স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে রাজধানী ঢাকামুখী হওয়ার তীব্র প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে দেশের মানুষের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য ঢাকা। এখন সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে ঢাকায় থাকতে পছন্দ করে। সবার ধারনা ঢাকা থাকলে নাগরিক সুযোগ সুবিধা বেশি পাওয়া যাবে। সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত ও সুসন্তান হিসাবে গড়ে তোলা যাবে। চাহিবা মাত্র কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সেবা, চিকিৎসা সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা পাওয়া যাবে। সেজন্য জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও মফস্বলের প্রায় সব চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ক্রীড়াবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদ পরিবার পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করেন। অথচ মফস্বল, উপজেলা ও জেলা শহরে এসব গুণীব্যক্তিত্ব থাকলে ঐসব এলাকা সমৃদ্ধ হতো।
১৭৫৭ সালে বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন নবাবের পতনের পর ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার মূল প্রতিষ্ঠান ছিল সিভিল সার্ভিস। ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস ছিল দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সরকারের ফসল। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৭৬৫–১৮৫৮) ও পরে ব্রিটিশ রাজের (১৮৫৮–১৯৪৭) উপনিবেশিক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার প্রয়োজন ও পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে। ১৭৮৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূখণ্ডগত মালিকানা প্রধানত ‘সুপারভাইজার’ নামে অভিহিত কোম্পানির স্থানীয় বাণিজ্যিক অফিসারদের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশীয় সংস্থাগুলোর দ্বারা পরিচালিত হতো। তখন সিভিল সার্ভিস ছিল এমন এক ব্যবস্থা যার শীর্ষভাগে ছিলেন ইউরোপীয়রা এবং নিম্নস্তরে ছিলেন দেশীয়রা। তখন থেকে সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন পর্যায়ের চাকরিজীবীদের জন্য চাকরিস্থলে তৈরী করা হয় সরকারি আবাসন ভবন। যাতে করে সিভিল সার্ভিসে কর্মরত সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে চাকরিস্থলে থাকতে পারেন। আর যাদের থাকার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা ছিলো না তাদের জন্য চালু করা হয় ঘর ভাড়া প্রদানের ব্যবস্থা। যাতে করে আবাসনবিহীন চাকরিজীবীরাও চাকরিস্থলে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকতে পারেন।
এতে করে সরকারি চাকরিজীবীরা মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি নিয়ে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারতেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। তবে তখন অনেকে পরিবার পরিজনকে চাকরিস্থলে না রেখে নিজের গ্রাম বা জেলায় রাখতেন। পরবর্তীতে চাকরিজীবীরা চাকরি শেষে নিজের জন্মস্থান বা নিজ জেলায় ফিরে আসতেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর ব্যত্যয় ঘটে। সবাই রাজধানী ঢাকামুখী হওয়া শুরু করে। শুধু চাকরিজীবী নয় বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজনও ঢাকামুখী হওয়া শুরু করে। বর্তমানে ঢাকার জন সংখ্যা প্রায় দুই কোটিতে গিয়ে ঠেকেছে। এতে করে ঢাকা এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অত্যধিক চাহিদার কারণে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও মানুষের চাপে ঢাকা আজ পৃষ্ট। এটি আমার কথা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে এমনটি উঠে এসেছে। ঢাকার শব্দ, পানি ও বায়ু এখন বিষযুক্ত। বাতাসের মান অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় গত ২১শে ডিসেম্বর‘ ২২ বুধবার সকালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত শহরের তালিকায় ১ নম্বরে উঠে এসেছিলো ঢাকা।
সেদিন সকাল ৯ টায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে ঢাকার স্কোর ছিলো ৩০৮। এই স্কোর ৩০১ এর বেশি হলে সেই বাতাসকে দুর্যোগপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শুধু তাই নয় যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বাসযোগ্য শহরের তালিকায়ও ধারাবাহিকভাবে নিচের দিকে থাকে ঢাকা। তাদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, পরিকল্পনাহীনতা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে ঢাকাকে বাস যোগ্যতাহীন একটি নগরে পরিণত করেছে। ইআইইউ‘র শহরের স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য সেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো এই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিবেচনায় নিয়ে বাসযোগ্যতার তালিকাটি করে। প্রতিষ্ঠানটির ‘বিশ্ব বাসযোগ্যতা সূচক ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ঢাকা ১৭২টি শহরের মধ্যে ১৬৬তম অবস্থানে রয়েছে।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকা পাঁচ দশক ধরে অপরিকল্পিত ভাবে বড় হচ্ছে। লেক খাল বিল নদী নালা ও উন্মুক্ত স্থান সব কিছু ভরাট করে নগরায়ন করা হচ্ছে। দখল করা হয়েছে নদী, নালা, সরকারি খাস জমি ও লেক। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে টাউট, বাটপার, প্রভাবশালী মহল ও ভুমিদস্যুরা। সহযোগিতা করছেন এক শ্রেণির আমলা ও রাজনীতিবিদেরা। তবে সরকারও এর দায় এড়াতে পারে না। কারণ যুগের পর যুগ ধরে সরকারের চোখের সামনেই চলছে এইসব অনৈতিক কাজ। কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় অবৈধ দখল বাড়ছে দিনের পর দিন। ফলে অতি অল্প বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত হচ্ছে ঢাকা, ভয়াবহ যানজটের কারণে এক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে লাগছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। বিভিন্ন প্রাণঘাতি রোগে আক্রান্ত হয়ে ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ।
অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রণালয় ও আদালত থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি সব অফিস, হাসপাতাল, ব্যাংক, বীমা, মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও অধিদপ্তরের হেড অফিস ঢাকায় কেন্দ্রীভূত হওয়ায় লাখ লাখ মানুষকে প্রতিনিয়ত ঢাকায় আসতে হয়। সরকারের সমস্ত কার্যক্রম ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ঢাকা থেকে। তাই ঢাকা ও এর আশেপাশে পদস্থ হওয়ার জন্য চাকরিজীবীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। এজন্য তদবির, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আনুকুল্য থেকে শুরু করে নৈতিক অনৈতিক যে কোনো পথ গ্রহণে তারা প্রস্তুত। তারা এতোটাই ঢাকামুখী যে অবসরের পরও তারা ঢাকা ছাড়েন না। অথচ জেলা বা উপজেলা শহরে থাকলে স্থানীয় মানুষ তাদেরকে সমীহ করতো। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা সম্মানিত হতেন। জেলা উপজেলার উন্নয়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষামূলক ও শিল্প সংস্কৃতিক কাজ ও খেলাধুলায় তাদের পরামর্শে দেশ ও জাতি সমৃদ্ধ হতো।
শুধু অফিস আদালত নয় দেশের নামকরা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকায় হওয়ায়, লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে ঢাকায় থাকতে হচ্ছে। অনেকে কষ্ট করে সন্তানের লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় থাকে। কিন্তু পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা যায়, এখনো মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ হচ্ছে মফস্বলের স্কুল কলেজ থেকে পাস করা ছাত্র ছাত্রী। এখনো বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া অধিকাংশ হলো মফস্বল থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থী।
তাই ঢাকায় মানুষের স্রোত কমাতে হলে আইন করে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের পরিবার পরিজনকে তাদের কর্মস্থলে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি চাকরিজীবী, রাজনীতিক ও পেশাজীবীদের জন্য সরকারের স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা ঢাকা কেন্দ্রিক না করে বিভিন্ন জেলা শহরে বা বিভাগীয় শহরে করতে হবে(যেমনটি আর্মির মধ্যে রয়েছে)। কিছু কিছু মন্ত্রণালয়সহ ব্যাংক বীমা শিল্পকারখানা হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঢাকার বাইরে নিতে হবে এবং এতে ঢাকার উপর চাপ অনেকাংশেই লাঘব হবে। সর্বোপরি আমাদের মনমানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। ঢাকায় থাকলে সবকিছু পাওয়া যাবে, সর্বক্ষেত্রে সফল হওয়া যাবে–এই মন মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। না হলে ঢাকায় মানুষের স্রোত কখনো থামবে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট