চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের চৌধুরী হাট কোরবানি পশুর হাটে গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আনুমানিক সাড়ে ৫ মণ থেকে ৬ মণ ওজনের একটি গরুর দাম হাঁকা হয় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। সন্ধ্যার পর সেই একই গরুর মূল্য চাওয়া হয় ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অর্থাৎ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ৩০ হাজার টাকা কম দাবি করেন বেপারি।
গরুটির মালিক মোজাম্মেল জানান, গাইবান্ধা থেকে ৬টি গরু নিয়ে এসেছেন তিনি। এর মধ্যে একটিও বিক্রি হয়নি। ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করা গরুটির দাম ক্রেতারা ১ লাখ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মধ্যেই বলেছেন। এদিকে কোরবানির সময়ও ঘনিয়ে আসছে। বৃষ্টির সম্ভাবনাও রয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিক্রি না হলে পরিবহন ভাড়া এবং গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামে অবস্থান করার সময় থাকা–খাওয়ার খরচও লস হবে। তাই অল্প লাভেই গরু ছেড়ে দিব। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের অন্যান্য বাজারগুলোরও চিত্র প্রায় একই। এতদিন অতিরিক্ত লাভের আশায় ‘গোঁ’ ধরে বসে থাকা বেপারিরা গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে দাম সহনীয় করছেন। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এবার গৃহস্থলি এবং স্থানীয় ও আশেপাশের খামারে হৃষ্টপুষ্টকৃত গরুর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা প্রচুর গরু রয়েছে। বিপরীতে ক্রেতা কম। ধারণা করা হচ্ছে, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে এবার অংশীদারে কোরবানি দেয়ার সংখ্যা বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে গরুর মজুদ চাহিদার তুলনায় বেশি থাকবে। একইসঙ্গে অনেকে ভিড় এড়াতে ছুটছেন বিভিন্ন এগ্রো ফার্মে। যার প্রভাব পড়ছে পশুর স্থায়ী–অস্থায়ী হাটগুলোতে। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় থাকা বেপারিরা অতিরিক্ত মুনাফার আশা ছেড়ে দিচ্ছেন।
গত কয়েকদিন ধরে নগরের বিভিন্ন পশুর হাট ঘুরে জানা গেছে, বাজারগুলোতে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, নাটোরসহ অন্যান্য এলাকা থেকে গরু এনেছেন বেপারিরা। আছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও বাঁশখালী থেকে নিয়ে আসা গরুও। স্থানীয় বিভিন্ন খামারে হৃষ্টপুষ্টকৃত প্রচুর গরুও আনা হয়েছে বিক্রির জন্য। এছাড়া অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ীও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গরু এনেছেন বিক্রির জন্য। গরু বিক্রি করতে না পারলে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে লোকসানের শঙ্কা করছেন। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা বেপারিরা যাতায়াত খরচসহ অন্যান্য ব্যয় নিয়ে টেনশনে আছেন। তাই গরু বিক্রির তাড়া আছে তাদের মধ্যে।
গতকাল নগরের কয়েকটা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে আগের দিনের তুলনায় ভিড় বেশি। আজ ক্রেতার উপস্থিতি আরো বাড়তে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ইজারাদার ও বেপারিরা। কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, আজ মঙ্গলবার থেকে টানা পাঁচদিনের ছুটি শুরু হচ্ছে। এতদিন কর্মব্যস্ততার জন্য যারা বাজারে যাওয়ার সুযোগ পাননি তারা আজ থেকে ছুটবেন পশুর হাটে। অবশ্য গতকাল থেকে বিভিন্ন অফিস–আদালতে ছুটির আমেজ শুরু হয়েছে। অনেকটা আগেভাগে অফিস থেকে বের হয়েছেন অনেকে। এর মধ্যে কোরবানিদাতাদের বেশিরভাগই বাজারে যান কোরবানি পশু কেনার উদ্দেশে। এছাড়া কোরবানির সময় বেশি না থাকায় যারা এখনো পশু কিনেন নি তারাও ভিড় করেন বাজারে। সবমিলিয়ে গতকালও জমজমাট ছিল কোরবানি পশুর হাটগুলো।
জানা গেছে, আগামী বৃহষ্পতিবার পবিত্র ঈদুল আজহা। ওই হিসেবে আজ মঙ্গলবার ও আগামীকাল বুধবার দুইদিন সময় আছে পশু কেনার। সাধারণত শেষদিন অর্থাৎ বুধবারের ঝুঁকি না নিয়ে বেশিরভাগ ক্রেতা একদিন আগেই পশু কিনতে জোর দেন। ওই হিসেবে আজ পশুর হাটগুলোতে বেচাকেনা বাড়ার কথা।
কর্ণফুলী পশুর বাজারের (নূর নগর হাউজিং) ইজারাদার সাইফুল আলম আজাদীকে বলেন, আজকে ভালই বিক্রি হয়েছে। আগামীকাল (আজ) আরো জমজমাট হবে এবং সর্বোচ্চ বিক্রি হবে বলে আশা করছি।
দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের চৌধুরী হাট বাজারে প্রচুর গরু দেখা গেছে গতকাল। তবে বিগত বছরের তুলনায় ক্রেতা–দর্শনার্থীর ভিড় ছিল কম। চৌধুরী হাট বাজারে গরু কিনতে আসা পারভেজ তালুকদার আজাদীকে বলেন, রাতে গরুর দাম বিকেলের চেয়ে কম মনে হয়েছে। বাজারে প্রচুর গরু। মানুষ কম। তাই ধারণা করছি কাল গরুর দাম আরও কমতে পারে।
বিবিরহাট বাজারে দেখা গেছে, নোয়াখালী থেকে নিয়ে আসা কালো রঙের একটি ষাড়ের দাম হাঁকা হয় ১০ লাখ টাকা। বেপারি সর্ম্পূণ কালো রঙের গরুটির নাম দিয়েছেন ‘কালোমানিক’। একই বাজারে ‘কালোমানিক’ নামে আরেকটি গরুর দেখা মিলে। মাগুরা থেকে নিয়ে আসা এ গরুটির অবশ্য সাদা দাগও রয়েছে। এটির দাম হাঁকা হয় ৮ লাখ টাকা।
বাজারটিতে দেখা যায় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। নূর ইসলাম নামে এক বেপারি একটি গরু জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন। গরুটির চোখও দিয়ে পড়ছিল পানি। বেপারি আজাদীকে বলেন, নিজের সন্তানের মত গরুটি লালন–পালন করি। শখ করে নাম দিই ‘রাজাবাবু’। এ নামে ডাকলেই সাড়া দেয়। আজ এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিই। মনটা ভেঙে যাচ্ছে।
বিবিরহাট বাজারে খাস কালেকশনের মাধ্যমে হাসিল আদায়ের সঙ্গে জড়িত একজন জানান, অন্যদিনের চেয়ে ক্রেতা বেশি। বিক্রিও মোটামুটি হয়েছে। বেপারিরা গরুর দাম ছেড়ে দিচ্ছেন। আজ মঙ্গলবার বিবিরহাটের সাপ্তাহিক বাজারের দিন হিসেবে হাট আরো জমজমাট হবে বলে জানান তিনি।
সাগরিকা পশুর হাটও গতকাল সরগরম ছিল। তবে বিক্রি প্রত্যাশিত হয়নি বলে একাধিক বেপারির সঙ্গে আলাপকালে জানায়। তারা বলেন, এখনো দুইদিন সময় আছে। দামও অনেক সহনীয় আছে। শেষ পর্যন্ত নিয়ে আসা সবগুলো গরু বিক্রি হয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
এদিকে গরুর পাশাপাশি এবার ছাগলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। আছে মহিষেরও। প্রায় সবগুলো বাজারেই জকমজমাট ছিল ছাগল বিক্রি। জানা গেছে, নগরে এবার স্থায়ী–অস্থায়ী ১০টি পশুর হাট বসে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায়। এছাড়া চৌধুরী হাটের পশুর বাজার থেকে খাস আদায়ের মাধ্যমে হাসিল করা হচ্ছে। ওই হিসেবে ১১টি বাজার বসে চসিকের ব্যবস্থাপনায়। অস্থায়ী বাজারগুলো হচ্ছে– কর্ণফুলী পশুর বাজার (নূর নগর হাউজিং এস্টেট), ৪১নং দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডের বাটারফ্লাই পার্কের দক্ষিণে টি কে গ্রুপের খালি মাঠ, ৪০নং উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের পূর্ব হোসেন আহম্মদ পাড়া সাইলো রোডের পাশে টিএসপি মাঠ, একই ওয়ার্ডের মুসলিমাবাদ রোডের সিআইপি জসিমের খালি মাঠ, ২৬ নং ওয়ার্ডের বড়পোল সংলগ্ন গোডাউনের পরিত্যক্ত মাঠ, ৩নং পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের ওয়াজেদিয়া মোড়। স্থায়ী হাটগুলো হচ্ছে– সাগরিকা পশুর বাজার, বিবিরহাট গরুর হাট ও পোস্তারপাড় ছাগলের বাজার।