সত্যতা পেলে কঠোর ব্যবস্থা

কাপাসগোলা স্কুলে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে মেয়র বিষয়টি না জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ, স্কুলে দলাদলি না করতে শিক্ষকদের হুঁশিয়ারি

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৫ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

তদন্ত কমিটি সত্যতা পেলে ‘যৌন হয়রানি’র অভিযোগ উঠা কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। বলেন, আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। তদন্ত রিপোর্টের আলোকে আইন এবং চাকরির বিধি অনুযায়ী কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠার তিনদিন পর গতকাল বুধবার কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন মেয়র। এসময় অতীতে অভিযোগ উঠার পরও আলাউদ্দিনকে পুনর্বহালের জন্য সাবেক মেয়রদের উপর দোষ চাপান রেজাউল করিম চৌধুরী। এছাড়া ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করছেন জেনেও তা মেয়রকে অবহিত না করায় স্কুলটি অন্যান্য শিক্ষকদের সমালোচনা করে তা ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’র পরিচয় বলে মন্তব্য করেন। পাশাপাশি স্কুলে দলাদলি না করতেও শিক্ষকদের হুঁশিয়ার করেন।

প্রসঙ্গত, ‘যৌন হয়রানি’র অভিযোগ এনে মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে গত ১ জানুয়ারি প্রায় ৩ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এসময় বিক্ষোভকারীদের ওই শিক্ষকের দিকে পানির বোতল, বই-খাতাসহ শিক্ষা উপকরণ ছুঁড়ে মারতে দেখা গেছে। প্রধান শিক্ষকের অপসারণ দাবি করে স্লোগান দেয় বিক্ষোভকারীরা। একইদিন মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। পরদিন ২ জানুয়ারি ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং উত্থাপিত ‘যৌন হয়রানি’র অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে চসিক। সাময়িক বরখাস্তের অফিস আদেশে যৌন হয়রানির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। এদিকে গতকাল সকালে স্কুল পরিদর্শনে যান মেয়র। মেয়রের আসার খবর পেয়ে স্কুলের নিচে জড়ো হন বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা। তারা অভিযুক্ত শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। মেয়র শিক্ষার্থীদের কথা শুনেন এবং পরে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

মতবিনিময় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মেয়র বলেন, একজন শিক্ষকও ছিলেন না যিনি আমাকে বা প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তাকে বলতে পারতেন, এই শিক্ষক ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করছেন। শিক্ষকতা করছেন, কিন্তু আপনিও তো একজন অভিভাবক। আপনার বিবেক নাড়া দেয়নি? বিবেক নাড়া দেয়া উচিত ছিল, আপনারা সেখানে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। আপনারা বললে সেটা আমি তদন্ত করে দেখতাম, গোপনে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করতাম এবং সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।

মেয়র বলেন, আপনারা (স্কুলের শিক্ষকগণ) চুপ ছিলেন এবং আমাদের সন্তানেরা সেটার প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ করেছে বলে শোধরাবার সুযোগ হয়েছে। সাবেক মেয়রদের প্রতি ইঙ্গিত করে রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষককে ইতোমধ্যে বরখাস্ত করা হয়েছে। ওই শিক্ষকের নিয়োগ বা পুনঃনিয়োগ কিন্তু আমার আমলে হয়নি। পূর্ববর্তী মেয়র যারা ছিলেন, শিক্ষা কর্মকর্তা যারা ছিলেন তারাই নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগ দেয়ার সময় এই ব্যক্তির নাকি… এখন যা শুনছি আর কি! আসলে ওই ব্যক্তিকে নিয়োগ এখানে দেওয়া ঠিক হয়নি। যার আমলেই দিক না কেন, হয়তো বা চিন্তা করেছে সংশোধন হবে। তবে আমার আমলে কোনো ক্ষমা নেই। আমি কাউকে করুণা করি না। অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছিলেন আলাউদ্দিন। চাকরি ফিরে পেয়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে কাপাসগোলা স্কুলে যোগ দেন তিনি। এদিকে শিক্ষকদের উদ্দেশে মেয়র বলেন, আপনারা সবাই সম্মানিত, উচ্চ শিক্ষিত এবং অত্যন্ত সচেতন ব্যক্তি। শিক্ষক এবং মসজিদের ইমামকে এখনো সাধারণ মানুষ সম্মানের চোখে দেখে। স্কুলের একজন শিক্ষক কোনো কথা বললে সাধারণ মানুষ সেটা সুন্দরভাবে গ্রহণ করে এবং বিশ্বাস করে। তাই আপনারা আপনাদের সম্মান বজায় রাখবেন। সম্মান ক্ষুণ্ন হয় মত কোনো কাজ করবেন না। করলে নিজে অসম্মানিত হবেন এবং পরিবারেও মুখ দেখাতে পারবেন না।

