পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সম্পদের হিসাব চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে তাদের স্ত্রী–সন্তানদের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দিয়েছে সংস্থাটি। নোটিস পাওয়ার ২১ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের নামে থাকা স্থাবর–অস্থাবর সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে। খবর বিডিনিউজের।
গতকাল মঙ্গলবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য দেন কমিশনের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন। তিনি বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত অনুসন্ধানকারী কমিটি প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য–রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মীর্জা, জ্যেষ্ঠ কন্যা ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর এবং মেজো কন্যা তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায়। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণের নামে–বেনামে, দেশে–বিদেশে আরো স্থাবর–অস্থাবর সম্পদ রয়েছে মর্মে তথ্য পাওয়া যায় বিধায়, তাদের দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(১) ধারা মোতাবেক পৃথক পৃথক সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ জারির বিষয়ে কমিশন কর্তৃক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তদানুযায়ী, সংশ্লিষ্টদের নামে সম্পদ বিবরণী নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে। অপরদিকে ‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিষয়েও অনুসন্ধান শেষ করার কথা জানিয়েছেন দুদক সচিব। তিনি বলেন, মতিউর রহমান দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ হুন্ডি ও আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক গঠিত অনুসন্ধানকারী দল অনুসন্ধান শেষ করেছে। কমিশনের সিদ্ধান্তক্রমে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মতিউর রহমান, প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, প্রথম পক্ষের সন্তান আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব, প্রথম পক্ষের সন্তান ফারজানা রহমান ইপ্সিতা ও দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলীর নামে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(১) ধারা ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭ বিধি ১৭(১) মোতাবেক সম্পদ বিবরণীর নোটিস জারি করা হয়েছে।
এর আগে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দিন ঠিক করলেও দুদকে হাজির হননি বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জিশান মির্জা এবং দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর। তবে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ নিয়ে তারা তিনজনই লিখিত ব্যাখ্যা পাঠিয়েছেন বলে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন জানিয়েছিলেন।
বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক : গত ৩১ মার্চ ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ৩ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে তাকে নিয়ে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক কালের কণ্ঠ। সেখানে সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠে আসে। এরপর আলোচনা শুরু হয় তাকে নিয়ে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে হবিগঞ্জ–৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এপ্রিলের শেষে বেনজীর এবং তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে দুদকে আবেদন করেন। এরপর ২২ এপ্রিল দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, বেনজীরের ‘অবৈধ সম্পদ’ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন তারা। একই দিন এক আদেশে দুই মাসের মধ্যে বেনজীরের বিষয়ে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন চেয়ে নির্দেশ দেয় হাই কোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী এবাদাত হোসেনের বেঞ্চ। নির্দেশনার পর সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর ও তার পরিবারের সম্পদের খোঁজে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আটটি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয় দুদক। পরে দুদকের আবেদনে বেনজীর, তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের স্থাবর সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। সেই সঙ্গে তাদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব এবং বিভিন্ন কোম্পানিতে তাদের নামে থাকা শেয়ারও অবরুদ্ধ করার আদেশ আসে। সেই অনুযায়ী পরে ব্যবস্থাও নেয় দুদক।
বেনজীর ও তার স্ত্রী–কন্যাদের দেশের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। তবে বোট ক্লাবের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগের জন্য দেওয়া চিঠিতে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিদেশে থাকার কথা বলেন। তারা সবাই দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে। এগুলোর প্রতিবাদ করেননি সাবেক আইজিপি।
ছাগলকাণ্ডের পর মতিউরের সম্পদের অনুসন্ধান : বেনজীরের সম্পদ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান শুরুর আলোচনার মধ্যে কোরবানি ঈদের সময় ‘ছাগলকাণ্ডের’ ঘটনায় আলোচনায় আসেন একাদশ বিসিএসের (শুল্ক ও আবগারি) কর্মকর্তা মতিউর রহমান। এরপর তাকে এনবিআর থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে যুক্ত করা হয়। সরিয়ে দেওয়া হয় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে সরকার মনোনীত পরিচালক পদ থেকেও। সংবাদমাধ্যমে একের পর এক মতিউর, তার স্ত্রী ও সন্তানের সম্পদের খবর আসার মধ্যে দুদক তার সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে। এরপর তার দেশত্যাগের আলোচনার মধ্যে আদালত মতিউর, তার প্রথম স্ত্রী ও সন্তানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
কোরবানির জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ১৫ লাখ টাকা দামে ছাগল কেনার ফেইসবুক পোস্ট ঘিরে রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হয়। এ প্রশ্ন ঘিরে সামনে আসতে থাকে ইফাতের পরিচয়। ইফাত নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দিয়ে ও সংবাদমাধ্যমে বাবার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এঙসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমান। ইফাতের বাবার পরিচয় ধরে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল ব্যয়ে কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য হল কী করে? মতিউর রহমান এ আলোচনায় ‘ঘি ঢেলেছেন’ ছেলের পরিচয় ‘অস্বীকার’ করে। একটি টেলিভিশনের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে কেউ তার ছেলে বা আত্মীয় নয়, এমন নামে কাউকে চেনেন না পর্যন্ত। তার একটিই ছেলে, তার নাম তৌফিকুর রহমান। এরপর ইফাতের পরিচয় ও পারিবারিক ঠিকুজি নিয়ে ফেসবুকে নানা তথ্য আসতে থাকে। ইফাতের সঙ্গে মতিউর রহমান এবং পরিবারের অন্যদের ছবিও প্রকাশিত হয়।