রমে মি:এরিক ফসেট এবং মি: রেজিনাল্ড গিবসন দ্বারা আবিষ্কৃত হয়।
১৯৭০–এর দশকে অভিনব এই প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ এখন বিশ্বের প্রতিটি কোণায় পাওয়া একটি সহজলভ্য পণ্য। প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ব্যাগ উৎপাদিত হয়। পলিথিন সমুদ্রের অন্ধকারতম গভীরতায়, মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া ও মেরু অঞ্চলের বরফের স্তূপেও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায়, প্লাস্টিক কিছু বড় পরিবেশগত চ্যালেঞ্জকে তীব্রতর করছে।
১৯৯৭ – নাবিক এবং গবেষক চার্লস মুর গ্রেট প্যাসিফিক আবর্জনা প্যাচ আবিষ্কার করেন, যা বিশ্বের মহাসাগরের বেশ কয়েকটি গায়ারের মধ্যে বৃহত্তম যেখানে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে এবং সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। বর্ষাকালে বড় বড় শহরে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ ড্রেনে জমে থাকা অপচনশীল কৃত্রিম তন্তু পলিথিন। বাংলাদেশে বন্যার সময় ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম পাতলা প্লাস্টিক ব্যাগের ভূমিকা প্রমাণিত হওয়ার পর, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অন্যান্য দেশ ও একই পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করে।
এক হিসাবে দেখা যায় বিশ্বব্যাপী প্রতি মিনিটে এক মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে ২০২০ সালে, শহরাঞ্চলে বাংলাদেশের মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৯ কেজি। ২০০৫ সালে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৩ কেজি, যা প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে যে ২০২০ সালে বাংলাদেশ আনুমানিক ৯,৭৭,০০০ টন প্লাস্টিক ব্যবহার করেছে, যার মাত্র ৩১% পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। উপরন্তু, একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ২০২০ সালে রাজধানী ঢাকায় প্রতি ব্যক্তি প্রতি বছরে সর্বোচ্চ ২৪ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করে।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক বর্জ্যের একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি এবং অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য, বাংলাদেশ টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যার লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০% প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০% ভার্জিন উপাদানের ব্যবহার হ্রাস করা। একটি চক্রাকার অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার এবং প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস করার জন্য উল্লম্বভাবে সমন্বিত পুনর্ব্যবহার কার্যক্রম এবং সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্বের মতো উদ্ভাবনী সমাধানগুলি অনুসন্ধান করা হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক হ্রাস, পুনঃব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া।
পলিথিন নালা নর্দমা নদী দিয়ে সাগর ও মহাসাগরের পানিতে গিয়ে মিশে। পলিথিনের নানাবিধ ব্যবহারে মাইক্রো প্লাস্টিক বা অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কনার সৃষ্টি হয় যা সাগরের বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে পাওয়া গিয়েছে। মানব দেহের নানা অঙ্গ–প্রত্যঙ্গে ও মাতৃদুগ্ধে মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। প্রতিবছর প্লাস্টিকের ব্যবহার ৮% থেকে ১০% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনও উন্নত নয়। প্লাস্টিক বর্জ্য অন্য সাধারণ গৃহস্থালী আর্বজনার সাথে মিশ্রিত হয়ে উন্মুক্ত স্থানে ডাম্পিং করা হয় ও ল্যান্ডফিল হয়। বাংলাদেশে ৫৫ মাইক্রোনের চেয়ে পাতলা পলিথিনে ২০০২ সালে থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
এদেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছোট ছোট প্লাস্টিক রিসাইকল শিল্প গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এরকম ৫০০০ কারখানায় প্রায় ১২ লক্ষ নারী পুরুষ অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে যুক্ত আছে। আমাদের লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০% প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকল বা পুনরায় ব্যবহার করা। একবার ব্যবহার যোগ্য পলিথিন ব্যাগ ২০২৬ সালের মধ্যে ৯০% কমিয়ে আনা।
মানুষের প্রয়োজনে সস্তা প্লাস্টিকের ব্যবহার পৃথিবীতে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্লাস্টিক প্রকৃতির নীরব মহা ঘাতক। সমাজের মানুষকে প্লাস্টিকের বর্জ্যের ভয়াবহ দিক সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। প্রাকৃতিক তন্তের পাট ও অন্যান্য পচনশীল বস্তুর ব্যবহার বাড়াতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাবলিক প্লেস, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও সামাজিক ভাবে প্রচার প্রচারণা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে দূষণ ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দূষণ নিয়ন্ত্রণে কমিউনিটি ভিত্তিক পাইলট প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। বিদ্যালয়ের সিলেবাসে পরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক শিক্ষা নিয়ে গ্রীন এডুকেশন চালু করলে ভবিষ্যতে ভালো ফলাফল আসবে। সকলের সহযোগিতায় গড়ে উঠবে আগামীর সবুজ সোনালী বাংলাদেশ।
লেখক: প্রকৌশলী; পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক লেখক।