এসময় তিনি শিক্ষকদের সতর্ক করে বলেন, কোনো শিক্ষক স্কুলে দলাদলি করবেন না। স্কুলে যদি কেউ দলাদলি করেন তাহলে তাকে বদলি করব না, সরাসরি চাকরি থেকে বরখাস্ত করব। এখানে রাজনীতি নাই, রাজনীতি করলে সেটা বাইরে করেন। স্কুলে আসবেন আমাদের সন্তানদের পড়ালেখা করানোর জন্য, সুন্দরভাবে আমাদের সন্তানরা যেন গড়ে উঠতে পারে। দলাদলির জন্য অনেক সময় স্কুলের পরিবেশ নষ্ট হয়, এতে শিক্ষার্থীরা সংক্রমিত হন। এমন ঘটনা যাতে না ঘটে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যদি কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে সামান্যতম অভিযোগ আমার কানে আসে আমি কঠোর ব্যবস্থা নেব। একটু ছাড় দিতে রাজি না আমি।

স্কুলের শিক্ষকদের উদ্দেশে মেয়র বলেন, একজন শিক্ষক অশোভন আচরণ করছে, সেটা অবশ্য অন্যান্য শিক্ষকদের চোখে পড়েছে। আমাদের সন্তানেরা হয়তো ভয়ে বা অন্য কোনো কারণে বলেনি। কিন্তু শিক্ষক যারা আছেন তারা আমাকে বা প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তাকে বলতে পারত। তারা তো শুধু শিক্ষক নন, তাদেরও সন্তান আছে এবং উনার অভিভাবকও। তারা অবশ্য দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তিনি বলেন, মা-বাবার পরে শিক্ষকের স্থান। আমাদের কোমলমতি সন্তানেরা এখানে পড়ালেখা করতে আসে। কিছু ব্যক্তির জন্য আমাদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। লজ্জা লাগে একজন শিক্ষকের নীতি-নৈতিকতা যখন হারিয়ে যায়, পশুত্ব যখন তার মধ্যে বিরাজ করে তখন সে আর মানুষ থাকে না।

মেয়র বলেন, পাকিস্তান আমল থেকে এ বিদ্যালয়ের সুনাম আছে। যে ঘটনা হয়েছে, তার জন্য সন্তানেরা প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদের সাথে সাথেই আমার কাছে যখন খবর এসেছে, আমি কাউন্সিলর, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তাকে বললাম ওই শিক্ষককে প্রত্যাহার করে নিন। ঘটনা বিস্তারিত জানার পর আমি উনাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে বললাম। তিনি বলেন, আমি কাউকে ছাড় দিই না। এটা আমার মুখের কথা নয়, আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন, কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তিকেও আমি ছাড় দিই না, কথাও শুনি না। আমি যেটা ভালো মনে করি, সেটাই করি। এ শিক্ষকের বিরুদ্ধে যদি আগে কেউ অভিযোগ দিত তাহলে এ ঘটনাটা ঘটার সুযোগ হতো না। আমি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। কমিটি তাদের তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট দেবে। স্ট্যান্ডিং কমিটি আছে, আমরা সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেব কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আমাদের সন্তানেরা উৎসাহ নিয়ে স্কুলে আসবে আর শিক্ষকেরা তাদের সাথে অশোভন আচরণ করবে সেটা আমি মেনে নেব না। আর কোনো ছাত্রী যদি শিক্ষক দ্বারা অশোভন আচরণের শিকার হয়, স্পষ্টভাবে বলতে চাই তাদের সিটি কর্পোরেশনের কোনো স্কুলে আমি আর নেব না।

তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন ৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। চারশ’র ওপর ফোরকানিয়া মাদরাসা পরিচালনা করে। আমাদের স্কুলের যেসব শিক্ষকেরা আছেন, কারও বিরুদ্ধে যদি এরকম কোনো অভিযোগ বা ত্রুটিবিচ্যুতি পাই অথবা লোকমুখে যদি এরকম কিছু শুনতে পাই তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। সে যে-ই হোক। শিক্ষকদের শুধু নয়, নৈতিকতার প্রশ্নে কর্মচারীদেরও ছাড় দেওয়া হবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমিডিয়া খবর না দিলে বিদেশিরা ঘরে বসে খালি হুক্কা খাবে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধদোহাজারী রেল লাইন সংস্কার কাজ ৪ মাস ধরে থমকে আছে