মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। বিশেষ করে জন দুর্ভোগ। এ দুর্ভোগ কেউ চায় না। তবুও দুর্ভোগের সীমা নেই। দুর্ভোগ থেকে মানুষ বেরিয়ে আসতে পারছে না। বের হওয়ার পথও খুঁজে পাচ্ছে না। সময় যতো যাচ্ছে এ দুর্ভোগ যেন ততো বেড়ে চলেছে। দুর্ভোগ কমানোর তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। কোথাও কোন উদ্যোগ নেয়া হলে তা পুরাপুরি কার্যকর হওয়ার আগে থেমে যায়। এতে করে দূর্ভোগ আরো বেড়ে যায়। কেউ কারো সুবিধা অসুবিধা দেখতে চায় না। যার ফলে নিজের দুর্ভোগও বেড়ে যায়। কেউ কাউকে ছাড় দিতেও রাজি না। ছাড় না দেয়ার কারণে সবাই আটকে থাকে। কাউকে আগে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ার মানসিকতা এখনো তৈরি হয় নি। মানসিকতার অভাব আমাদের অনেক আগে থেকে। অভাব না বলে দৈন্যতা বলা বেশি সমীচীন। দারিদ্র্যই ছিল একসময়ে আমাদের বড় বাধা। সে দারিদ্র্যকে আমরা অনেকটা অতিক্রম করতে পেরেছি। তখন দারিদ্র্য থাকলেও উদারতার অভাব ছিল না। অভাব অনটন দুঃখ কষ্টের মাঝেও মানসিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হতো। সংকোচিত মানসিকতার নয় উদার মানসিকতার পরিচয় দিতে চাইতো। অর্থ বিত্তের চেয়ে মন মানসিকতার গুরুত্ব কোথাও কম ছিল না। এ মন মানসিকতা দিয়ে একজন মানুষকে বিবেচনা করা হতো।
জীবন যাত্রায় আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি। আয়–ব্যয়ও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বেড়েছে। দৈনন্দিন জীবন যাপন, চলাফেরা, আচার অনুষ্ঠান, বিয়ে শাদী ইত্যাদিতে অনেক বেশি খরচ করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ক্লাব বা কমিউনিটি সেন্টার নির্ভর হয়ে ভোগান্তি বা ঝামেলা কিছুটা কমেছে কিন্তু আন্তরিকতা শূন্য হয়ে গিয়েছে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু–বান্ধব, অতিথি বা মেহমান যে যার মতো করে খেয়ে চলে যায়। কারো সাথে কারো তেমন একটা দেখা হয় না। আন্তরিকতাপূর্ণ আপ্যায়ন বা সোহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তা আগের মতো নেই। সবকিছু যেন আনুষ্ঠানিকতা নির্ভর হয়ে গিয়েছে। আসলে জীবন যাত্রা আড়ম্বরপূর্ণ হলেও মানের দিক থেকে আমরা তেমন অগ্রসর হতে পারিনি। অর্থাৎ জীবন যাত্রার মান অনেক ক্ষেত্রে পিঁছিয়ে পড়েছে। আন্তরিকতার চেয়ে সামাজিকতার বিষয়টি বড় হয়ে গিয়েছে। এতে করে যার সামর্থ আছে সেতো খরচ করছে, আবার যার নেই তাকেও করতে হচ্ছে। এটা কখনো সমাজের সুস্থ ধারা হতে পারে না। আবার এসব করেও মানুষ স্বস্তি পাচ্ছে না, তৃপ্তি পাচ্ছে না। আগে ঘরোয়া পরিবেশে বা বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে কতো আনন্দ হতো। সবাই মিলে মিশে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। সাধ্যের মধ্যে আয়োজন করা হতো। পাড়া প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজন সবার মাঝে পারস্পরিক সহমর্মিতার অকৃত্রিম বন্ধন আরো গাঢ় হয়ে যেতো।
অনেকে বলে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। রাস্তাঘাট অনেক প্রশস্ত হয়েছে, নতুন নতুন রাস্তা হয়েছে। কালভার্ট, ব্রীজ, সেতুর ছড়াছড়ি, হাইওয়ে, এলিভেটেড রোড, এক্সপ্রেসওয়ে’র মতো উন্নত যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। রেলপথ ও নৌপথেও নতুন নতুন অনেক কিছুর সংযোজন হয়েছে। সব ক্ষেত্রে যান বাহনের সংখ্যাও অনেক বেড়ে গিয়েছে। দূর পাল্লায়, বিলাস বহুল নিত্য নতুন যানবাহনের বহর বেড়েই চলেছে। প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যাও রাস্তার ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি। এত কিছুর পরও মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন হয়নি। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়াত সহজ হয়নি। বড় বড় শহরগুলোতে আধা ঘন্টার রাস্তা পার হতে দুই ঘন্টার বেশি সময় লাগে। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়িতে বসে থাকতে হয়। একদিকে কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে ফুয়েলের অপচয় হচ্ছে। তীব্র যানজট জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এর থেকে বের হওয়ার পথ কারো জানা নেই। আবার অনেক সময় মিটিং মিছিল করে রাস্তা আটকে রাখে। তখন জনদুর্ভোগের আর সীমা থাকে না। এসব নিয়ে কারো চিন্তা ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই, শিক্ষার্থীরও। শহরে কিন্ডার গার্টেন থেকে শুরু করে যেখানে সেখানে স্কুল গড়ে ওঠেছে। অলিগলিতে বাসা বাড়িতে স্কুলের রং বেরংয়ের সাইন বোর্ড দেখা যায়। সরকারি বেসরকারি স্কুলতো আছেই। আগে এতো বেশি প্রাইভেট স্কুল ছিল না। লেখাপড়া নিয়ে বাণিজ্য হতো না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল লেখাপড়া। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলা। শহরের স্কুলের ছেলে মেয়েরা তখনো লেখাপড়ায় এগিয়ে ছিলো। পরীক্ষায় গ্রামের ছেলেমেয়েদের চেয়ে ভালো ফলাফল করতো। তবে গ্রামের স্কুলের ছেলে মেয়েরা তেমন পিঁছিয়ে ছিলো না। গ্রামের স্কুলেও ভালো লেখাপড়া হতো। মেধা তালিকায় কোন কোন স্কুলের ছাত্রের নাম থাকতো। এখন গ্রামে–গঞ্জে অনেক স্কুল গড়ে উঠেছে। কিন্ডার গার্টেন স্কুলও। স্কুলগুলোতে শিক্ষকেরও কমতি নেই। কিন্তু লেখাপড়ার মান আগের মতো নেই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার স্কুলগুলোর ভর্তির বিড়ম্বনা।
ভালো স্কুলগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। অনেক স্কুল ডোনেশনের মাধ্যমে ভর্তি করায়। বিভিন্ন ধরনের ফি, চাঁদা প্রদান করে ভর্তি হতে হয়। ভর্তির পর শুরু নানারকম অনুষ্ঠান। পড়ালেখার চেয়ে বিভিন্ন দিবস উদযাপনে ব্যস্ত হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা উপস্থিত না থাকলে যেন দিবসগুলো উদযাপিত হয় না। ভর্তি ফি, এন্ট্রি ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি, পরীক্ষার ফি আরো কত ধরনের ফি আছে তার হিসাব কে করে। শিক্ষার্থীর নাম ঠিকানা ইত্যাদি অনলাইনে এন্ট্রি করতে হয়। নির্দিষ্ট ফি এর বাইরে অনলাইন চার্জ কম্পিউটারের খরচ আর কত কিছু প্রদান করতে হয়। সহজে ডাটা এন্ট্রি করতে গিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নেই। সরকারি ফি এর সাথে এসবের খরচ না দিলে নাম এন্ট্রি হয় না, রেজিস্ট্রেশন হয় না। এরপর পাবলিক পরীক্ষাসমূহে কোন কোন শিক্ষার্থী আর অভিভাবকের ভোগান্তির শেষ নেই। নাম, রেজিস্ট্রেশন, রোল নম্বর কোথাও গড়মিল হলে শিক্ষা বোর্ড পর্যন্ত দৌঁড়াতে হয়। এসব জায়গায় গেলেও সহজে সংশোধন হয় না। কয়েকবার গিয়েও অনেকে ঠিক করতে পারে না।
