সন্তানদের অন্যদের সাথে তুলনা করা মানে তাদের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসম্মান হ্রাস করে। উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ায় এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রত্যেকের বিকাশের নিজস্ব গতি ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। তাই তাদের তুলনা না করে নিজের সন্তানের অতীত পারফরম্যান্সের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে তাকে নিজের উন্নতির দিকে উৎসাহিত করা উচিত। নিজের সন্তানকে নিয়ে কখনও অন্যের কাছে অভিযোগ বা সমালোচনা করবেন না। এমনকি আপনার আপন ভাই–বোন, বাবা–মা, বা ঘনিষ্ঠ কারও সাথেও না। একজন সন্তানের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত তখনই আসে, যখন সে জানতে পারে–তার বাবা–মা অন্যের কাছে তার সমালোচনা করে, নেগেটিভ কথা বলে,তাকে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে।
প্রায় মা–বাবারা বলে থাকেন, তোমার বন্ধু তো পারে, তুমি পার না কেন? ওর মতো হতে পার না?’ কিংবা পাশের বাসার ছেলেটা অঙ্কে ১০০ পেল। অথচ তোমার নম্বরের কথা কাউকে লজ্জায় বলাই যায় না। শিশুরা বাবা–মার কথার প্রতি আস্থা রাখে, তাদের কথা বিশ্বাস করে। বাবা–মা যখন বলেন, ওই শিশুটি তোমার চেয়ে ভালো কিংবা তুমি ওই শিশুর মতো ভালো কখনো হতে পারবে না, তখন সে সেটিকেই সত্যি বলে ধরে নেয়। মায়েরা নিজেদের ভবিষ্যৎ খুঁজে পান তাদের সন্তানের মধ্যে। অনেক সময় তারা নিজেদের জীবনের অপূর্ণ স্বপ্ন নিজেদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করেন। আর এরকম সময়ই সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাবা–মা জীবনে যেটা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি, সেই না পাওয়া সাধ তারা সন্তানের মধ্যে দিয়ে পূরণ করার জন্য অনেক সময় উঠেপড়ে লাগেন। কিন্তু সন্তানের হয়তো সেই বিষয়ে মোটেও মন নেই, তার পছন্দ অন্য কিছু। এই পরিস্থিতি দেখা দিলে ছেলে–মেয়েদের ওপর বাবা–মায়েরা অনেক সময় মানসিক চাপ সৃষ্টি করেন, যা তাদের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। মনে রাখবেন, সন্তান আর বাবা–মায়ের সম্পর্কটা কখনও স্বার্থের নয়। প্রত্যেকটা সন্তানই আলাদা, ভিন্ন চিন্তা–ভাবনার, ভিন্ন স্বপ্নের মানুষ। আপনার চিন্তার সাথে মিল না হলেই কি তাকে খারাপ বলা যায়? একটা সুস্থ মন–মানসিকতার সন্তান কখনও চায় না তার বাবা–মা অন্যের সামনে ছোট হোক, তেমনি একজন সুস্থ মানসিকতার বাবা–মা কখনও তাদের সন্তানকে অন্যের সামনে হেয় করেন না। তাকে শুধরে দেওয়ার অনেক পথ আছে, তবে সেই পথ যেন ভালোবাসা আর সম্মানের হয়।
আমাদের পুরো পৃথিবীজুড়ে থাকে আমাদের সন্তানেরা। প্রত্যেক মা–বাবাই চায় তাদের সন্তান ভাল করুক, সেরা হোক। বাচ্চার ভাল চাইতে গিয়ে ওদের ওপর রাগ করে এর ওর সাথে বাচ্চাকে তুলনা করে বরং আমরা বাচ্চার মারাত্মক ক্ষতি করছি। আমাদের চাওয়ার পারদে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। সন্তানের সামর্থ্য, আগ্রহ, শেখার ক্ষমতা সবকিছু মাথায় রেখে তাদের সময় দিতে হবে ভাল করার। বাচ্চাদের সাথে চিৎকার চেঁচামেচি, অকারণে বেশি বকাঝকা, অপমানজনক কথা বলা এসব কেবলই নেগেটিভ ফলাফল আনে তাই নয় বরং বাচ্চারা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ওদের আত্মবিশ্বাস উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়, অস্থিরতা দেখা দেয় ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। বাচ্চারা তো বাচ্চাদের মতই করবে। আমাদের উচিত বুঝে শুনে পদক্ষেপ নেওয়া, রাগ নিয়ন্ত্রণ করা এবং কারও সাথে নিজের সন্তানকে তুলনা না করা। কী করা যেতে পারে, সারাদিন ওদের নিয়ে চিন্তা করতে করতে মাথা খারাপ দশা হয়। এবার একটু নিজেকে কিছু সময় দিন। সন্তানের সাথে আলোচনা করুন, আপনি কী চান, তার কী কী ভাল গুণ আছে, কী করা উচিত এসব নিয়ে। বাচ্চারা একটু বেশিই প্রশংসা পছন্দ করে। তাই প্রশংসা করুন। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, চরম অবাধ্য সন্তানকেও প্রশংসার অস্ত্রে অনুগত করা যায় সহজেই। ু তুলনা করা বন্ধ করে দিন। সফলদের গল্প শোনান, মহানবী (সা🙂 ছোটদের সাথে কথা বলার কথোপকথগুলো বলুন। কবি, শিশুসাহিত্যিকদের বইগুলো তাদের পড়ার জন্য দিতে পারেন। এতে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।
বাবা মায়েরা একটা কথা শুনে রাখুন, আপনি জীবনে যা করতে চেয়েছিলেন, বা আপনার সন্তান যেটা করলে আপনার বেশ পছন্দসই হয়, সেটা যে ও চাইবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রতিটি মানুষ আলাদা, তার চাওয়া পাওয়াও আলাদা। আপনার সন্তান আপনার অংশ বলে তার চাওয়া পাওয়ার ওপরে নিজের জোর চাপিয়ে দেবেন না। আগে দেখুন সে কী চায়, কোন কাজটা করতে আপনার সন্তান সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। চেষ্টা করা সত্ত্বেও অন্য শিশুর চেয়ে সে পিছিয়ে আছে এবং তার ওই শিশুটির মতো মেধা নেই বলে বিশ্বাস করতে শুরু করতে পারে সে। তার মধ্যে হতাশা তৈরি হতে পারে। সে ধরে নিতে পারে, সে যথেষ্ট উন্নতি করতে পারছে না এবং বাবা–মার প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম নয়। ফলে ধীরে ধীরে তার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যেতে পারে। তার ভেতর তৈরি হতে পারে হীনমন্যতা।
যখন মা–বাবারা অন্য শিশুর সঙ্গে তুলনা করে তাদের সন্তানদের তখন শিশুরা অপমানিত বোধ করে। চেষ্টা করেও বাবা–মার প্রশংসা পাচ্ছে না বলে তার মনে তাদের প্রতি তৈরি হতে পারে ক্ষোভ। যাদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে, বাবা–মা তাদেরকেই বেশি ভালোবাসেন বলে মনে হতে পারে তার। নিজেকে মনে হতে পারে অবহেলিত। সব মিলিয়ে বাবা–মার প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স জার্নালে একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সেই সমস্ত ছেলে মেয়েরা যারা প্রতিনিয়ত এই ধরনের তুলোনামূলক সমালোচনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা এবং স্নায়ুর সমস্যা দেখা যাচ্ছে। দিন দিন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে।
অনেক সময় বাবা মায়েরা মনে করেন যে, ভালো ছেলে–মেয়েদের সঙ্গে তুলনা করলে তখন তাদের সন্তানের মধ্যেও ভালো কিছু করার তাগিদ তৈরি হবে। অন্যের সঙ্গে তুলনা টানলেই কেউ কিছু শিখে যায় না, তাকে ধৈর্য ধরে যত্ন নিয়ে শেখাতে হয়। প্রত্যেক বাচ্চা তার নিজস্ব দক্ষতা, আগ্রহ ও আশপাশের পরিবেশমণ্ডলির প্রভাবে নতুন জিনিস শেখে। যদি দুটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা এবং বড় হওয়ার পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য থাকে, তাহলে তাদের জ্ঞানও আলাদা হবে। তাই এই কারণে বৃথা অন্যের সঙ্গে তুলনা টানে তাতে আপনার সন্তানের মন্দ বৈ ভালো হবে না।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যলেখক
 
        
