চট্টগ্রামের নবাগত ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘হাইওয়ে পুলিশ কিংবা জেলা পুলিশ বা ট্রাফিক পুলিশ কিংবা থানা পুলিশ বলে কোনো কথা নেই। কথা একটাই- টেকনাফ থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত রাস্তায় কোনো পুলিশ সদস্য যদি কোনো গাড়ি থেকে এক টাকাও চাঁদা দাবি করে তাহলে তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। তার বিরুদ্ধে নেয়া হবে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ওই পুলিশ কোন ইউনিটের সদস্য বা কার আত্মীয় তা বিবেচনা করা হবে না।’
গতকাল সকালে দৈনিক আজাদীর সাথে একান্ত আলাপচারিতায় পুলিশের ডিআইজি পদকে ‘ফিল্ড অফিসার’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে চাকরি করার সুযোগ ডিআইজির নেই। একজন ডিআইজিকে তার রেঞ্জের সবকিছু দেখভাল করতে মাঠে ময়দানে থাকতে হয়। এজন্য চট্টগ্রামে যোগদানের ৬০ দিনের মধ্যে ৩৮ বার আমি রেঞ্জের আওতাধীন বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল সফর করেছি। গিয়েছি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ছুটে গিয়েছি নোয়াখালীতে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনাস্থলে। কুমিল্লার মুরাদনগরের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনাস্থলেও ছুটে গিয়েছি দ্রুত।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যে কোনো ঘটনাস্থলে ডিআইজি যাওয়ার ব্যাপারটি আলাদা একটি গুরুত্ব বহন করে। ডিআইজির গেলে সাথে এসপি, এডিশনাল এসপি, এএসপি, ওসি ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ১০/১২টি গাড়ি যায়। পুলিশের বিশাল একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে। কোনো গ্রামে পৌঁছে। এত পুলিশের উপস্থিতি দেখতেই স্থানীয় শত শত লোক জড়ো হয়। তাদের কাছে একটি বার্তা পৌঁছানো যায়। গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ পুলিশী তৎপরতা দেখে। গ্রামের মানুষও একটি বার্তা পায়। আর এই বার্তাটি হচ্ছে ‘পুলিশ বসে নেই’।’ পুলিশের এই তৎপরতাই সন্ত্রাসীদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে ভিত কাঁপিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
পুলিশের তৎপরতার এই ম্যাসেজটি দেয়ার জন্যই চট্টগ্রাম রেঞ্জের আওতাধীন ১১টি জেলার নানা অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছেন উল্লেখ করে ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পুলিশের মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবে মাঠের সব সমস্যাগুলো কাছ থেকে দেখা এবং সমাধানের চেষ্টা করছি।’ তিনি চট্টগ্রাম রেঞ্জের ১০৮টি থানা এলাকায় একটি মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে যারা এই রেঞ্জে চাকরি করে নিজেদের ঘরবাড়ির মতো বানিয়ে ফেলেছেন তাদের বদলি করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
ডিআইজি বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এদের একেকজন ২০/২৫ বছর চট্টগ্রামে চাকরি করছেন। ৯৬ সাল থেকে চট্টগ্রামে চাকরি করছেন এমন অফিসারও রয়েছে। ৯৮-৯৯ কিংবা ২০০০ সাল থেকে ঘুরে ফিরে চট্টগ্রাম রেঞ্জে চাকরি করছেন এমন বেশ কয়েকজন অফিসার ছিলেন।’ কারো কারো নামের সাথে ডনও যুক্ত হয়েছে উল্লেখ করে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এটা তো হওয়া উচিত নয়। এই ধরনের কর্মকর্তাদের বদলি করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আজ একদিনেই চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ফটিকছড়ি এবং পটিয়াসহ রেঞ্জের মোট আট থানার ওসিকে বদলি করা হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ওসির দায়িত্ব পালনকারীদের সরিয়ে নতুন নতুন কর্মকর্তাকে ওসি হিসেবে নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’ শুধু ‘অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞতা’ করার সিস্টেমের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘নতুনদের দায়িত্ব না দিলে অভিজ্ঞতা হবে কিভাবে? নতুনদের কাজে লাগাতে হবে। তাই চট্টগ্রাম রেঞ্জের ১০৮টি থানায় পরিবর্তন আনা হবে। প্রথম দিনই আটজনকে বদলি করা হয়েছে। ওইসব থানাগুলোতে সংশ্লিষ্ট জেলার এসপি নতুন অফিসার নিয়োগ দেবেন। এক্ষেত্রে ডিআইজির আর কোনো পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নেই। এসপি কাকে দিয়ে কাজ করাবেন তা তিনি বুঝবেন। তবে এসপি ভুল করলেই সেখানে আমি দেখব। চেইন অব কমান্ড অনুসরণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।’ কোনো ধরনের তদবির বা রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো ধরনের পদায়ন বা বদলির ঘটনা ঘটবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। তদবির না করে নিজেদের যোগ্যতা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দেয়ার জন্য তিনি অধঃস্তন কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। এক প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি বলেন, ‘প্রত্যেক কাজেরই সুবিধা-অসুবিধা থাকে। অসুবিধাটি বাদ দিয়ে আমি সুবিধাকে কাজে লাগাতে চাই।
তিনি পুলিশ ইন্সপেক্টরদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ওসি হওয়ার জন্য দেওয়ানা হয়ে যান, তদবির করেন। নেতাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বসে থাকেন। অথচ নিজেকে যোগ্য করতে পারেন না। ওসির দায়িত্ব নিলে ওই থানার আইন শৃঙ্খলার যাবতীয় দায়িত্ব নিতে হবে। টহল দিতে হবে। সন্ত্রাসীদের ঘুম হারাম করে দিতে হবে। তা না করে নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরলে আর ওসিগিরী করা যাবে না। তিনি চট্টগ্রামে যোগদানের পর শুধুমাত্র একজন নেতা তদবির করেছিলেন উল্লেখ করে বলেন, আমি বিনীতভাবে বলেছি আপনার দায়িত্ব এলাকার উন্নয়নমূলক কার্যক্রম দেখা। আইন শৃংখলা দেখার দায়িত্ব এসপির। ওনাকে ওনার কাজ করতে দিন। আপনি শান্তিতে থাকবেন। এরপর আর ওই নেতা কিংবা অন্য কোনো নেতা আর কোনো তদবির করেননি বলে জানান ডিআইজি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ক্রিমিনালের ভয়ে সাধারণ মানুষ পালাবে কেন? এই দেশ কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। কোনো ধর্ম বিবেচনা করারও সুযোগ নেই। এই দেশ সবার। সব ধর্মের মানুষ এখানে বসবাস করবে। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ নিরাপদে এবং নির্ঝঞ্জাটে বসবাস করবে, ক্রিমিন্যালই পালিয়ে যাবে। সাধারণ মানুষ পালাবে কেন?
চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, বি বাড়িয়া থেকে শুরু করে কঙবাজার পর্যন্ত চট্টগ্রাম রেঞ্জের ১১টি জেলার ১০৮টি থানাকে নিয়ে নিজের বিশেষ কিছু পরিকল্পনা আছে উল্লেখ করে ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, কোথাও কোনো স্থবিরতা রাখা হবে না। প্রতিটি ইউনিটেই একটি গতিশীলতা তৈরি করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি যে কোনো ধরনের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও কিশোর গ্যাংসহ সব ধরনের অপরাধে জড়িতদের অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হবে উল্লেখ করে বলেন, কে কোন দল করেন কিংবা কে কার আত্মীয় তা বিবেচনা করা হবে না। চট্টগ্রাম রেঞ্জের বিস্তৃত অঞ্চলকে বাসযোগ্য রাখতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।