সন্তানের হাতে স্মার্ট ফোন: অভিভাবকের দায়িত্ব-কর্তব্য

ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী | সোমবার , ৫ আগস্ট, ২০২৪ at ৪:৪৮ পূর্বাহ্ণ

ভূমিকা :

চলতি শতকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন ছেয়ে গেছে মিডিয়া সংস্কৃতির জোয়ারে। বেতার, টেলিভিশন, সিনেমা, ভিডিও গেমস্‌, মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ঘিরে ধরেছে শিশুর মন ও শরীর। তার কোন কোনটা সবুজঅবুঝ বাড়বাড়ন্ত শরীরমনের সুস্থস্বাভাবিক বিকাশবৃদ্ধির হমকিস্বরূপ।

ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ‘পাবলিক হেলথ ইস্যু ’ হিসেবে বিবেচনায় না নিয়ে অভিভাবক, গবেষক এবং নীতি নির্ধারকেরা এখনো চরম উদাসীনতা প্রদর্শন করছেন। কেউবা বসে আছেন একে ‘অবসরের বিনোদন’ গণ্য করে। বস্তুত এখনিই সময়মিডিয়া জালে বন্দী শিশুদের ওপর তার প্রভাব নিয়ে ভাববার। কেননা এই ডিভাইসপ্রীতি এবং অপব্যবহার শিশুর মনোসামাজিক সুরক্ষার অন্তরায়।

সেকাল ও একালের শৈশবে পার্থক্য:

ঠাকুর দাদার ছুটি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমার ছুটি নীল আকাশে, তোমার ছুটি মাঠে,

তোমার ছুটি থইহারা ওই দিঘির ঘাটে ঘাটে।

তোমার ছুটি তেঁতুলতলায়, গোলাবাড়ির কোণে,

তোমার ছুটি ঝোপঝাপে পারুলডাঙ্গার বনে।

তোমার ছুটির আশা কাঁপে কাঁচা ধানের ক্ষেতে,

তোমার ছুটির খুশি নাচে নদীর তরঙ্গেতে।

মিডিয়া শিশু : ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী

তোমার ছুটি ছাদের নিচে, তোমার ছুটি সোফায়,

তোমার ছুটি থইহারা ওই ফেইস্‌ বুকেতে ফোঁপায়।

তোমার ছুটি টিভিতলায়, মোবাইল সেটের কোণে,

তোমার ছুটি ইন্টারনেটে কার্টুনম্যুভির বনে।

তোমার ছুটির আশা কাঁপে কম্পিউটার উইনডোতে,

তোমার ছুটির খুশি নাচে ভিডিও গেমস্‌ শোতে।

বর্তমানের শিশু কতটা পরিমাণ মিডিয়া স্রোতে ডুবে আছে:

শিশুর স্মাার্ট ফোন ব্যবহার করতে দেওয়ার সঠিক বয়স সুনিদিষ্ট নয়। কেননা একেক শিশুর বিকাশবৃদ্ধির গতিপথ ও বেড়ে ওঠার ধরন তার নিজস্ব প্রকৃতির। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক তথ্যমতে বলা হয়৬ স্কুলগ্রেড বা ১২ বছর বয়স (পূর্বে যা নির্ধারিত ছিলো৮ স্কুল গ্রেড, ১৪ বছর বয়স) থেকে শিশু এর সঠিক ব্যবহার রপ্ত করতে সক্ষম ।

মাবাবা সাধারণভাবে আপন সন্তান দুষ্ট প্রতিবেশি ও সহপাঠীদের পাল্লায় পড়বে বলে দুশ্চিন্তায় থাকেন। কিন্তু তাঁরা ভেবে দেখেন নাএই খারাপ সংসর্গ বরং এখন ঘরের মধ্যে। যখন ২০ ফিট দূরে থাকা এক চোখা টেলিভিশন জাদুকর, ২ ফিট দূরের কম্পিউটার উইনডো, কিংবা ১০ ইঞ্চি তফাতে থাকা সেল ফোনের সাহচর্যে সে সময় কাটাচ্ছে।

আামেরিকাতে শতকরা ৮০ জন ছেলেমেয়ে যে কোন এক প্রকারের মিডিয়ায় সময়যাপন করে, টেক্সট ম্যাসেজ, ই মেইলকোনো ব্লগ বা ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতিতে।

দৈনিক সময় কাটানোর পরিমাণ ৬ ঘণ্টা ২১ মিনিট। শোবার ঘরে টেলিভিশন দেখে এক চতুর্থাংশ শিশু।

শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর কাজকর্ম, কম্যুনিটি ও সোশ্যাল ক্রিয়াকর্ম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার।

ছোট বাচ্চা যারা ফ্যান্টাসি ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য বোঝে নাতারা এবয়সে ভয়ংকর দৃশ্য অবলোকন পরবর্তী আচরণজনিত জটিল সমস্যায় পতিত হয়।

শিশুর ওপর মিডিয়া সংস্কৃতির কুফল :

শিশুর বাক্‌স্ফুটুন সমস্যা: বয়সে, শিশুর মস্তিষ্ক স্নায়ুতারজালি ঘিরে থাকা বাক্‌শক্তি বিকাশের যে বিন্যাস স্তর, তা ঘরে প্রচলিত মাতৃভাষা ও মিডিয়ায় উচ্চারিত অন্যভাষার মধ্যে গরমিল দেখেশোনে খেই হারিয়ে ফেলে, তার বাক্‌শক্তি বিলম্বিত হয়।

মারদাঙ্গা ছবির বিষয়বস্তু তাকে মারমুখী করে গড়ে তোলে, সে তাৎক্ষণিকভাবে তা প্রয়োগও করতে চায়। ভায়োলেন্স দৃশ্যায়ন তাকে ভয় পাইয়ে দেয়, সে বিষণ্নতা ও দুঃস্বপ্নে ভোগে। তার মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হয়, ও তার স্কুল ফলাফল খারাপ হয়– (গবেষকইয়ামা এট্‌ অল্‌)

সুইসাইড প্রবণতায় ইন্ধন। ডানপিটেদুরন্তপনা প্রবৃত্তি, শিশুর প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা।

মাঠে খেলাধুলার মাধ্যমে শিশু সামাজিক নিয়মনীতিসূত্রের শিক্ষা পায়। কিন্তু তার চারপাশের ভুবনব্যাপী থাকা টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেটের ছড়াছড়ি, তাকে গড়ে তোলে অসামাজিক জীব হিসেবে।

স্থূলকায় হবার ঝুঁকি: সপ্তাহে ১ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় টেলিভিশন দেখার খেসারত হিসেবে শিশুর ওজন প্রায় ২ শতাংশ বাড়ে। এসব শিশু অভিভাবককে রাজী করিয়ে বিজ্ঞাপনে প্রলোভিত নানা অস্বাস্থ্যকর খাবার মেন্যুর স্বাদ বেছে নেয়। এরা ফলমূল, শাকসবজী খায় কম। এ কারণে রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্য অণুপুষ্টি গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়।

কিশোরী কন্যারা ‘ফ্যাশন ম্যাগাজিন’ পড়েদেখে ‘স্লিম নায়িকা’ হওয়ার ঘন স্বপ্ন দৌড় ফাঁদে কংকালসার অস্বাস্থ্যের শিকার হয়।

ধূমপান, অ্যালকোহল ও মাদকাসক্তি। পিআইডিসহ বিপজ্জনক যৌনব্যাধি ও অবাঞ্চিত গর্ভধারণ ঝুঁকি ।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগে পরিচালিত গবেষণা ফল:

শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের শিশুবিকাশ কেন্দ্রে আসা ‘দেরিতে কথা বলা ’ উপসর্গের বেশি হার লক্ষ্য করে দায়িত্বে থাকা আমার মেধাবী ছাত্রী ডা. রাজিয়া সুলতানা মণিকে গবেষণাকমের্র দিক্‌নির্দেশিকা তৈরি করে দিই। বর্তমানে শিশুস্বাস্থ্যের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজিয়া ৬০ জন শিশুর ওপর সুচারুভাবে সমীক্ষাটি সম্পন্ন করেন, যা ‘সার্ক আন্তর্জাতিক শিশুস্বাস্থ্য বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে’ গবেষণাপত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছিলাম।

গবেষণায় প্রাপ্ত মূল উপাত্ত (স্টাডি সামারি)- ছেলে (৮০ শতাংশ), উচ্চবিত্ত, পৌর এলাকায়আরবান বসবাস(৬০ শতাংশ), দৈনিক ৩ ঘন্টার অধিক ও একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল দেখা, মায়ের কম সাহচর্য সময় পাওয়া সন্তানে ‘দেরিতে কথা বলা, বা ‘স্পীচ্‌ ডিলে’ উপসর্গের সাথে যোগসূত্র রয়েছে।’

শিশুবয়সে মিডিয়ামাধ্যম ব্যবহারের নানা সুফল :

এ প্রসংগে রবীন্দ্রনাথের ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধটি স্মরণযোগ্য। পাঠাগারের অধুনা রূপ হিসেবে বিবেচনায় রেখে গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনের সুপ্রয়োগ মানবজীবনে বিপুল জ্ঞানভান্ডার গুপ্তধন আহরণপথ সুগম করে দেয়।

শুভ চিন্তাচেতনার নানা চিত্রযোগ, জিওগ্রাফিক্যাল চ্যানেল, কুইজ প্রোগ্রাম দেখে ও বড় বড় রাষ্ট্রনায়কের ভাষণ শোনে, তার মেধাশক্তি শাণিত হয়। ভাষাজ্ঞানে সবলতা। শিশু স্পোকেন ইংলিশে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে, যেমনকার্টুন চ্যানেল।

একাকী শিশু সাহচর্য পায়, নিরানন্দ গুমোট আবহাওয়াজনিত বন্দিদশার মুক্তিদাতা।

মিডিয়া পরিচালন কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্ব :

প্রিন্ট মিডিয়া ‘মডেল উপস্থাপনে’ সতর্ক থাকবে। শিশুর জন্য স্বাস্থ্যকর বার্তা পরিবেশন, যেমনখেলাধুলা, স্বাস্থ্যকর খাবার মেন্যু বয়:সন্ধিকাল, স্থূলকায়ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে শিশুকে সচেতন করা।

ট্র্যাজিক সংবাদ পরিবেশনকালে শিশুমন যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়সেরূপ সাবধানতা অবলম্বন। মিডিয়া ব্যবহারে সর্বদা ৫সি মডেল ধারণচাইল্ড (শিশু), কনটেন্ট বিষয়বস্তু), কাম(শান্তভাব), ক্রাওডিং আউট(ঘিঞ্জি এড়ানো), ও কম্যুনিকেশন( যোগাযোগ)

মিডিয়া অপব্যবহার রোধে অভিভাবকের দায়িত্বকর্তব্য:

ক্ষতিকর চ্যানেল বিষয়ে সচেতনতা। শিশুকে সাথে রেখে চ্যানেল উপভোগ ও সে সম্পর্কিত খোলামেলা আলোচনা।

বিশেষজ্ঞ এডউনা ইউয়াং পিএইচডি জানাচ্ছেনশিশুর যতো কমবয়স থেকে মিডিয়া সময় সুচারুভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তা ততোই মঙ্গলজনক।

অভিভাবকের নিজের মিডিয়াসময় সীমিত রাখা ও অন্য অভিভাবকদের সাথে এ নিয়ে ভাবনা বিনিময়।

আমেরিকান এসোসিয়েশন অব প্যাডিয়ট্রিকসএএপি কর্তৃক শিশুবয়সে মিডিয়া ব্যবহার নির্দেশিকা:

ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে প্রতিপক্ষ না ভেবে, শিশুকিশোরবান্ধব রূপে ব্যবহারে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ।

১৮ মাসের কম বয়সী শিশুদের জন্য, ভিডিওচ্যাটিং ব্যতীত স্ক্রিন মিডিয়ার ব্যবহার এড়িয়ে চলা। ১৮ থেকে ২৪ মাস বয়সী বাচ্চাদের বাবামা যারা ডিজিটাল মিডিয়া চালু করতে চান, তাদের উচিত উচ্চমানের প্রোগ্রামিং বেছে নেওয়া এবং বাচ্চাদের সাখে একত্রে বসে দেখা।

২ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য, উচ্চমানের প্রোগামগুলোর জন্য প্রতিদিন ১ ঘন্টা স্ক্রীন ব্যবহারে সীমাবদ্ধ রাখা। অভিাবকদের উচিতসন্তানের সাথে মিডিয়া দেখা, তারা যা দেখছে তা বুঝতে এবং তাদের চারপাশের বিশ্বে তা প্রয়োগে সহায়তা দেওয়া।

৬ বছর বা তার বেশি বয়সী শিশুদের জন্য স্কুল খোলার দিনগুলোতে দৈনিক ১ ঘণ্টা ও স্কুল বন্ধের দিনে সপ্তাহে ২ ঘণ্টার মিডিয়া সময় নির্ধারণ। মিডিয়ার ধরনগুলোর উপর সামঞ্জস্যপূর্ণ সীমা বজায় রাখা এবং নিশ্চিত করা যে, মিডিয়া যেন সন্তানের পর্যাপ্ত ঘুম, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও আচারআচরণের জায়গা দখলে না নেয়।

টিভি, ভিডিও গেমস, ইন্টারনেট সরঞ্জামে সন্তানের শোবার ঘর যেন ‘মিডিয়া সেন্টারে’ পর্যবসিত না করা হয়। পরিবারে মিডিয়ামুক্ত সময় নির্ধারণ, যেমনআহার গ্রহণকালিন, গাড়ি চালানো অবস্থায় এবং সেইসাথে বাড়িতে মিডিয়া মুক্ত অবস্থান, যেমনশোবার ঘর।

অনলাইন নিরাপত্তা ও অনলাইনঅফলাইনে অন্যদের সাথে সম্মানের সাথে আচরণ শিক্ষা। অভিভাবক যেন নিজেই ‘আদর্শ মডেল’ হিসেবে ঘরেবাইরে ভূমিকা পালনে অবতীর্ণ হন।

লেখক : প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরক্তাক্ত আগস্ট ও সমসাময়িক রাজনীতি
পরবর্তী নিবন্ধফারিণ এবার দেবের নায়িকা, সঙ্গী মিঠুনও