ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১২টা। মনসুরাবাদের বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের দোতলায় একটি কক্ষের সামনে জটলা। কক্ষের ভিতরেও ছোটখাটো ভিড়। একেকজন নিজেদের হাতে থাকা কাগজের ফাইলটি (আবেদন) চেয়ারে বসা এক কর্মকর্তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন। ফাইলটি হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলানোর পাশাপাশি টুকটাক এটা-সেটা জানতে চাইছেন ওই কর্মকর্তা। সব ঠিকঠাক পেলে ফাইলে সাইন করে কোথায় যেতে হবে তা বলে দিচ্ছেন। কারও ফাইলে কোনো জটিলতা দেখা গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে আলাপ করছেন।
কোনো কাগজ বা ডকুমেন্টের অভাব থাকলে সেটি বুঝিয়ে বলে পরবর্তীতে ওই ডকুমেন্টসহ নিয়ে আসার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরপরই বেজে উঠতে থাকে মোবাইলের রিং টোন। ফাঁকে ফোনকল রিসিভ করে মোবাইলেও কথা বলছেন। শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সকল পর্যায়ের সেবাগ্রহীতাদের সেবায় এভাবেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় কর্মকর্তা মো. আবু সাইদকে। বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক তিনি। বলতে গেলে অফিসের শীর্ষ পদের এই কর্মকর্তার কক্ষের দুয়ার সবার জন্যই খোলা। যে কেউ গিয়ে পাসপোর্ট সংক্রান্ত সেবার বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। জানাতে পারছেন অভিযোগও। মুহূর্তেই প্রতিকারও পাচ্ছেন কেউ কেউ। অনেকেই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার ভোগান্তি এড়াতে দ্বারস্থ হন পরিচালকের। পরিচালকও নিরাশ করেন না। ক্ষেত্র বিশেষে দেয়া হচ্ছে প্রিমিয়াম সার্ভিসের (অগ্রাধিকার সেবা) সুযোগও। যাতে লাইনে দাঁড়ানোর ভোগান্তি ছাড়াই আবেদন জমা থেকে শুরু করে ছবি তোলা, আঙ্গুলের ছাপসহ সব প্রক্রিয়া শেষ করার সুযোগ পান সেবাগ্রহীতা। এমন সেবা পেয়ে সেবাগ্রহীতারাও বেশ খুশি।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ছুটে আসেন পরিচালকের কক্ষে। নিজের পরিচয় দিয়ে ওই শিক্ষককে বলতে শোনা যায়- পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে এসেছিলাম। কিন্তু নিচে (নিচ তলায়) অনেক বড় লাইন..। এতটুকু শুনতেই শিক্ষকের কাছ থেকে আবেদনটি নিতে হাত বাড়িয়ে দেন পরিচালক মো. আবু সাইদ। কাগজপত্র সব দেখে স্বাক্ষর করে প্রিমিয়াম সার্ভিসের নির্দিষ্ট কক্ষে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়া অগ্রাধিকার সেবা পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেখা যায় ওই শিক্ষককে।
আবেদন জমাদান পরবর্তী দীর্ঘ দিনেও পাসপোর্ট না পাওয়ায় পরিচালকের সাথে দেখা করতে এসেছেন এক মহিলা। ওই মহিলার স্লিপটি দেখার পর ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/স্টাফের সাথে কথা বলেন পরিচালক। দ্রুত পাসপোর্টটি প্রিন্ট করার ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন তিনি। ঢাকায় কথা বলা শেষে ওই মহিলাকে সপ্তাহ খানেক পর আবার যোগাযোগের পরামর্শ দেন পরিচালক।
আবেদন জমাদান পরবর্তী দুই মাসেও পাসপোর্ট না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চান মহিউদ্দিন নামে অপর এক সেবাগ্রহীতা। স্লিপটি নিয়ে পাশে থাকা অধঃস্তন সহকর্মী নাহিদাকে ফাইলটি দেখতে বলেন পরিচালক মো. আবু সাইদ। ফাইল দেখে পুলিশ ফেরিফিকেশন রিপোর্ট না আসার কথা জানান নাহিদা আশরাফ। পুলিশ রিপোর্ট না এলে পাসপোর্ট অফিসের কিছু করার থাকে না মর্মে সেবাগ্রহীতাকে বুঝাতে চেষ্টা করেন পরিচালক। রিপোর্টের বিষয়ে পুলিশের সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগের পরামর্শও দেন তিনি। পাসপোর্ট পেতে বিলম্বের কারণ এতদিন ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও পরিচালকের কথায় বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হন মহিউদ্দিন নামের ওই সেবাগ্রহীতা।
