কর্মমুখর নগর জীবনে দু দণ্ড ফুরসৎ পাওয়া দুষ্কর। জীবনযুদ্ধে বছরের পুরো সময়টাই চলে যায় সংসারের চাহিদা মিটাতে। তাতেও সুখ নেই। পরিবারের সদস্যরা প্রত্যাশা করেন, ছুটির এ ক’টি দিনে একান্তে কোথাও বেড়িয়ে আসতে। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মিলন হওয়ার লক্ষণ তো নেই এ জীবনে। দূরে কোথাও নয়, সাধারণ মানুষ এবার কোরবানির ঈদের লম্বা ছুটিতে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে গিয়ে নীল জলরাশির বুকে খুঁজেছেন সুখের ঠিকানা। কেউ গেছেন ফয়’স লেক কিংবা চিড়িয়াখানায়।
চট্টগ্রামে এবার সবচেয়ে বেশি লোক সমাগম ঘটেছে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। এখানে ছিল লোকে লোকারণ্য। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে প্রবেশ মূল্যের প্রয়োজন হয় না। সকল শ্রেণী–পেশার মানুষের জন্য উন্মুক্ত সমুদ্র সৈকত তাই ছুটির দিনগুলোতে ছিল দর্শনার্থীদের পদভারে মুখর। একই অবস্থা দেখা গেছে ভাটিয়ারী গলফ ক্লাবের লেকেও। বিশেষ করে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে এসেছিলেন দূরদূরান্তের মানুষ। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন পর্যটকরা। সৈকতপাড়ের দোকানগুলোতে বিক্রি ছিল জমজমাট। দেখা গেছে, কেউ কিনছেন চুড়ি ফিতা, কেউ কিনে দিচ্ছেন। কেউ চোখ–মুখ লাল করে চটপটি খাচ্ছেন, আবার কেউ তা দেখে সুখ খুঁজছেন। বেশিরভাগ মানুষ সমুদ্রের সঙ্গে মিতালি পাতার দৃশ্য ফ্রেমে বন্দি করেছেন ক্যামেরা ও মুঠোফোনে। যাদের সেই সুযোগ ছিল না তাদের জন্য ছিল বিকল্প ব্যবস্থা। ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রীরা ব্যস্ত ছিলেন পর্যটকদের ফরমায়েশ অনুযায়ী ছবি তোলা ও ১০ মিনিটের মধ্যে সরবরাহের কাজে।
মূল সৈকত ছাড়াও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমজমাট ছিল নেভাল একডেমি সংলগ্ন কর্ণফুলীর মোহনা। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাড়ির বহর আর বাঁধের উপর বসে আড্ডায় মেতেছেন সবাই। সিএমপি বন্দর জোন সেখানে ঈদ পরবর্তী তিন দিন পর্যন্ত দুটি সেবাকেন্দ্র খুলেছে। এসব কেন্দ্রে যে কোনো ধরনের অভিযোগ জানানোর সুযোগ রয়েছে পর্যটকদের। এছাড়া নেভাল একাডেমির পাশে সৈকতেও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ।
নগরীর লালখান বাজার এলাকা থেকে মাহফুজুর রহমান পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদের পরদিন বেড়াতে এসেছিলেন পতেঙ্গা সৈকতে। সমুদ্র সৈকতে আসার কারণ জানাতে গিয়ে তিনি আজাদীকে বলেন, পরিবারের সবাইকে একসাথে পাওয়া যায় না। ঈদ উপলক্ষে সবাই বাসায় এসেছেন। এই সুযোগে আজ সবাই মিলে সৈকতে ঘুরতে এলাম।
জামালখান এলাকা থেকে সৈকতে বেড়াতে এসেছেন মণিহার, মেহবুবা ও রিমঝিম। সৈকতে এলেই তাদের মন ভালো হয়ে যায়। সমুদ্র সৈকত ও নেভালে ঘুরে না বেড়ালে তাদের ঈদের আনন্দ অপূর্ণ থেকে যায়।
অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই, বসের হুকুম তামিলের বাধ্যবাধকতা নেই, যানজটের যন্ত্রণা নেই, অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য নেই। এমন কয়েকটি দিন কাটাতে যেকোনো উৎসবেই বিনোদনপ্রিয় মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে ফয়’স লেক কনকর্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও সী ওয়ার্ল্ডে। এবারও এ বিনোদন স্পটটি সেজেছিল বর্ণিল সজ্জায়। অবারিত সবুজের প্রান্ত ছুঁইয়ে নীলাকাশ যেন নুইয়ে পড়ে এখানে। এ যেন সম্পূর্ণ আলাদা এক জগৎ। কর্তৃপক্ষ আগেই বাড়তি প্রস্তুতি নিয়েছিল