স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রেও ভোগান্তির শেষ নেই। একসময়ে টাকার অভাবে চিকিৎসা করা যেতো না। আবার গ্রামেগঞ্জে ভালো ডাক্তারও ছিল না। জেলায় উপজেলায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা কিছু থাকলেও চিকিৎসাসেবা নেই বললে চলে। যাদের আর্থিক সংগতি তেমন নেই তারা প্রাইভেট ক্লিনিকে যেতে পারে না। সরকারি হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। ঔষধ পত্র সব বাহির থেকে কিনে আনতে হয় কিন্তু চিকিৎসা ঠিকমতো পায় না। একজন রোগীর জন্য এর থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে। প্রায় প্রতিটি উপজেলা সদরে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি প্রাইভেট ক্লিনিক গড়ে ওঠলেও গ্রামের অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত থাকে। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় তা নয়। শহরে অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকে। বেশিরভাগ হাসপাতালের চিকিৎসা মানসম্পন্ন নয়।
সরকারি হাসপাতালে রোগী ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। হাসপাতালে বারান্দায় ফ্লোরে অনেক রোগী পড়ে থাকে। কখন ডাক্তার এসে ঔষধের নাম লিখে দেবে সে অপেক্ষায় থাকে। হাসপাতালের নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর কর্মচারীদের দৌরাত্মে রোগীদের সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে থাকতে হয়। প্রাইভেট হাসপাতালের ক্ষেত্রে হাতে গোনা কয়েকটা ছাড়া অন্যগুলোতে চিকিৎসা সেবার মান নিম্ন পর্যায়ে। প্রাইভেট হাসপাতালেও রোগীদের নানাধরনের ভোগান্তিতে থাকতে হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপারতো প্রায় সব রোগীকে মেনে নিতে হয়। হাসপাতালে ভর্তি হলে বিভিন্ন ধরনের চার্জ দিতে দিতে শেষ। কয়েকদিন থাকলে বড় অংকের টাকা পরিশোধ করতে হয়। এখানে রোগীর সাথে এ্যাটেনডেন্স থাকতে হয়। এটা সেটা বাহির থেকে কিনে আনতে হয়। এসব হাসপাতালেও অব্যবস্থাপনা ও রোগীর প্রতি অবহেলার ঘটনা অহরহ ঘটে। সরকারি বা প্রাইভেট কোথাও বিনা পয়সায় চিকিৎসা নেই। অর্থাৎ যার টাকা নেই সে চিকিৎসাও পায় না। তবে টাকা খরচ করেও ভালো চিকিৎসা না পেলে মানুষের যাওয়ার জায়গা থাকে না। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, পরিচালক বা কর্তৃপক্ষ কেউ সেবার মানসিকতা নিয়ে চিকিৎসা সেবার মতো মহৎ পেশার সাথে যুক্ত হয় না।
আইন শৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে মানুষের স্বস্তি নেই। সবখানে দুর্ভোগ আর ভোগান্তি লেগে থাকে। কোন একটি কাজ নিয়ম মাফিক সহজে করা যায় না। পদে পদে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। অনিয়মগুলো নিয়মে পরিণত হয়ে গিয়েছে। এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে কোন কর্তৃপক্ষ আছে বলে মনে হয় না। কোথাও বলে বা অভিযোগ করেও কিছু পাওয়া যায় না। মানুষ এর থেকে পরিত্রাণ চায়, বেরিয়ে আসতে চায়। এরজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। মন মানসিকতার সংস্কার। প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের চেয়ে মন মানসিকতার সংস্কার বা পরিবর্তন আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মন মানসিকতার সংস্কার না হলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার খুব একটা কাজে আসবে না এবং বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া যাবে না। এজন্য প্রতিষ্ঠান যারা চালাবে আর প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করবে তাদের সংস্কার সবার আগে করা দরকার। একইসাথে সেবা প্রদানকারী বা গ্রহণকারী উভয়ের মন মানসিকতার সংস্কার বা পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।