নিয়মের মধ্যে সেবাগ্রহীতাদের সম্ভবপর সব ধরণের সেবা প্রদানে চেষ্টা করেন জানিয়ে বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. আবু সাইদ আজাদীকে বলেন, সেবাগ্রহীতারা যাতে ভোগান্তির শিকার না হন এবং সহজে ও নির্বিঘ্নে যাতে সেবা পান, সেদিকেই আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকে। তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব হতে পারে। যেমন- সময় মতো পুলিশ রিপোর্ট পাওয়া না গেলে বা বিরূপ (নেগেটিভ) পুলিশি রিপোর্ট এলে, পূর্ববর্তী পাসপোর্টের সাথে নতুন আবেদনের তথ্যে গরমিল থাকলে, আবেদনের সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদের তথ্য গরমিল থাকলে এবং পূর্ববর্তী থাকা পাসপোর্ট গোপন করে আবেদন করা হলে পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব ঘটে। এছাড়া অনেকেই এনআইডি বা জন্মনিবন্ধন সনদে তথ্য পরিবর্তন করে নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে থাকেন। কিন্তু এনআইডি বা জন্মনিবন্ধন সার্ভারে পরিবর্তনকৃত তথ্য আপডেট বা হালনাগাদ করা হয় না। এতে করে পাসপোর্ট আবেদনের সাথে এনআইডি বা জন্মনিবন্ধন সার্ভারের তথ্যে গরমিল দেখা যায়। আর তথ্য গরমিল থাকলে সার্ভারে ওই তথ্য হালানাগাদ না হওয়া পর্যন্ত পাসপোর্ট আটকে থাকে। এসব বিষয়ে সেবাগ্রহীতাদের অনেকেই পাসপোর্ট অফিস নিয়ে ভুল ধারণা পোষণ করেন। যা ঠিক নয়। প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেবাগ্রহীতা এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। আমরা তাদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি।
সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তিহীন সেবাদানে আন্তরিক চেষ্টা থাকলেও জনবল সংকটে সেটি সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. আবু সাইদ। বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের আগস্টে এই অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় কর্মকর্তা-কমচারী মিলিয়ে মোট জনবল ছিল ৩১ জন। তবে এর প্রায় এক যুগ গত হলেও জনবল আর বাড়েনি। বরং কমেছে। বর্তমানে ২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে এই অফিস চলছে। অথচ, দশ বছর আগে দৈনিক সর্বোচ্চ ৫০০ পাসপোর্টের আবেদন জমা পড়তো। আর এ সংখ্যা বর্তমানে প্রায় দ্বিগুণ। দিন দিন এ সংখ্যা আরো বাড়ছে বলে জানান বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. এনায়েত উল্লাহ।
এদিকে, মোট জনবল ২৮ জন থাকলেও সরাসরি পাসপোর্ট সেবায় কাজ করেন অফিস সহকারী বা ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদের স্টাফরা। এই পদে সর্বোচ্চ ১০ জন স্টাফ রয়েছে বলে জানান পাসপোর্ট অফিস সংশ্লিষ্টরা। এই জনবলে আবেদন জমা গ্রহণের দুটি, ছবি তোলার ৮টি এবং পাসপোর্ট ডেলিভারির ৩টি কাউন্টার চালু আছে। কিন্তু অত্যধিক চাপে এই সংখ্যক কাউন্টার পর্যাপ্ত নয়। ফলে সেবা প্রত্যাশী মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। জমা গ্রহণে অন্তত ৪টি, ছবি তোলায় অন্তত ২০টি এবং পাসপোর্ট ডেলিভারিতে অন্তত ৫টি কাউন্টার প্রয়োজন বলে জানান বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. আবু সাইদ। আর কাউন্টার বাড়াতে হলে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর বা অফিস সহকারী পদে অন্তত আরো ১০ জন জনবল জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। এছাড়া সহকারী পরিচালক পদে আরো ৬ জন কর্মকর্তা প্রয়োজন বলে জানান পরিচালক। চাহিত জনবল পেলে সেবা প্রত্যাশীদের আরো সন্তোষজনক সেবা দেয়া সম্ভব বলে মনে করেন পরিচালক মো. আবু সাইদ।