দর্শনার্থীদের বরণ করে নেওয়ার জন্য। বৈরী আবহাওয়ার কারণে প্রথম দুদিন দর্শনার্থীর আগমন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও শনিবার থেকে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঈদের তৃতীয় দিন আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সকাল থেকেই ওয়াটার পার্ক সী ওয়ার্ল্ড পার্কে কিশোর–কিশোরী ও তরুণ–তরুণীদের ঢল নামে। ডিজে মিউজিকের তালে তালে সী ওয়ার্ল্ডের ওয়েভ পুল ও ড্যান্সিং জোন নাচে–গানে মুখর রাখে তারা। বিভিন্ন প্যাকেজের মধ্যে খাবারসহ প্যাকেজগুলো কেনার আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে বেশি। ফয়’স লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্কে সন্ধ্যার আয়োজনে ছিল কনসার্ট। শিশুদের জন্য ম্যাজিক শো, সাথে সকলের জন্য গিফট।
ফয়’স লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্কের উপব্যবস্থাপক (বিপণন) বিশ্বজিৎ ঘোষ আজাদীকে বলেন, আগত দর্শনার্থীদের কেউ কারো আনন্দে ব্যাঘাত ঘটায়নি। সকলেই স্বাধীনভাবে ঈদের আনন্দ উপভোগ করেছে। তিনি বলেন, প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করার জন্য অনেকেই নৌকাযোগে লেক ভ্রমণকে বেছে নিচ্ছেন। আবহাওয়া ভালো থাকায় এবং নির্মল বিনোদনের আয়োজনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার কারণে প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটছে কনকর্ড ফয়’স লেক কমপ্লেক্সে।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার দিকেও দর্শকদের নজর থাকে বেশি। শিশুরা সাদা বাঘ, সিংহ, ক্যাঙ্গারু ও ওয়াইল্ড বিস্টের খাঁচায় ভিড় জমায়।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ বলেন, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় সাম্প্রতিক সময়ে নতুন নতুন অনেক প্রাণী এসেছে। শিশু বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট এখন চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানায় জলহস্তি আনা হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ৬৬ প্রজাতির ৬২০টি পশুপাখি রয়েছে বলে জানান তিনি।
নগরবাসীর সরব উপস্থিতি ছিল শিশুপার্কে। আগ্রাবাদ ও কাজির দেউড়ির শিশু পার্ক দুটিতে শিশুরা তো আছেই, সাথে আনন্দ ভাগাভাগিতে মেতে ছিলেন বয়স্করাও। হয়তো এ আনন্দময় মুহূর্তে তারাও ফিরে গিয়েছিলেন শৈশবে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় ভিড় কম ছিল বলে জানালেন কর্মকর্তারা। অনেক রাইড খালি পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। শিশুপার্কের সামনে সড়কের পাশে ছোট খাবারের দোকান ও ফুচকার দোকানে ভিড় ছিল লক্ষ্য করার মতো।
নগরীতে ঈদের ছুটি কাটাতে পতেঙ্গা প্রজাপতি পার্ক, কর্ণফুলী নদীর অভয় মিত্র ঘাট ও হালিশহর সাগরপাড়ে ঘুরেছেন অনেকে। এছাড়া সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সাগরপাড়, চন্দ্রনাথ পাহাড়, মীরসরাইয়ের মহামায়া লেক, আনোয়ারায় পারকি সমুদ্র সৈকত, রাউজানে মহামুনি মন্দির, অণিরুদ্ধ বড়ুয়া অনি শিশু পার্ক, বেতাগী কর্ণফুলী নদীর পাড়, রাউজান রাবার বাগান ও ফটিকছড়ি চা বাগান এলাকায় যাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।
ঈদের ছুটিতে পুরনো বন্ধুকে কাছে পেয়ে এম এ আজিজ আউটার স্টেডিয়াম, সিআরবি ও ডিসি হিল এলাকায় খোশগল্পে মেতেছেন অনেক তরুণ–তরুণী। অনেকে ফুটপাতে আড্ডা দিয়েছেন। দৃষ্টিনন্দন কর্ণফুলী সেতু ও ফ্লাইওভারেও সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের ভিড় ছিল লক্ষ্যণীয়।