কয়েক শত বছর আগে বাংলার মধ্যযুগের এক কবি চন্ডীদাস (১৩৩৯–১৩৯৯) উচ্চারণ করেছিলেন মানব–ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী–
“সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”।
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। অথচ আমরা আমাদের বিভিন্ন কাজের দ্বারা সমাজে প্রতিনিয়ত ভেদাভেদের মাধ্যমে উঁচু–নীচু, ধনী–দরিদ্র এসব পার্থক্য সৃষ্টি করে চলেছি। সৃষ্টি হয়েছে বর্ণভেদ প্রথা। মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব বিরোধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। হিংসায় উন্মত্ত হয়ে, রক্ত ঝরছে মানুষেরই। সকল বিরোধ অবসানের লক্ষ্যে মানুষকে মানুষের যথার্থ মর্যাদা দান করতে হবে। মানুষকে ছোট বা হেয় করা নয় বরং একই স্রষ্টার সৃষ্টির মধ্যে কোনো ব্যবধান খুঁজে বের করা অন্যায়।
ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, উগ্র রাজনীতি, দেশ ও ভৌগলিক সীমারেখার বাইরে ‘মানুষ’–সে কত উপরে তা অনুধাবনের জন্য নীচের সংগৃহীত গল্পটি সবার সাথে শেয়ার করছি।
কুসুমদিয়ার ফকিরের নাম শের আলী। তিনি আমাদের বাড়ি আসতেন। মা তার জন্য সেহেরী রাঁধত। ফকির পরদিন রোজা রাখতেন। তিনি বেশ শোলোক সন্ধান করতেন।
একদিন ফকির সাহেব আমাকে বলল, বেটা, তোমাকে যদি জঙ্গলে ছাইড়া দেওয়া হয় এবং সে জঙ্গলে বাঘ–ভালুকের মধ্যে কিছু্িদন থাকার পরে যদি কিছু মানুষের সন্ধান পাও–তাইলে কি করবা?
বললাম, মানুষগুলোর কাছে দৌড়ে যাব।
তিনি শুধালেন, তুমি কি তাগো কাছে যাওয়ার আগে জানতে চাইবা সে আমেরিকান, না আফ্রিকান? পাকিস্তানী কি ইন্ডিয়ান? হিন্দু,না খ্রীস্টান? বাওন না নমু শুদ্র?
–সেটা জানার কোনো দরকারই নাই। জঙ্গলের মধ্যে মানুষের সন্ধান পাইছি, সেইটাই প্রধান কথা।
ফকির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বেটা, একটু কাছে যাইয়া দেখলা তারা নানা পদের মানুষ। আমেরিকানও আছে, আফ্রিকানও আছে। ইন্ডিয়ান আছে, অস্ট্রেলিয়ানরাও আছে। কাগো কাছে যাইবা?
–ইন্ডিয়ানদের কাছে।
ফকির সাহেব বললেন, বেটা, তাগো আরো কাছে গিয়া শুনলা, তাগো মধ্যে কেউ বাংলায় কথা কয়। কেউ ইংরেজিতেও কথা কয়। কেউ চিনা কয়। কেউ ফরাসি কয়। তুমি কার কাছে যাইবা?
–বাংলায় কথা বলার লোকদের কাছে যাব আগে।
ফকির সাহেব শুধালেন–এরপর কারে খুঁজবা?
উত্তর দিলাম–আস্তিক হইলে আমার ধর্মের লোকদের খোঁজ করব। নাস্তিক হইলে নাস্তিকদের খুঁজব।
ফকির সাহেব বললেন, বেটা, চিন্তা কইরা দেখো–দূর থেইকা সবার আগে মানুষ দেখতে পাইতেছো। তারপর একটু কাছে যাইয়া তোমার চেনা চেহারা খুঁজতেছো। তারপর যখন ভাষার শোনার সুযোগ পাইলা তখন তুমি তোমার নিজের ভাষার লোক খুঁজতেছো। তাগো কাছে গিয়া জিজ্ঞেস কইরা জানলা–তাগো মধ্যে কেউ তোমার ধর্মের লোকও আছে। তখন তোমার ধর্মের লোকের কাছে যাইতেছো। এর আগে না।
আমাদের মুখে কোনো কথা নেই। ফকির সাহেব হাসি হাসি মুখে চোখ বন্ধ করলেন। এরপর তিনি নামাজে বসবেন। তার আগে বললেন, বেটা, মানুষই আগে। তারপর দেশ বা ভাষা। এরপরে ধর্ম।
আমরা সকলেই সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করি। কেউ আল্লাহ্ ডাকি, কেউ ঈশ্বর, কেউ ভগবান। এক এক ধর্মের মানুষ আমরা ভিন্ন ভিন্ন ঈশ্বরে বিশ্বাসী। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা একজনই।
আমরা মানুষ। ধর্ম অথবা জাতীয়তাবোধ যাই বলি না কেন, আমরা নিজ ধর্ম বা নিজ জাতিসত্তার মানুষকে ছোটবেলা হতে আপন ভাবতে শিখি, তেমনি তাদের প্রতি কোনো বিষয়ে বিচার–বিবেচনা ছাড়া, শুধুমাত্র আবেগ ও অন্ধ বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকি, একই সাথে অন্য ধর্ম এবং জাতিসত্তার মানুষের প্রতি সুকৌশলে দূরত্ব সৃষ্টি করে, অর্থনৈতিক আধিপত্য ও আগ্রাসন চালানোর চেষ্টা করি।
বিশ্বময় মানবিক মূল্যবোধ স্থান–কাল–পাত্রভেদে সব সময়ের জন্য জেগে উঠুক। মানবিক মূল্যবোধ যেমন–দয়া, সহমর্মিতা, ন্যায়বিচার, সততা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ইত্যাদি সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে এবং মানুষের মধ্যে ঐক্য ও শান্তি বজায় রাখতে সহায়তা করে। ধর্মান্ধতা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ ছাপিয়ে ‘মানুষ’, শুধুই ‘মানুষ বড়’ –এ প্রত্যাশা হোক আজ।