ছেলে–মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে মা–বাবার টেনশনের শেষ নেই। নার্সারি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে ছেলে–মেয়েদের স্কুল পারফরমেন্স ভাল হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সবসময় উদ্বিঘ্ন থাকে। বিশেষ করে বর্তমানে এককেন্দ্রিক পরিবার, মা–বাবা উভয়ে চাকুরীজীবী হওয়ায় গৃহ পরিচালিকা কর্তৃক লালন পালন, অতিরিক্ত ডিভাইসের আসক্তি, সর্বোপরি নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থা সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সন্তানেরা লেখা পড়ায় অত্যধিক চাপের মধ্যে থাকে। আমার এই লেখায় ছাত্র–ছাত্রীদের স্কুল ফলাফল সন্তোষজনক না হওয়ার কারণ, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা সমাধান চিহ্নিতকরণ শেষে একটি সার্থক শিক্ষণীয় পরিবেশ তৈরীর ব্যাপারে আলোচনা করবো। ছাত্র–ছাত্রীদের স্কুল ফলাফল সন্তোষজনক না হওয়ার কারণ সমূহ পর্যালোচনা করলে প্রথমে আসে সন্তানের নানাবিধ মেডিকেল সমস্যা যা চিকিৎসার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। কোন শিশু স্বল্প ওজনের হলে তার স্নায়ুগত সমস্যা না হলেও তার মনোযোগের সমস্যা হতে পারে। অংকে ভাল ফল করে না। এছাড়া পুষ্টিহীন শিশু আমিষ ও নানা প্রকার ভিটামিন এর অভাবে বুদ্ধির পরিপূর্ণতা পায় না। আয়রনের ঘাটতি হলে শিশুর মেজাজ খিটখিটে হয়, লেখা পড়ায় মন বসে না। কৃমি সংক্রামক হলে শিশুর বৃদ্ধি হয় না, শিশু রক্তশূন্যতায় ভোগে। কোন শিশুর দীর্ঘ মেয়াদি রোগ থাকলে যেমন– হৃদপিন্ডের সমস্যা, শ্বাসের সমস্যা ইত্যাদি কারণে প্রায় ছাত্র–ছাত্রীকে স্কুলে অনুপস্থিত থাকতে হয়। শিশুর যদি কোন রক্ত রোগ থাকে যেমন– থ্যালাসেমিয়া বা রক্ত ক্যান্সার হলে সে চিকিৎসা করানোর ফলে নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না। কোন ধরনের হরমোনের সমস্যা হলে যেমন– থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি থাকলে শিশুর বুদ্ধির লেভেল স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে থাকে, উচ্চতায় খাটো হতে পারে। এমনকি মানসিক ভারসাম্যহীনও হতে পারে। শিশুর চোখের দৃষ্টি বা কানে শোনার কোন সমস্যা থাকলে স্কুলে শ্রেণি কক্ষে শিক্ষকের ক্লাস ঠিকমত অনুধাবন করতে পারে না। কারণ সে ভালোভাবে দেখতে বা শুনতে পারে না।
বাংলাদেশে স্বীকৃত ৪টি নিউরোডেভেলপমেন্ট সমস্যা হলে তার স্কুলে যাওয়া বা পড়ালেখা করা কঠিন হতে পারে। এদের মধ্যে অটিজম, সেরিব্রাল পলসি, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশু কেউই স্বাভাবিক স্কুলে পড়াশোনা করতে পারবে না। অটিষ্টিক শিশু লেখা পড়ার সময় অস্থির থাকবে। কোন কাজ শেষ করতে পারবে না। একটা ভয় তার মাঝে কাজ করে। ক্লাসে অতিরিক্ত লাফালাফি করে। সেরিব্রাল পালসি শিশুরা শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে স্কুলে যেতে কষ্টকর হয়। তাদের কথা বলার সমস্যা হতে পারে। প্রয়োজনে তাদেরকে ডিভাইস নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। ডাউন সিন্ড্রোম একটি জেনেটিক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের চেহারা বিশেষ ধরনের হয়ে থাকে। কথা শিখতে দেরি হয়। স্কুলে পড়াশুনা করতে পারে না। তারা হিসেবে গড়মিল করে ফেলে। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুরা স্থান, কাল, পাত্র কিছুই বুঝে না। আমাদের দেশে আয়োডিনের ঘাটতির ফলে শিশুরা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে থাকে। এইবুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্যও বিশেষায়িত স্কুলের প্রয়োজন হবে। এছাড়া অতি চঞ্চল শিশু কিংবা যাদের ন্যূনতম স্নায়ু সমস্যা আছে তারাও স্কুলে ভাল পারফরমেন্স করতে পারবে না। যদিও অতি চঞ্চল শিশুর মেধার কোন ঘাটতি নেই। তবে তাদের সমস্যা হচ্ছে তারা নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে স্থির থাকতে পারে না।
অনেক শিশু আছে যারা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার, পারিবারিক বিবাদ ও ঘরের পরিবেশ সু–শৃঙ্খল না হওয়ায় স্কুলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল করতে পারে না। কিছু কিছু মানসিক রোগও শিশুর পড়াশুনায় মনোযোগ দেওয়ার অন্তরায় হতে পারে। এছাড়া স্কুলের কোর্স কারিকুলাম অনেক ক্ষেত্রে শিশুর উপযোগী নাও হতে পারে। আমাদের দেশে বর্তমানে ত্রি–মূখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। একটি কিন্ডার গার্টেন ইংরেজী মাধ্যম, একটি সাধারণ বাংলা মাধ্যম ও আরেকটি হচ্ছে মাদ্রাসা ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা। সাধারণত মা–বাবার মনমানসিকতা ও আর্থিক সংগতি বিবেচনা করে ছেলে–মেয়েরা যে কোন একটি শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠদান করে। এতে অনেক সময় ছেলে–মেয়েদের উপর লেখাপড়ার চাপ থাকে বলে অনেক ছেলে–মেয়ে ঐ শিক্ষা ব্যবস্থায় কাঙ্খিত ফলাফল করতে পারে না। আজকাল স্কুলে এতো বেশি বিষয়ে পড়ালেখা করানো হয় যে, ছাত্র–ছাত্রীরা এমনকি মা–বাবারাও কঠিন সমস্যায় পড়ে। সে জন্য দেখা যায় যে, শিশুদের স্কুল ব্যাগে অনেক বই খাতা থাকে। ব্যাগ ভারি হয়ে যায়। এতে শিশুর পিঠে ব্যথা হতে পারে। এ ব্যাপারে অনেক গবেষণাও হয়েছে।
সর্বোপরি ছেলে–মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটাকে “স্ক্রীন টাইম” বলে। মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান একাডেমী অব পেডিয়েট্রিক এর পরামর্শ মত ২ বছর বয়স পর্যন্ত কোন শিশুকে মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস দেওয়া যাবেনা। ২–৫ বছর পর্যন্ত কেবল মাত্র ১ ঘন্টা সময় মা–বাবা ও গৃহপরিচালিকার তত্ত্বাবধানে মোবাইল দেওয়া যেতে পারে। ৫ বছরের অধিক শিশুদের তাও সীমিত সময়ের জন্য মোবাইল ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। যাতে করে শিশুর শারীরিক কার্যক্রম, ঘুম এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় অভ্যাসে ব্যাঘাত না ঘটে। যেমন কোন কোন শিশু ঘুম থেকে উঠেই দাঁত ব্রাশ না করে, নাস্তা না করে মোবাইল দেখা শুরু করে। এটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। কিন্তু এতে যাতে তার দৈনন্দিন রুটিনের ব্যাঘাত না হয়। মোবাইল ব্যবহারের ফলে শিশুর ওজন বাড়ে, অলস হয়ে যায়, দির্ঘক্ষণ ধরে একই স্থানে বসে থাকে বলে ঘাঢ়, কাঁধ ও মেরুদন্ডে ব্যথা হতে পারে। শিশুর আচরনণগত বুদ্ধির ঘাটতি হয়।
এখন এসব সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কিছুটা আলোচনা করছি–
প্রথমে শিশুদের কোন মেডিকেল সমস্যা থাকলে তার সঠিক চিকিৎসা করাতে হবে। এ ব্যাপারে শিশুর বিস্তারিত ইতিহাস নিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করতে হবে। শিশুর আচরণগত সমস্যার ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীর সাথে পরামর্শ করে বিভিন্ন ধরনের থেরাপি যেমন– স্পীচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, সাইকোলজিক্যাল এ্যাসেসমেন্ট করতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে স্বল্প ডোজে ঔষধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। এ সমস্ত শিশুর আচরণগত সমস্যার জন্য চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের “অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রে” রেফার করা যেতে পারে। এই শিশু বিকাশ কেন্দ্র সাইকোলজিষ্ট, স্পীচ থেরাপিষ্ট, অকুপেশনাল থেরাপিষ্ট, ফিজিও থেরাপিষ্ট, লো– ভিশন ও পুষ্টিবিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি অনবধ্য প্রতিষ্ঠান। এখানে একই ছাদের নিচে সব ধরনের সেবা গ্রহণ করতে পারবে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। ঐখানে নামমাত্র খরচে এই সেবা নিতে পারবে। বর্তমানে প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজে শিশু স্নায়ু রোগ বিশেষজ্ঞের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রয়োজনে এসব ছেলে– মেয়েদের বিশেষায়িত স্কুলে ভর্তি করানো যেতে পারে। যদিও আমাদের দেশে এসব স্কুল এখনো ব্যয় বহুল ও গুণগত মানসম্পন্ন নয়। তবে আমার পরামর্শ হলো মা–বাবা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নিজে তদারকি করলে এ সমস্ত শিশু প্রায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। তাই পরিবারের সদস্যদের শিশুর জন্য কি প্রয়োজন তা উপলব্ধি করতে হবে। শিশুর চোখে বা কানে সমস্যা হলে নাক,কান, গলা এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে চোখে চশমা ও কানে ডিভাইস ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ছাত্র–ছাত্রীদের স্কুল পারফরমেন্স উন্নতিকল্পে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। একসাথে না হলেও ক্রমান্বয়ে এ সকল পদক্ষেপ নিয়ে স্কুলে ছেলে–মেয়েদের স্কুল পারফরমেন্স বৃদ্ধি করা সম্ভব। এতে করে মা–বাবারাও স্বস্তিতে থাকবে।
পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম মা–শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল