সন্দ্বীপবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল নিরাপদ নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা। সেই স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু হলো। ফেরি গেল সন্দ্বীপে। সাথে গাড়ি আর মানুষ গেল। সন্দ্বীপবাসীর বহুল আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফেরি সার্ভিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো। এ উপলক্ষে সন্দ্বীপের উপজেলা পরিষদ চত্বরে গতকাল সোমবার সকাল ১১টায় জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমেরিকা–ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সন্দ্বীপের মানুষের বিচরণ। তারা যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠায়, তার ক্ষুদ্র একটা অংশে সন্দ্বীপের আমূল পরিবর্তন ঘটানো যায়। সন্দ্বীপ বাংলাদেশের অন্যতম উপকূলীয় দ্বীপ। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। মধ্যযুগীয় বাহনে করে এখানকার মানুষ যাতায়াত করে, যা অকল্পনীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ ও ২৪–এর গণঅভ্যুত্থানে নিহত বীর শহীদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন মুহাম্মদ ইউনূস। দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে এতদিন নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকাকে লজ্জার বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সন্দ্বীপের মানুষ এতদিন কাদা মাড়িয়ে ডিঙি নৌকায় আর বোটে করে কেন সমুদ্র পারাপার করতে হবে? সন্দ্বীপ দেশের অন্যতম উপকূলীয় দ্বীপ। কিন্তু ৫০ বছরের মধ্যেও কেন নিরাপদ যোগাযোগ গড়ে উঠেনি, কী লজ্জার কথা! সন্দ্বীপের সাথে আজ নিরাপদ যোগাযোগ স্থাপিত হলো। কেন এতদিন হয়নি. সেটা লজ্জার। এ লজ্জা থেকে বাঁচলাম। কলঙ্ক থেকে আজ মুক্ত হলাম।
শুধু সন্দ্বীপের জন্য না, পুরো চট্টগ্রামের জন্য আজ আনন্দের দিন মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেন, স্বাধীনতার মাসে আপনাদের এ সুখবর দিতে পেরে আমি আনন্দিত। সন্দ্বীপের এ অগ্রযাত্রা আজ শুরু হলো, আরও সুন্দর হবে। এভাবে সব অঞ্চলের সুষম উন্নয়নের মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে যাবে–এটাই প্রত্যাশা।
এর আগে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ঘাটে ফেরি সার্ভিস উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। এ সময় ৬ জন উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার দুজন বিশেষ সহকারী উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনকালে নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেন, চট্টগ্রাম–সন্দ্বীপ রুটে সরাসরি এই ফেরি সেবা চালুর মধ্য দিয়ে সন্দ্বীপবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো। বাস, ট্রাক, ট্যাংক লরি, মিনিবাস, প্রাইভেট কারসহ সব ধরনের যানবাহন সরাসরি দ্বীপে পৌঁছানোর সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় সন্দ্বীপবাসীর জীবনযাত্রার মান ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
এরপর তারা ফেরিযোগে সন্দ্বীপ আসেন। সকাল ৯টায় সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া থেকে সমুদ্রপথের প্রথম ফেরি ছেড়ে যায় সন্দ্বীপের গুপ্তছড়ার উদ্দেশে। এক ঘণ্টার যাত্রায় ফেরিটি দ্বীপে পৌঁছালে ফেরিঘাটে মানুষ একে স্বাগত জানায়।
উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, ২০০৪ সাল থেকে কুমিরা–গুপ্তছড়া নৌঘাটে স্থাপনা নির্মাণ কাজ শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। অবকাঠামো নির্মাণে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যাতে দ্বীপবাসীর নৌ যাতায়াত স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ হয়। তিনি বলেন, জোয়ারের সময় নতুন ফেরিঘাট কিছুটা ডুবে থাকে। সেটা নিয়ে কাজ করব।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি বলেন, এ নৌ রুটে উপকূলীয় অঞ্চলে সবসময় চলার উপযোগী ফেরি চালু হবে শীঘ্রই। যাতায়াত ব্যবস্থায় উন্নতি করার মাধ্যমে সন্দ্বীপ উপজেলায় পর্যটন শিল্প বিকশিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আজকে আমি খুশি, কারণ এখন থেকে আমি গাড়ি চালিয়ে আপনাদের এখানে বেড়াতে আসতে পারব। আপনারাও এখন থেকে গাড়ি চালিয়ে ঢাকায় আমার বাসায় বেড়াতে আসতে পারবেন। তিনি বলেন, একটু সদিচ্ছা থাকলে, একটু ফান্ড থাকলে যেকোনো বড় কাজ যে দ্রুত শেষ করা যায় তার একটা উদাহরণ আজকের এ ফেরি সার্ভিস উদ্বোধন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক বলেন, সন্দ্বীপের অনেকে একাত্তর সালে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, আমরা যাতে আমাদের শিশুদের সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করতে পারি সে লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করতে হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, গণঅভ্যুত্থানের ফসল এ ফেরিঘাট। যেটা ৭ মাসে করা হয়েছে সেটা কেন গত ৫০ বছরে হয়নি, এর জবাবদিহি করতে হবে। তিনি বলেন, ভারতের সাথে মিলিয়ে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা ৬৫ দিনের স্থলে ৫৮ দিন করা হয়েছে, যাতে অন্য কেউ আমাদের নিষেধাজ্ঞা সময়ের সুযোগ নিয়ে মাছ ধরে নিয়ে যেতে না পারে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, সন্দ্বীপের অনেক রোগী ঠিক সময়ে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে না পারার কারণে মৃত্যুবরণ করে বলে জানতে পেরেছি। আমরা এটা থেকে পরিত্রাণের জন্য কাজ করব।
প্রধান উপদেষ্টার আরেক বিশেষ সহকারী খোদা বখশ চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকারের লক্ষ্য একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেশবাসীকে উপহার দেওয়া।
অনুষ্ঠানে সন্দ্বীপের সন্তান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, সন্দ্বীপের ঘাট উন্মুক্ত করা, বিআরটিসি বাস চালু করা, ফেরি সার্ভিস চালু করার জন্য আপনারা আমার ও আমার পরিবারের জন্য যে দোয়া ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তবে এর পেছনে মূল কারিগর প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনুস ও তার সরকার। সাগরে ফেরি চালু করা একটি দুরূহ প্রকল্প। এতদিন এটা চালু না হওয়ার অন্যতম কারণ এটি।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন সন্দ্বীপবাসীর অনুমতি নিয়ে দুই ঘাটের নাম জুলাই আন্দোলনের শহীদ সাইমন ও শহীদ সৈকতের নামে নামকরণের নির্দেশ দেন। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসি ফেরিঘাট এবং স্টিমারের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন বলে জানান তিনি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এডহক কমিটির সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি, মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ শাহনওয়াজ, সন্দ্বীপের সাবেক এমপি মোস্তফা কামাল পাশা, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভুঁইয়া মিল্টন, জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম উত্তর জেলার আমির আলাউদ্দীন শিকদার, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি সালেহ নোমান, সন্দ্বীপ মেরিন সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন ভুঁইয়া, সন্দ্বীপ প্রেস ক্লাবের সেক্রেটারি ওমর ফয়সাল, জাতীয় নাগরিক পার্টির এহসানুল জোবায়ের, সাইফুর রহমান খান প্রমুখ। অনুষ্ঠানে জুলাইয়ে আন্দোলনে শহীদ সন্দ্বীপের দুই তরুণ সাইমন ও সৈকতের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সমুদ্র পথে চট্টগ্রাম–সন্দ্বীপ) ফেরি চলাচল শুরু হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া থেকে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া পর্যন্ত এই ফেরি চলাচল করবে। ফেরি সার্ভিস উদ্বোধনের মাধ্যমে সন্দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ফলে এই দ্বীপ উপজেলায় বসবাসকারী চার লাখ মানুষের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।