সবার উপরে মানবতা

ড. মনজুর-উল-আমিন চৌধুরী | মঙ্গলবার , ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল মানবিক সমাজ, বৈষম্যহীন সমতার সমাজ। ভোট, ভাত, গণতান্ত্রিক অধিকার, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রতিরোধই ছিল সে দিনের দ্রোহের মূল চেতনা।
আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার হচ্ছে – মানবিক সমাজ, ন্যায্যতার সমাজ, আইন তথা রাষ্ট্রের কাছে সকল নাগরিকই সমান। “যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় আমরা তার কথা মেনে নেব” – ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এই ‘ন্যায্যতাই’ হচ্ছে মানবতা – মানবাধিকার, যেখানে সংখ্যালঘিষ্ঠের ‘ন্যায্য কথা’ সংখ্যাগুরুর গ্রহণের স্পষ্ট ঘোষণা – সর্বক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে মানবতা।
ল্যাটিন “ Humanitas” (অর্থ হচ্ছে মানব প্রকৃতি, মনুষ্যত্ব, উদারতা, দয়াপরবশ) থেকে ইংরেজি Humanity – বাংলায় মানবতা। মানবতা হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম গুণ ভাব প্রভৃতি, মানুষের সদগুণাবলী, মনুষ্যত্ব, মানববিকতা। মানবতার আবশ্যকীয় শর্ত / পূর্বশর্ত হচ্ছে : ১) Compassion – সমবেদনা ২) Empathy – সহানুভূতি, অন্যের আবেগ অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ক্ষমতা ৩) Honesty – সততা ৪) Integrity অখণ্ডতা ৫) Trust & Loyalty – বিশ্বাস ও আনুগত্য ৬) Mutual Respect – পারস্পরিক সম্মান / শ্রদ্ধাবোধ ৭) Fairness & Justice – স্বচ্ছতা, ন্যায় বিচার ও ন্যায় পরায়ণতা। মানুষের সদগুণাবলী অনুশীলন এবং মানুষের স্বাভাবিক গুণ বা বৈশিষ্ট্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপই মানবতাবাদ।
চন্ডীদাস বলেছেন, ‘শুনো হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। মানবতার কেন্দ্রে ‘মানুষই’। বিপদের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কারো দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ না করাই হচ্ছে মানবতা। শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-অনাত্মীয়, অবিশ্বাসী, বিধর্মী সবাইকে শুধু মানুষ বিবেচনা করে প্রয়োজনের সময় নিঃস্বার্থ, নিঃশর্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াই হচ্ছে মানবতা। মানুষকে সম্মান করতে পারাটা বোধ হয় সবচেয়ে বড় মানবতা।
যে বাচ্চা তার মাকে অপমানিত -লাঞ্ছিত হতে দেখে বড় হয় পরবর্তী জীবনে সে বাচ্চা অমানবিক হলে অবাক হবার কিছুই নেই, কারণ অমানবিকতার বীজ তার মনোজগতে আগেই রোপিত হয়েছে। একজন বৃদ্ধ মানুষ বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিকে রাস্তা পারাপারে সাহায্যে করলেন এটাও মানবতা। কাউকে নির্যাতিত হতে দেখে এগিয়ে এলেন, প্রতিবাদ করলেন এটাও মানবতা। এরকম ছোট ছোট সহযোগিতাগুলোই মানবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, দুর্ভিক্ষ, মহামারী; যুদ্ধ, দাঙ্গা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, লোকরঞ্জনবাদী গণতন্ত্র তথা রাজনীতির লেবাসেই মোটা দাগে মানবতা লঙ্ঘিত হয় প্রতিনিয়ত। অতিমারী কোভিড-১৯ সংক্রমণের কালে দেখা গেছে শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই নারী ও শিশুর প্রতিই নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, হত্যা বেড়ে গেছে। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়ানক অমানবিকতা হলো নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ এমন কি হত্যা। পরিতাপের বিষয় আইনের ফাঁকফোকর, বিশেষ ক্ষমতায় ক্ষমা , রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার কিংবা কূটকৌশলে এসব অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এর এক দশকেরও বেশি সময়ের মামলার উপর গবেষণায় দেখা যায় সাজা হয়েছে মাত্র ৩(তিন) শতাংশের। Culture of impunity অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার এই কু-নজির অপরাধীদের উৎসাহিত করছে ফলত মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে পদে পদে।
সুশাসন তথা আইনের শাসন মানবতার রক্ষা কবচ। ‘ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট বহুবছর ধরে বিশ্বব্যাপী আইনের শাসন পর্যবেক্ষণ করে থাকে। আগের কয়েক বছরের মতো এ বছরও তাদের র‌্যাঙ্কিংয়ে আইনের শাসনে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে (১২৮টি দেশের মধ্যে ১১৫)। সিভিল আর ক্রিমিনাল জাস্টিস মানদণ্ডে এ অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান ছয়টি দেশের মধ্যে পঞ্চম’। (প্রথম আলো, ৩০ অক্টোবর ২০২০)।
করোনাকালে মানবতার নিঃশব্দ পতন আমরা দেখেছি। করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধা মাকে জঙ্গলে রেখে আসা, করোনা আক্রান্ত বাবাকে ঘরে তালা মেরে ছেলের সপরিবারে বাইরে চলে যাওয়া, করোনায় মৃত ভাইয়ের লাশ গ্রহণে অস্বীকৃত জানানো পদস্থ কর্মকর্তার কথা আমরা জেনেছি। পাশাপাশি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রামের আল-মানাহিল ফাউন্ডেশনসহ অনেকের (ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান) ত্রাণ, সেবা, চিকিৎসা ও দাফন সৎকারের সাহসী উদ্যোগ আয়োজন করোনা ভীতিতে ত্রস্ত মানুষের মনে আশাবাদ জাগিয়েছে। আমরা জোয়ান অব আর্ক, আলফ্রেড নোবেল, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, মাদার তেরেসা, পৃথিবীর অন্যতম সেবা সংগঠন লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল তথা লায়নিজমের জনক মেলভিন জোনস, মাদার তেরেসা, হাজী মোহাম্মদ মহসিন, রণদা প্রসাদ সাহা প্রমুখের কথা জানি। করোনা সংকটে এই সম্মুখ যোদ্ধারাই হচ্ছে তাঁদের প্রকৃত অনুসারী সেবক, মানবতার দূত।
মানবতা : ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ
খ্রীষ্টান ধর্ম : খ্রীষ্টান ধর্ম তথা পবিত্র বাইবেলে আছে (১) Kindness – দয়া, (২) Altruism পরার্থবাদ, পরার্থিতা (৩) Love – ভালবাসা। খৃষ্ট ধর্মের মূল কথাই হচ্ছে “ It is better to give than to receive” এ প্রসঙ্গে আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসেনি কেউ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে ু স্মর্তব্য।
বৌদ্ধ ধর্ম : মহামতি গৌতম বুদ্ধের বাণী হচ্ছে:
(১) সর্ব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু – জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। (২) সর্ব্ব দুঃখখা বিনা শান্তু – মানুষ সর্ব দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করুক। (৩) নির্বাণং পরমং সুখং – বন্ধন মুক্ত হলেই পরম সুখ। সকল মানুষ কামনা, বাসনা, লোভ, দ্বেষ, মোহ ও তৃষ্ণা (আসক্তি) হতে মুক্তি লাভ করুক – এটাই বন্ধন মুক্ত হওয়া।
সনাতন ধর্ম – হিন্দু ধর্ম :
(১) ব্রহ্ম সর্ব খলবিদং – বেদ, অর্থাৎ সর্বজীবে ব্রহ্ম বিরাজমান। (২) যত্রজীব তত্র শিব – বেদ, অর্থাৎ প্রত্যেক জীবের মাঝে ভগবান শিব বিরাজমান। (৩) শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিসৃত বাণী হচ্ছে : চাতুর বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণ কর্ম বিভাগশঃ অর্থাৎ গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি চারটি বর্ণের সৃষ্টি করেছি।
ব্রহ্ম- শিবের কাছে জাতপাত নেই – সর্বজীবে বিরাজমান। শিশুকে তো দেব শিশুই বলা হয়। মুসলমানদের প্রচলিত ধারণায় শিশুর সাথে ফেরেশতা থাকে।
ইসলাম ধর্ম :
ইসলাম হচ্ছে ইনসানিয়াত তথা মানবতার ধর্ম। পবিত্র কোরআনে আছে ‘লাকাদ খালাকনাল ইনসানা ফি আহসানে তাকবীম’ অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন আমি মানুষকে সুন্দর আকৃতি/অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছি অতএব – মানুষের মর্যাদা সর্বাগ্রে, জীবিত বা মৃত্যুর পরেও। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য নবী মোহাম্মদ (সঃ) একদিন তাঁর সহচরদের নিয়ে বসে আলাপ আলোচনা করছিলেন এমনি সময় এক ইহুদীর কফিন নিয়ে যাচ্ছিল। নবী সপরিষদ দাঁড়িয়ে সম্মান জানান এতে তাঁর সহচররা জিজ্ঞেস করলেন হুজুর এ তো ইহুদী আপনি কেন দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন তখন নবী তাঁদের বললেন, সে মানুষ। আল্লাহর বিধান হচ্ছে মানুষের মর্যাদা সর্বাগ্রে। লক্ষ্য করবেন তিনি মদীনা সনদ করলেন অবিশ্বাসীদের সাথে, এতে নবী অবিশ্বাসীদের স্বীকার করে নিলেন, অবিশ্বাসীরাও ইসলাম ও নবীকে স্বীকার করে নিলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন’ অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার জন্য আমার ধর্ম আমার জন্য। অন্যত্র তিনি বলেছেন ‘ লা ইকরা হা ফিদদিন’ – ধর্মে জবরদস্তি / বাড়াবাড়ি নেই। বিদায় হজ্বের ভাষণে হযরত মোহাম্মদ (দঃ) হাবসী কৃতদাস ও যদি উপযুক্ত হয় তাঁকে নেতা মানার নির্দেশনা দিয়েছেন। অথচ ধর্ম ও বর্ণের দোহাই দিয়েই স্বার্থবুদ্ধির মানুষ মানবতাকে ক্ষত বিক্ষত করছে প্রতিনিয়ত। ইসলাম ধর্মে জাকাত প্রদানের যে বিধান রয়েছে তা ও হতদরিদ্র আর্তমানবতার জন্যই।
মানবতা: বৈশ্বিক উদ্যোগ
মানুষ তথা মানবতাকে ন্যূনতম সুরক্ষা দেওয়ার জন্যই বিশ্বের ৭৫০ কোটি মানুষের জন্য মানসম্মত জীবন-জীবিকা,শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার ও পরিবেশ নিশ্চিতের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের উন্নয়ন পথ নকশা – Sustainable Development Goals (SDGs) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া কর্পোরেট হাউসগুলোর Corporate Social Responsibility (CSR) সামাজিক দায়বদ্ধতার কার্যক্রম ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই।
সমাজ বিজ্ঞানী peter L. Berger বলেন, ‘ It was there before we were born and it will be there after we are dead. Our lives are but episodes in its majestic march through time. Insome society is the walls of our imprisonment in History.’
জগত সংসারে সবই থাকবে থাকবনা আমি আপনি। এই স্বল্প আয়ুর জীবনে যদি মানুষ ও মানব হিতৈষণা তথা মানবতার তরে কিছু অবদান রাখা যায় সেটাই হচ্ছে মানব জন্মের স্বার্থকতা।
আসুন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণে একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ায় আমরা স্ব স্ব অবস্থান হতে সচেষ্ট হই।
লেখক : সমাজবিজ্ঞানী ও সিনেট সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান ঘাসফুল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালির মুক্তির সংগ্রামের ৫০ বছরেও কতিপয় বামপন্থীদের বিভ্রান্তি দূর হলো না
পরবর্তী নিবন্ধসোমালিয়ায় হোটেলে হামলায় নিহত ৯