সন্তানের মূল্যবোধ তৈরিতে পিতামাতার ভূমিকা

সালসাবিল করিম চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২৪ at ৯:১৮ পূর্বাহ্ণ

সন্তানের মূল্যবোধ তৈরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর করতে সাহায্য করে। মূল্যবোধ হলো সেই আদর্শ যা একজন ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন দিক থেকে গ্রহণ করে এবং এটি তাকে সঠিক ও ভুলের পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে। সন্তানদের মূল্যবোধ তৈরি করা মানে তাদের মধ্যে নৈতিকতা, সততা, দায়িত্ববোধ, সম্মানবোধ, সহানুভূতি এবং পরিশ্রমের মতো গুণাবলি বিকাশ করা। এখন আমরা বলতে পারি মূল্যবোধ তৈরি করা প্রয়োজন কেন? একটি সমাজের ভিত্তি হলো মূল্যবোধ। এটি ব্যক্তির আচরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জীবন যাপনে প্রতিফলিত হয়। সঠিক মূল্যবোধ না থাকলে সমাজে নৈতিক অবক্ষয়, অপরাধ এবং অরাজকতার পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া, মূল্যবোধ একজন ব্যক্তিকে সঠিক পথ নির্দেশ করে, এবং তাকে জীবনে উন্নতির পথে পরিচালিত করে। এজন্য সন্তানদের মধ্যে শৈশব থেকেই সঠিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা জরুরি।

মূল্যবোধ তৈরি একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন উপায়ে করা যায়। যেমনসন্তানদের মূল্যবোধ তৈরি করতে পারিবারিক পরিবেশের ভূমিকা অপরিসীম। বাবামা, পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের আচরণ এবং মূল্যবোধ সন্তানের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। পরিবারের বড়দের মধ্যে যদি সত্যবাদিতা, দায়িত্ববোধ, এবং সম্মানবোধের মতো গুণাবলি থাকে, তাহলে সন্তানরাও এসব গুণাবলি নিজেদের মধ্যে বিকশিত করার চেষ্টা করে।

মূল্যবোধ চর্চায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষা শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনের মাধ্যম নয়, এটি নৈতিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধ বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।এক্ষেত্রে বিদ্যালয় এবং শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের মতো গুণাবলি গড়ে তোলা। এছাড়াও স্কুলে বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং পরিশ্রমের মানসিকতা গড়ে তোলা যায়। যে বিষয়টি আমাদের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় সেটা হল ধর্মীয় শিক্ষার অভাব। ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সঠিক এবং ভুলের পার্থক্য বুঝতে শিখে।

ধর্মীয় অনুশাসন, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার শিক্ষা একজন সন্তানের জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপাসনা এবং ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে সন্তানদের মধ্যে বিশ্বাস, সততা, এবং সহানুভূতির মানসিকতা তৈরি করতে হবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা সমাজে বসবাস করতে গিয়ে করি না সেটা হল সন্তানের সাথে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন। সন্তানদের মূল্যবোধ তৈরি করতে সমাজের সাথে তাদের সংযোগ জরুরি। সমাজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, মানুষের সাথে মেলামেশা, এবং বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন মূল্যবোধ শেখে। যেমন, বয়স্কদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, দুর্বলদের সহায়তা করা, এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন ইত্যাদি। এসব কাজের মাধ্যমে সন্তানেরা সামাজিক মূল্যবোধ শিখে এবং সেগুলোকে জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে।

পরিবারে যতটা সম্ভব সন্তানের সাথে গল্প করার অভ্যাস গড়তে হবে। গল্প, উপন্যাস, এবং নীতিকথা শিশুদের মূল্যবোধ শেখানোর একটি অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম। বিভিন্ন নৈতিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধ নিয়ে লেখা গল্প বা রূপকথা শিশুদের মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলে। এসব গল্পের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, সহানুভূতি এবং সম্মানের মতো গুণাবলি বিকাশিত হয়। বাড়িতে এমন কিছু নিয়মাবলী এবং রুটিন তৈরি করতে হবে যা তাদের মূল্যবোধ তৈরির একটি কার্যকর উপায়। যেমন, নিয়মিত পড়াশোনা, খেলাধুলা, ঘরগুছানো, এবং পরিবারের অন্যান্য কাজে সহায়তা করার মাধ্যমে সন্তানদের দায়িত্ববোধ এবং পরিশ্রমের মানসিকতা তৈরি করা যায়।

