আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষের কাজ হলো বিতর্ক সৃষ্টি করা। বিতর্ক সৃষ্টি করতে না পারলে যেন তাঁদের পেটের ভাত হজম হয় না। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই সুন্দর, ভ্রাতৃপ্রেমী, মানবতাবাদি,সমপ্রীতির শ্লোগানটি নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। ধর্মীয় বিধানের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে সূক্ষ্ম ভাবে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির পথ সুগম করা হচ্ছে। হাজার হাজার বছর ধরে সৌহার্দ্য ও সমপ্রীতি নিয়ে একত্রে বাস করা ভিন্নমতের,ভিন্ন ধমের্র মানুষের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টির ‘ঘৃণ্য কাজটি’ করে তাঁরা ‘মানবতা বিরোধী অপরাধ’ করছে বলেই ধারণা করা যায়। তাঁদের কেউ কেউ এমন ভাবে বলেন, যেন তাঁর উপর আল্লাহ পাক ওহী নাজিল করেছেন বা গায়েবি নির্দেশ পাঠিয়েছেন যে,এটা তাঁকে বলতেই হবে।
এটা স্বীকার্য যে, ধর্ম আর উৎসব এক নয়। উৎসব হলো সংস্কৃতির অংশ। আমাদের দেশে ঈদে সেমাই খাওয়ানো হয়। ঈদের নামাজ ধর্মীয় বিধান। কিন্তু সেমাই রান্না করা বা খাওয়া ধর্মীয় বিধান নয়, সেটা সংস্কৃতি। দেশ ভেদে ধর্মীয় রীতি এক হলেও সংস্কৃতি ভিন্ন হয়। ঈদ উল আযহাতে পশু কোরবানি দেয়া এবং ঈদের নামাজ ধর্মীয় বিধান। কিন্তু রুটি-পরোটা-বাকরখানি খাওয়া ধর্মীয় বিধান নয়, এটা সংস্কৃতি। তেমনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মণ্ডপের পূজা তাঁদের ধর্মীয় বিধান, আর পূজা উপলক্ষে তাঁদের বাড়িতে খাবারের আয়োজন সংস্কৃতি। আমি অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে দেখেছি, নামাজের সময় মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, আর নামাজ শেষ হলে বন্ধুর সাথে তাঁর বাড়িতে গিয়ে খাবার খেয়েছেন। আমরা যদি একটু বিশ্লেষণে যায়, তাহলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’-এই স্লোগানটির দু’টি সম্ভাব্য অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
১. এক পক্ষ ভাবেন, ধর্ম যার যার হলে উৎসবও তাঁর তাঁর হওয়াই যৌক্তিক। নইলে এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের উৎসব করলে নিজের ধর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
২. দ্বিতীয় পক্ষের ব্যাখ্যা হলো, ধর্মীয় সিদ্ধান্ত যার যার ব্যক্তিগত। আমি যে ধর্মেরই হই না কেন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বন্ধুর বাড়ি যাবো, তাঁর ধর্মীয় বিধান পালন করবো না, কিন্তু তাদের বাড়িতে খাবো, তাঁকে শুভেচ্ছা জানাবো, আমার বাড়িতেও সে আসবে।এই পক্ষ মনে করেন, এতে নিজ ধর্মের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। উপরে বর্ণিত দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে।
তবে এই দুইয়ের বাইরেও একটি অর্থ আছে। যা বিশ্লেষণ করলে বরং এই স্লোগানের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়ে যায়। যেমন, আমরা দেখি যে, মুসলমানদের ঈদে প্রচুর জামা-কাপড়, শাড়ি-গয়না বিক্রি হয়, চাঁদ রাতে তো দোকানিরা ঘুমাতে পারেন না। এসব দোকানি-বিক্রেতা কি সবই মুসলিম! বিক্রেতাদের অনেকেই কিন্তু হিন্দু। অন্যদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজায় প্রচুর কেনা- কেটা হয়, শাড়ি-গহনা- খাবার- পোশাক- বাজনা বিক্রি হয়, বিক্রেতা অধিকাংশ কিন্তু মুসলিম। এভাবে ঈদের উৎসবে হিন্দু-বৌদ্ধ ব্যবসায়ী, আর পূজার উৎসবে মুসলিম ব্যবসায়ী জড়িয়ে যায়,আর্থিক ভাবে লাভবান হয়। এই জড়ানো বা আনন্দের মানে এই না যে, তিনি(হিন্দু) মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লেন বা মুসলিম ব্যবসায়ী মন্দিরে গিয়ে পূজা দিলেন। কিন্তু ঈদ বা পূজার সময়ের ‘বাই-প্রোডাক্ট’ হিসেবে হলেও তাঁরা অংশ নিলেন এবং তাঁর মনে শান্তি এলো। এভাবে একজন আরেকজনের উৎসবে শামিল হলেন। তাহলে প্রশ্ন হলো, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ কথাটির বিরোধিতা করলেও কোনো ব্যবসায়ীই কি অন্য ধর্মের উৎসবের সময়ে বসে থাকেন? থাকেন না। এভাবে উৎসব সবার হয়ে যায়।
তেমনি ভাবে ঈদ ও পুজোর ছুটিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ভাই-বোনেরা ছুটি পান। এই ছুটির আনন্দ শুধুই কী একটা ধর্মের লোক উপভোগ করেন? যারা ‘উৎসব সকলের’ বললে রেগে যান, সেই ব্যক্তিরা কী অন্য ধমের্র উৎসব উপলক্ষে ছুটি কাটাবেন না? কোরবানির ঈদে যে পশু কোরবানি হয়, তার সব কি মুসলিমের ঘরের পশু? পূজায় যে ডেকোরেশন করা হয়, তার সব কি হিন্দু ডোকেরেশন হাউস থেকে ভাড়া হয়? একটা উৎসব উপলক্ষে অর্থের একটা প্রবাহ কিন্তু ঠিকই তৈরি হচ্ছে। এভাবে অন্য ধর্মের আয়োজনে আমরা যাই বা না যাই, দেশে যে উৎসব তৈরি হয়েছে তাতে আমরা ঠিকই শরীক হচ্ছি (সেটা জেনে বা না জেনেই)।
এখন দেখা যাক, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে ধর্মের বিধান কি। হযরত মুহাম্মদ(সা.) অসংখ্যবার অমুসলিমদেরকে নিজের বাড়িতে মেহমান বানিয়েছেন এবং নিজেও ইহুদির দাওয়াত কবুল করেছেন। তাই ইসলামিক স্কলাররা অমুসলিমদের দাওয়াত গ্রহণ করা জায়েজ ও বৈধ বলেছেন। তথ্যসূত্র : বুখারি শরিফ, হাদিস নং-২৬১৭, মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-৫৩৬৪। আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী (সা.)-কে দুমাত-এর (একটি স্থান) উকাইদির (রাজা) একটি রেশমী কাপড় উপহার দিয়েছেন। তখন তিনি সেটা আলী (রা.)-কে দিয়ে বললেন: ‘এটাকে কেটে খিমার (নারীর অবগুণ্ঠন) বানিয়ে ফাতেমাদের দাও। ’ (বুখারি শরিফ, হাদিস: ২৪৭২; মুসলিম শরিফ, হাদিস: ২০৭১) পবিত্র কোরানের সূরা মায়েদা’য়(৫১) বলা হয়েছে : “হে মুমিনগণ,তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।” এই আয়াতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে বন্ধুত্বে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু আবার পবিত্র কোরানের সূরা মুমতাহিনা’য়(৮,৯) বলা হয়েছে, “যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নি এবং তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কার করে নি, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করতে ও তাদের প্রতি ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের-কে ভালোবাসেন। আল্লাহ তো তোমাদেরকে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করার কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারা জালিম।” তাহলে এখানে কি বুঝা গেলো! বিধর্মীদের মধ্যে যারা মুসলমানদের অত্যাচার করেননি, ঘরবাড়ি হতে বের করে দেননি, যুদ্ধ করেননি, মূলতঃ তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করা হয় নাই। (কিন্তু আমাদেরকে প্রথমটাই শিক্ষা দেয়া হয়)। তাই,যারা মুসলিমদের ক্ষতি করেননি এবং ভাল স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী, মানবিক গুণ সম্পন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে বন্ধুত্বে বাঁধা নাই। আবার সূরা আল ইমরান’র ২৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে,, ‘মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ‘ছেড়ে’ কোনো কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’ এই আয়াতের স্পষ্ট ও চমৎকার ব্যাখ্যা হলো, ‘কোন মুমিন বন্ধুকে ছেড়ে’ যেনো কাফিরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ না করে। আমাদের কেউ তেমনটি করেন না। আমাদের বন্ধু তালিকায় মুমিন যেমন আছেন, তেমন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীও আছেন। আমরা কোন মুসলিম ভাইকে বাদ দিয়ে তাঁর স্থানে কাউকে বন্ধু বানাচ্ছি না। আমরা সবাই জানি বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরান নাজিল করেছেন। সুতরাং কোরানের আয়াত নাজিলের কারণ না বুঝে কোরানের ব্যাখ্যা করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে (যার প্রমান আমরা দেখছি)। এজন্য মৌলানাদের মধ্যে বহুধা বিভক্তি রয়েছে। একজন আরেকজনকে অবলীলায় কাফের ফতোয়া দিয়ে থাকেন। ড. জাকির নায়েকের মত ধর্মীয় মহাজ্ঞানী মানুষকেও কিছু মৌলানা কাফের আখ্যায়িত করে থাকেন। অথচ বর্তমান শতাব্দীতে তাঁর মত ইসলামি স্কলার আর একজন নাই।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সস্তা বাহবা নেয়ার জন্য অমুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। আবার ভারতেও মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর দৃষ্টান্ত রয়েছে। যা নিন্দনীয়। ইসলামে অমুসলিমদের সম্পর্কের বিষয়ে অর্থাৎ বিধর্মী প্রতিবেশির সাথে শালীন ও সুন্দর আচরণ করা, বিপদে তাদের সহযোগিতা করা, প্রতিবেশী হলে তাদের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য ইসলামে নির্দেশনা আছে। এমর্মে আল্লাহ পাক বলেন, ‘কোনো অমুসলিম প্রতিবেশী বা উপকারকারী মারা গেলে তার জন্য সমবেদনা প্রকাশ করার অবকাশ আছে। এক্ষেত্রে তার পরিবারস্থ লোকদেরকে সান্ত্বনা দিতে পারেন বা তাদের সহযোগিতা করতে পারেন। (তাফসীরে রূহুল মাআনী ২/২৩ তাফসীরে কুরতুবী ২/১১৯ ও ১৮/৪০। নবী করিম (সাঃ) অমুসলিমদেরকে দান-সাদকা করারও অনুমতি দান করেন (তাফসিরে মাজহারি)। দান প্রসংগে- সুরা বাকারার ২৭২ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে ‘সঠিক পথে দানের বিষয়টি একান্ত তাঁর ইচ্ছাধীন’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর প্রতিদান প্রদানেও আল্লাহ কারো প্রতি জুলুম করবেন না-বলেও এই আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে।
সুতরাং একটি বিষয় স্পষ্ট যে,ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের যেভাবে ঘৃণা প্রকাশের ঘৃণ্য কাজ করা হয়, তা কিন্তু ধর্মে অনুমোদন নাই। একই সমাজে বাস করে মানুষে মানুষে ঘৃণা বৃদ্ধির এই আয়োজনকে কোন ক্রমেই সঠিক ধর্মীয় আচরণ বলা যাবে না। সব ধর্মেই ভাল-খারাপ মানুষ আছে। এটা ধর্মের দোষ নয়। মানুষের দোষ। আমাদের এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে, যেখানে সবাই যার যার ধর্ম পালন করে বন্ধুত্ব পূর্ণ পরিবেশে বসবাস করবে। স্ব স্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন শেষে সবাই একসাথে আড্ডা দেবে, রুচিসম্মত খাবার খাবে, উৎসবে অংশ নেবে। একজনের দুঃখে অন্যজন এগিয়ে আসবে। সবার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে এই দেশ হবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির দেশ। এখানে সবাই স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালন করবে, আর ধর্ম পালন শেষে সবাই জাতীয় সংস্কৃতির উৎসবে সামিল হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী