চকরিয়ার বদরখালীতে ডাকাত–সন্ত্রাসী ছেলের অত্যাচারে বাড়ি ছাড়া হয়ে পড়েছে বৃদ্ধ বাবা–মা, ভাইসহ পরিবারের সদস্যরা। শুধু তাই নয়, এই সন্ত্রাসীর কারণে এলাকা ছাড়া হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন ভুক্তভোগী ৭ পরিবার। খোদ বাবাসহ ভুক্তভোগী এসব পরিবার থানা ও আদালতে মামলা করলেও তাকে ধরতে পারছে না পুলিশ। এই অবস্থায় গত ১৫ দিন ধরে নিজের বাবা–মা, ভাইসহ এলাকার ভুক্তভোগী অন্তত সাতটি পরিবারের সদস্যরা ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে– আপন বাবা ও মা, আপন ছোট ভাই শাহজাহান, বড় ভাই রাহামত উল্লাহ, স্থানীয় আমিনুল ইসলাম, সেলিনা আক্তার, আবদুল কাদেরের পরিবার।
দুর্ধর্ষ এই ডাকাত–সন্ত্রাসীর নাম দিদারুল ইসলাম (৩৮)। সে চকরিয়ার উপকূলীয় বদরখালী ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর নতুনঘোনা পাড়ার আবদুল কাদেরের ছেলে। গত একবছর ধরে সে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা ছাড়াও উপকূলীয় চিংড়ি জোনে প্রতিনিয়ত ডাকাতি–দস্যুতাসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করতে একটি সশস্ত্র বাহিনীও গঠন করেছে। সেই বাহিনীই পুরো বদরখালী ইউনিয়নকে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত করেছে বলে ভুক্তভোগী এবং বদরখালী ইউনিয়নের সচেতন জনগণ দাবি করেছেন। ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সচেতন জনগণের এই দাবির সত্যতাও মিলেছে।
সন্ত্রাসী দিদারুল ইসলামের বিষয়ে পুলিশের ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (সিডিএমএস) লিপিবদ্ধ থাকা তথ্যানুযায়ী অন্তত দশটি মামলার তথ্য মিলেছে। ডাকাতি, দস্যুতা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ নানা অপরাধে এসব মামলা রুজু হয় চকরিয়া, পেকুয়া থানা ও উপজেলা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে।
চকরিয়া থানার উপ–পরিদর্শক (এসআই) মো. আরকানুল ইসলাম আদালতে একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেই প্রতিবেদনের সঙ্গে তার অপরাধসহ মামলার বর্ণনাও তুলে ধরেন এসআই আরকানুল ইসলাম। এর পরও তার লাগাম টেনে ধরতে পারছে না পুলিশ।
বড় ভাই দিদারুল ইসলামকে ডাকাত–সন্ত্রাসী দাবি করে আপন ছোট ভাই মো. শাহজাহান দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা বড়ই হতভাগা। কারণ নিজের বড় ভাই হয়েও প্রতিনিয়ত তার সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, ডাকাতিসহ নানা অপরাধের কারণে আমরা অতিষ্ট হয়ে পড়েছি। আমার স্ত্রী কামরুন্নাহারকে সম্প্রতি পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। এই ঘটনায় মামলা করার কারণে সপরিবারে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছে। এই অবস্থায় গত ১৫ দিন ধরে বাড়ি ছেড়ে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। আমরা প্রশাসনের কাছে ডাকাত–সন্ত্রাসী বড় ভাই দিদারুল ইসলামের যথোপযুক্ত শাস্তি চাই।’
নিজের সন্তানের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন বাবা আবদুল কাদের (৬৫) ও মা মাহমুদা বেগম (৬০)। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বৃদ্ধ বাবা আবদুল কাদের বলেন, আমার ১০ পুত্র সন্তান রয়েছে। তন্মধ্যে দিদারুল ইসলাম পঞ্চম পুত্র। উপকূলীয় বদরখালী সমবায় কৃষি ও উপনিবেশ সমিতি ও সরকার থেকে আমার নামে ১৫০ একর চিংড়ি প্রকল্প বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। সেই বিশাল চিংড়ি প্রকল্পটিও দিদারুল ইসলাম জবর–দখল করে নিয়ে ভোগ করছে। সেখানে আমি (বাবা) এবং অন্যান্য সন্তানেরা গেলে তাদেরকে পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয় দিদারুল।
বাবা আরও বলেন, আমার নামের চিংড়ি প্রকল্প দখল করে নেওয়া ছাড়াও আমাদেরকে (স্ত্রী ও সন্তানদের) শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচণ্ড নির্যাতন করার কারণে থানা ও আদালতে মামলা করি। একটি মামলায় সে গ্রেপ্তার হয়ে কয়েকদিন পর জেল থেকে বেরিয়ে পড়ে। এর পর থেকে আবারও শুরু হয় নির্যাতন। সেই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি। এখন নিজের বাড়িতেও যেতে পারছি না ডাকাত–সন্ত্রাসী পুত্র দিদারুল ইসলাম ও তার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের কারণে। এলাকা ছাড়া হওয়া উল্লেখিত ভুক্তভোগী পরিবারের একাধিক সদস্য বলেন, ‘দিদারুল ইসলামের সঙ্গে তাদের কোন ব্যক্তিগত বিরোধ নেই। শুধুমাত্র পুলিশের কাছে স্বাক্ষ্য দেওয়ার কারণে তাদের পরিবারকেও এলাকা ছাড়তে হয়েছে। বর্তমানে দিদারুল ইসলাম তার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে।
নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে বদরখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এক চেয়ারম্যান দৈনিক আজাদীকে বলেন, বর্তমানে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয়ে ওঠেছে সমুদ্র উপকূলের বদরখালী ইউনিয়নটি। এখানে প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকায় চুরি, ছিনতাই, দস্যুতা, ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করা হচ্ছে। এসবের মূলেও দিদার ও তার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাই আইন–শৃক্সখলা বাহিনীগুলো যদি এলাকাকে অপরাধমুক্ত রাখতে চান তাহলে দিদারসহ বাহিনীর সদস্যদের গ্রেপ্তার এবং তাদের হেফাজতে থাকা অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারে উদ্যোগ নিতে হবে। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় অভিযুক্ত দিদারুল ইসলামের সঙ্গে। কিন্তু তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের চকরিয়া সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) অভিজিত দাস দৈনিক আজাদীকে বলেন, সন্ত্রাসের জনপদের তকমা থেকে উপকূলীয় বদরখালীকে শান্ত বদরখালীতে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ডাকাত–সন্ত্রাসী দিদারুল ইসলাম ও তার সাঙ্গপাঙ্গোদের বিষয়ে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌহিদুল আনোয়ার দৈনিক আজাদীকে বলেন, উপকূলীয় বদরখালী জনপদে শান্তি ফেরাতে যত বড় সন্ত্রাসী বা ডাকাত হউক না কেন তাদের লাগাম টেনে ধরার কাজ চলমান রয়েছে। স্থানীয় জনগণের সহায়তা নিয়ে পুলিশ অবশ্যই এই কাজ বাস্তবায়ন করবে।