চৈতী ও সৈকত দম্পতি। দু’জনই চাকরিজীবী। ছুটির দিনে গতকাল শনিবার বিকেলে পটিয়া উপজেলা থেকে ঘুরতে এসেছেন নগরীর সিআরবি। এসে দেখলেন শিরীষতলায় চলছে বইমেলা। দৈনিক আজাদীকে তারা বলেন, বইমেলা হচ্ছে আগে থেকে জানতাম না। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে এমন আয়োজন দেখে অনেক মুগ্ধ হয়েছি। সত্যিই অনেক ভালো লাগছে। দুটো কাব্যগ্রন্থ ও তিনটি উপন্যাস কিনছেন বলেও জানান তারা।
অবশ্য বইমেলার খবর জেনেই আট বছরের সন্তান নুসাইবাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন নকীব–ফাইজা দম্পতি। তারা নগরীর উত্তর কাট্টলীর বাসিন্দা। এর মধ্যে নকীব ব্যাংকার। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে কর্মব্যস্থতার জন্য পরিবারকে সময় দেয়া হয়ে উঠে না। তাই ছুটির দিনে স্ত্রী–সন্তানকে নিয়ে বইমেলায় এসেছেন। তিনি আজাদীকে বলেন, মূলত মেয়েকে সৃজনশীল বইয়ের প্রতি আগ্রহী করতেই আসা। মেয়েকে কয়েকটা ছড়া ও গল্পের বই কিনে দিব। আগামী সপ্তাহেও আসার ইচ্ছে আছে।
এই দুই দম্পতির সঙ্গে আলাপকালে স্পষ্ট, বইমেলায় এসে উচ্ছ্বসিত তারা। যেন তাদের কাছে আনন্দের উপলক্ষ হয়ে এসেছে এই বইমেলা। এদের মত আরো শত শত পাঠক–দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে বইমেলা। সবার এমন সরব উপস্থিতিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন প্রকাশকরাও। তারা বলছেন, বিকিকিনিও বেড়েছে।
গতকাল শনিবার ছিল বইমেলার দ্বিতীয় দিন। এদিন সকাল ১০টায় দরজা খোলা হয় মেলার। তবে সকালে উপস্থিতি ছিল কম। দুপুরের পর থেকে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে লোক সমাগম। সন্ধ্যায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে মেলাপ্রাঙ্গণ।
শৈলী প্রকাশন এর পরিচালক আরিফ রায়হান আজাদীকে জানান, শৈলী থেকে এবারের বইমেলায় ৪৫টি বই প্রকাশিত হযেছে। আরো কয়েকটি প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। গতকাল বিকিকিনি ভাল হয়েছে বলেও জানান তিনি।
চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী চৌধুরী ফাহাদ আজাদীকে বলেন, ছায়া সুশীতল পরিবেশ হিসেবে শিরিষতলা এবারের বইমেলার স্থান চমৎকার হয়েছে। দুইদিনেই প্রচুর লোকজন এসেছেন মেলায়। এমনিতেই সিআরবিতে প্রতিদিন মানুষের জমায়েত থাকে। তিনি বলেন, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন থেকে এবার ২৫টা বই বের হবে। এর মধ্যে ২৪টা চলে আসছে। বেচাকেনা মোটামুটি। আবীর প্রকাশন এর স্বত্ত্বাধিকারী মুহম্মদ নুরুল আবসার আজাদীকে বলেন, এবার মেলা উপলক্ষে ২০টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। সবগুলোই মেলায় চলে এসেছে।
ঢাকা থেকে আসা কবি প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী শাহরিয়ার হাসান বলেন, এবার ৮টা বই বের হয়েছে। চট্টগ্রামে এখনো আসেনি। আগামী পরশু আসতে পারে। প্রথমদিন প্রচুর মানুষ এসেছে। আজ একটু কম। বিক্রি টুকটাক। এর আগে বিভাগীয় বইমেলায় অংশ নিই, তার চেয়ে এখানে সাড়া বেশি পাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত আরো জমবে আশা করছি।
নন্দন বইঘর এর সঞ্জয় সূত্রধর বলেন, সকালে লোকজন কম ছিল। আড়াইটার পর থেকে আসা শুরু করে। বিকেলে লোকজন বেড়েছে। বিকিকিন খারাপ না। ধুলোবালি আগের দিনের চেয়ে কমেছে।
রাদিয়া প্রকাশনের স্বত্ত্বাধিকারী গোফরান উদ্দিন টিটু বলেন, ১৫টা বের হবে। আজ পর্যন্ত ৩টা আসছে। আগামী সপ্তাহে আরো তিন–চারটা আসবে। বেচাকেনা মোটামুটি। প্রচারণায় জোর দেয়া উচিত।
স্বাধীন প্রকাশনের মো. সাহাব উদ্দীন হাসান বাবু বলেন, এবারের বই মেলাই ২৩টি বই বের হবে। এরমধ্যে পাঁচটি মেলায় চলে আসছে। আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে আরো চারটা আসবে। প্রচুর দর্শনার্থী আছেন, ওই হিসেবে বেচাকেনা জমে উঠেনি। তবে একেবারে হচ্ছে না তা না, মোটামুটি হচ্ছে।
এদিকে গতকাল মেলায় আসা নতুন বইগুলোর মধ্যে মোহছেনা ঝর্ণার ছোটগল্প সংকলন ‘তখন আমরা ঘুমাইনি’, শহিদ হাসান এর ‘ওরফে আবু দাউদ’, আলমগীর মোহম্মদ এর অনুবাদগ্রন্থ ‘জালালউদ্দিন রুমির কথা’, শারুদ নিজাম এর ‘ধুলোমাখা ক্যানভাসে’ ও সৈয়দ করিমুননেসা এর ‘শব্দে আঁকি’ ও জোনাকী দত্তের ‘টুনটুনির বিয়ে’ নিয়ে পাঠকের আগ্রহ দেখা গেছে।
প্রসঙ্গত, মেলার আয়োজক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। তবে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, নাগরিক সমাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য শিল্প–সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরাই সম্মিলিতভাবে এ মেলা বাস্তবায়ন করছেন। মেলা চলবে ২ মার্চ পর্যন্ত। মেলা প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা ও ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
মরমী উৎসব : গতকাল বইমেলার মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় মরমী উৎসব। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজির উপাচার্য প্রফেসর ড. ওবায়দুল করিম। তিনি বলেন, আজকে আমাদের সমাজ চরম নৈতিকতার অবক্ষয়ে চলে গেছে। মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও আস্থা নেই। মানুষের নীতি–নৈতিকতা, সততাও আস্তে আস্তে শেষপ্রান্তে চলে আসছে। অথচ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে দর্শন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন তার সেই দর্শনের সাথে মরমী সাধকদের দর্শনের অদ্ভুত মিল পাই। সেই দর্শন আমরা ধরে রাখতে পারি নাই। আসুন সমাজ পরিবর্তনে মরমী সাধকদের মহান বাণী ও দর্শনকে ধারণ করে আমরা প্রকৃত মানবতাবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসাবে নিজেদের ও নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলি।
নৃ–গবেষক ড. শামসুদ্দিন শিশিরের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন মরমী গবেষক ড. সেলিম জাহাঙ্গীর, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ–পরিচালক ড. আজাদ বুলবুল। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বই মেলা কমিটির আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দীন আহমেদ মঞ্জু। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মরমী গান পরিবেশন করেন সুফি ইছা মরমী সংসদ, বাউল মোজাহেরুল ইসলাম, চ্যানেল আই শিল্পী উম্মে কাউছার নিঝুম ও হারুন কাউয়াল।