চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। এবার হার হলো ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গতবার পাসের হার ছিল ৮০ দশমিক ৫০ শতাংশ। এবার জিপিএ–৫ পেয়েছে ৬ হাজার ৩৩৯ জন। গতবছর পেয়েছিল ১২ হাজার ৬৭০ জন। কেন এমন বিপর্যয়! তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন পত্রিকায়।
তুলনামূলক বিচারে ফলাফল ভালো না হওয়ার জন্য ‘পরিস্থিতি’কে দায়ী করেছেন তাঁরা। বলেছেন, ফলাফল খারাপ হয়েছে এমনটি বলা যাবে না। গত তিন বছরের তুলনায় ‘জিপিএ কম’ হওয়ার পেছনে ‘পরিস্থিতি’ দায়ী। বিশেষ করে করোনাকালে পুরো সিলেবাসে পরীক্ষা না হওয়া ছাড়াও এবার চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরীক্ষা পেছানো এবং বন্যায় বহু ছাত্রছাত্রী লেখাপড়ার পরিবেশ হারিয়ে ফেলায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সদ্য প্রকাশিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণে যা দাঁড়ায় তা হলো, পাসের হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কম এবং জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম হলেও ফলাফল খুব একটা খারাপ বলা যাবে না। এ কথা সত্যি যে, গত এক বছরে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা না বাড়লেও আসনের কোনো কমতি নেই। আজাদীতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে এবার আসন সংকট হবে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আসন বেড়েছে বলে জানা গেছে। বরং বিষয়টি এমন যে বেশ কিছু আসন বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খালি থাকার সম্ভাবনা। ধারণা করা হচ্ছে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবে না। গত শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতিতে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সময়মত ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেনি। বেশ কয়েকবার অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হয়েছে। এমন অবস্থায় সদ্য পাস করা শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়েও সমস্যা হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যখন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম ছিল তখন ভর্তি হওয়া ছিল বড় প্রশ্ন। কিন্তু এখন প্রতিষ্ঠান ও আসনের সমস্যা নেই, কিন্তু শিক্ষার্থী সংকট। প্রশ্নটি কি মানের, নাকি উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যাওয়া, নাকি আর্থিক সমস্যার কারণে অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের পড়াতে পারছেন না। সরকার, শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক ও সচেতন মহলকে ভাবতে হবে আমাদের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা যথেষ্ট মানসম্মত কি না। পরিসংখ্যান দিয়ে চিন্তা করতে হবে আমাদের উচ্চশিক্ষা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে। বিষয়গুলো বিবেচনায় না আনলে একটা সময় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। মানবসম্পদের চাহিদা দেশে যেমন বড় তেমনি আমাদের শিক্ষার্থীরা বিদেশেও লেখাপড়া ও কাজের সুযোগ পাচ্ছে।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে তিনটি– চাকরিজীবী সৃষ্টি করা; সংস্কৃতির ভদ্রলোক সৃষ্টি করা এবং বিবেকবান ও সৃজনশীল মানুষ সৃষ্টি করা। হয়তো প্রথম উদ্দেশ্য অর্থাৎ চাকরিজীবী সৃষ্টি হচ্ছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু বাকি দুটি পথ অর্জন যে সহজ নয় সেটা অনুমেয়। এদিকে ‘সংস্কৃতিচর্চা‘ কথাটি শুনলেই কেউ কেউ মনে করেন, গানুবাজনা, নাচ, কবিতা আবৃত্তি মানেই সংস্কৃতিচর্চা। তারা ভুলে যান, আমাদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। মানুষ যা ভাবে, যা বলে, যা করে সবই তার সংস্কৃতির অংশ। একজন মানুষ, দু‘জন মানুষ, দশজন মানুষের চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড দিয়ে যখন সমাজ এগিয়ে যায়, তখন সেটিই হয়ে ওঠে তাদের সংস্কৃতি।
অনেকে মনে করেন, শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটানো বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতিতে দুরূহ হয়ে পড়েছে। বন্ধ প্রকোষ্ঠে শিক্ষার্থীরা বন্দি। স্বল্প পরিসরে শিক্ষার্থীরা সীমাবদ্ধ থাকায় তাদের মানসিক বিকাশ পরিপূর্ণভাবে হচ্ছে না। তাদের শিক্ষার পরিসর বৃদ্ধি করতে হবে। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে, এই বৈষম্য দূরীকরণে সরকারসহ সকলে সচেষ্ট। একইভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। আর এই বৈষম্য দূর করতে সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে। সমাজে সাংস্কৃতিক চর্চা যত বৃদ্ধি পাবে, মানবিক সমাজ ততই পরিপূর্ণতা লাভ করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের টেকনিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘাটতি রয়েছে। সেদিকে বেশি নজর দিতে হবে। উচ্চশিক্ষাকে একটি উন্নত ও মানসম্মত জায়গায় নিয়ে আসতে হলে প্রায় একই ধরনের কারিকুলাম প্রণয়ন এবং সরকারি ও বেসরকারি সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতিকেও একই মানে নিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শিক্ষাকে দেখতে হবে। সবার আগে দরকার শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া, বরাদ্দ বাড়ানো এবং শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদার দিকে নজর দেওয়া। নইলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা কখনো সম্ভব হবে না।