সন্দ্বীপবাসী দেখল নতুন এক ভোর

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ২৫ মার্চ, ২০২৫ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

সন্দ্বীপের মানুষ আজ নতুন এক ভোর দেখল। বহুল প্রতীক্ষিত ফেরি সার্ভিস চালুর মাধ্যমে এক শতাব্দীর দুর্ভোগের অবসান হলো। আজ সন্দ্বীপের মানুষ আনন্দিত, আবেগাপ্লুত। দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বিচ্ছিন্নতার পর সন্দ্বীপবাসী প্রথমবারের মতো গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরেছে।

এই ফেরি সার্ভিস শুধু সন্দ্বীপের মানুষের জন্য নয়, পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি সন্দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার পাশাপাশি পর্যটন, ব্যবসা ও নানা খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। সন্দ্বীপের অর্থনৈতিক বিকাশে এটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

স্বপ্ন দেখি, উত্তাল সাগরের বুক চিরে সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে একটি সেতু। একদিন নিশ্চয় এমন সেতু হবে। বিশ্বের অনেক দেশে সাগরের ওপর সেতু নির্মিত হয়েছে। চীন, জাপান, কোরিয়া, আমেরিকা, রাশিয়া, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ অনেক দেশ এই চ্যালেঞ্জ জয় করেছে। আমিও বিশ্বাস করি, একদিন সন্দ্বীপের মানুষ গাড়ি চালিয়ে সীতাকুণ্ডের উপকূল থেকে সরাসরি দ্বীপে পৌঁছে যাবে। আজকের ফেরি চলাচল সে স্বপ্নপূরণের প্রথম ধাপ মাত্র। আশির দশকের সন্দ্বীপ নৌযাত্রা : এক অগ্নিপরীক্ষা

সাংবাদিকতা জীবনের শুরুতে সীতাকুণ্ড ছিল আমার কর্মস্থল। তখন মোবাইল ফোনের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না। যোগাযোগ ব্যবস্থাও এত উন্নত ছিল না। সন্দ্বীপ চ্যানেলের কোনো দুর্ঘটনার খবর এলে আমাদের ছুটতে হতোকখনো কাদাপানি মাড়িয়ে, কখনো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।

সীতাকুণ্ড উপকূল থেকে সন্দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ১০ মাইল বা ১৬ কিলোমিটার। কিন্তু সেই পথ পাড়ি দেওয়া ছিল ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। উপকূলের ঘাটগুলো থেকে ট্রলারে উঠতে হলে হাঁটু বা কোমরসমান কাদামাটি মাড়িয়ে এগোতে হতো। জোয়ারভাটার হিসাব করে ট্রলার ছাড়ত। প্রতিদিন হাজারো মানুষ যাতায়াত করত। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট জেটি ছিল না। বাঁশের চাঁই দিয়ে পাটাতন নামিয়ে তাতে দৌড়ে উঠতে হতো।

সে সময় স্পিডবোট ছিল না। কাঠের তৈরি বড় নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত ট্রলারই ছিল প্রধান বাহন। সরকারি সিট্রাক ছিল, কিন্তু সেটিও নিয়মিত চলত না। যাত্রীরা উপায়ান্তর না দেখে স্থানীয় নৌযানের ওপর নির্ভর করত। নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না। লাইফ জ্যাকেট ছিল না, ট্রলারগুলো ছিল খোলা, যাত্রীরা গা ঘেঁষে বসত আর মালপত্র মাঝখানে রাখা হতো।

বর্ষাকালে নদী আরও ভয়ংকর রূপ নিত। জোয়ারের সময় ঢেউয়ের তাণ্ডব দেখে মনে হতো, ট্রলারটি একবার উপরে উঠছে তো পরক্ষণে গভীর গর্তে পড়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা বা রাতের নৌযাত্রা মানেই মৃত্যুভয়। শীতকালে কুয়াশায় চারপাশ ঢেকে যেত। তখন শুধু কেরোসিনের হ্যাজাক বাতির আলো পানিতে প্রতিফলিত হতো।

সন্দ্বীপের মানুষের জন্য এই নৌপথ ছিল জীবনরেখা। চিকিৎসার প্রয়োজনে, ব্যবসার কাজে কিংবা আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে তাদের সীতাকুণ্ডে আসতে হতো। সবচেয়ে কষ্ট হতো রোগীদের নিয়ে। অ্যাম্বুলেন্সের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। বাঁশের খাটিয়ায় শুইয়ে কোনোভাবে নৌকায় তোলা হতো। সাগরে দুলতে দুলতে তারা জানত না গন্তব্যে জীবিত পৌঁছাতে পারবে কিনা।

শতবর্ষের নৌ দুর্ঘটনার ইতিহাস

শত বছরে সন্দ্বীপ চ্যানেলে শত শত নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে, যার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর কিছু তথ্য জানা গেছে। ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল গুপ্তছড়া ঘাটের কাছে নৌকাডুবিতে ১৮ জনের মৃত্যু হয়। ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল কুমিরাগুপ্তছড়া রুটে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিন শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সন্দ্বীপচট্টগ্রাম নৌরুটে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ২২ জনের প্রাণহানি ঘটে। সীতাকুণ্ডে সাংবাদিকতা করার সময় নৌকাডুবির খবর পেতে কতবার ছুটে গিয়েছি তার হিসাব নেই। প্রতিটি ঘটনাই ছিল হৃদয়বিদারক।

সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ ছিল না। জেনারেটরের সাহায্যে কিছু সময়ের জন্য সীমিত এলাকায় আলো জ্বলত। নানা দুর্ভোগের কারণে বহু পরিবার সন্দ্বীপ ছেড়ে সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর বা অন্যত্র বসতি গড়েছে। নদী ভাঙনের ফলে হাজারো মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে, যাদের অনেকেই এক জীবনে আর জন্মভূমিতে ফিরতে পারেনি।

আমার জীবনে মাত্র তিনবার সন্দ্বীপে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। প্রতিবার যাতায়াতের কষ্ট এতটাই দুর্বিষহ ছিল যে, তা কখনোই ভুলতে পারব না। আমার বাবা যৌবনে বন্ধুদের সাথে সন্দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে নৌকাডুবির কবলে পড়েন। তিন দিন সাগরে ভাসার পর অর্ধমৃত অবস্থায় কুমিরা উপকূলের জেলেরা উদ্ধার করেন তাকে। বাবার নৌকাডুবি সন্দ্বীপের প্রতি ভীতির সৃষ্টি করেছিল। আমার বন্ধু সাংবাদিক সালেহ নোমান বহুবার দাওয়াত দিয়েও আমাকে সন্দ্বীপমুখো করতে পারেননি। কিন্তু আজ সন্দ্বীপে ফেরি চালু হওয়ায় আমার মতো অনেকের দুঃসহ স্মৃতির অবসান হলো।

একটি ছোট উদ্যোগ যে কীভাবে মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে তার উজ্জ্বল উদাহরণ সন্দ্বীপ ফেরি সার্ভিস। সন্দ্বীপের সন্তান, একজন উপদেষ্টার প্রচেষ্টায় আজ দ্বীপবাসী নতুন এক সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। আমার বিশ্বাস, অদূর ভবিষ্যতে সন্দ্বীপ চ্যানেলে একটি স্থায়ী সেতু নির্মিত হবে। তখন আজকের দিনটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। কারণ এদিন সন্দ্বীপের মানুষ প্রথমবারের মতো গাড়ি নিয়ে বাপদাদার ভিটেয় গেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপিতা-মাতার সেবার মাধ্যমে মিলে জান্নাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি
পরবর্তী নিবন্ধসন্দ্বীপবাসীর রেমিট্যান্সে দ্বীপটির আমূল পরিবর্তন ঘটানো যায়