পিতামাতা হিসেবে আমরা অনেক সময় মনে করি প্রযুক্তি ব্যবহার একটি অভিশাপ। আসলে ব্যাপারটা সেরকম না। আজকের যুগে প্রযুক্তি এবং সামাজিক মাধ্যম মূল্যবোধ গড়ে তুলতে এবং তা ভঙ্গ করতে উভয় ক্ষেত্রেই ভূমিকা পালন করে। সেক্ষেত্রে সন্তানকে সঠিক নির্দেশনা দিতে হবে যাতে সন্তানেরা ভুল পথে পরিচালিত না হতে পারে। তাই বাবামায়ের উচিত সন্তানের প্রযুক্তির ব্যবহার মনিটর করা এবং তাদেরকে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখানো। শিশুদের জন্য নিরাপদ এবং শিক্ষামূলক কনটেন্টের ব্যবস্থা করা উচিত, যাতে তারা সেখান থেকে সঠিক মূল্যবোধ অর্জন করতে পারে।

মূল্যবোধ তৈরিতে বাবামায়ের ভূমিকা : সন্তানের মূল্যবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাবামা হলেন প্রধান শিক্ষক। সন্তানেরা সাধারণত বাবামায়ের আচরণ, কথা এবং কাজকর্ম থেকে মূল্যবোধ শিখে। এজন্য বাবামায়ের উচিত সন্তানের সামনে সবসময় সঠিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। সন্তানদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য বাবামায়ের নিজস্ব আচরণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানরা তাদের বাবামায়ের কাজকর্ম এবং আচরণ থেকে মূল্যবোধ শেখে। যদি বাবামা সত্যবাদী, দায়িত্বশীল, এবং সহানুভূতিশীল হন, তবে সন্তানেরাও সেই গুণাবলিগুলো গ্রহণ করবে।

সন্তানদের শৈশব থেকে শৃঙ্খলা শেখাতে হবে। শৃঙ্খলা একজন ব্যক্তির জীবনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। সন্তানদের শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন যাপন শেখানো, সময়মতো কাজ সম্পন্ন করা এবং নিয়ম অনুযায়ী চলার অভ্যাস তৈরি করা তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ এবং পরিশ্রমের মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

বাবামায়ের ইতিবাচক মনোভাব সন্তানের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। সন্তানের প্রতি সর্বদা ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখা, তাদের সফলতার প্রশংসা করা এবং ভুল করলে সংশোধন করার সুযোগ দেওয়া উচিত। এতে সন্তানদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং তারা ভবিষ্যতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়।

সন্তানদের সাথে নিয়মিত কথোপকথন করা এবং তাদের চিন্তাভাবনা শেয়ার করার সুযোগ দেওয়া জরুরি। এতে তারা নিজেদের মধ্যে যে কোনো ধরনের দ্বিধা, সংশয় বা উদ্বেগ নিয়ে কথা বলতে পারে। বাবামা যদি তাদের সাথে খোলামেলা কথা বলেন এবং পরামর্শ দেন, তাহলে সন্তানরা সঠিক পথ অনুসরণ করতে পারে।

তবে এই যুগে মূল্যবোধ তৈরির চ্যালেঞ্জ রয়েছে।এর অন্যতম কারণ হল পিতামাতার সাথে সন্তানের বয়সের পার্থক্য। মূল্যবোধ তৈরি করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, বিশেষত বর্তমান যুগে, যেখানে সন্তানদের উপর বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রযুক্তিগত প্রভাব রয়েছে। বাবামা এবং শিক্ষকদের এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। লেখক : শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅভিধান
পরবর্তী নিবন্ধঅমেয় মানুষ ধারভার লেখক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান