সততা মেধার মূল্যায়নে বৈষম্যের অবসান

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার সার্থক গণঅভ্যুত্থানের পবিত্র ফসল অন্তর্বর্তী সরকার। বিগত সরকার পতনের স্বল্প সময়ের মধ্যেই গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অভিষিক্ত হন শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর নেতৃত্বে চলমান রয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারের নানামুখী কার্যক্রম। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই যথার্থ বৈষম্যবিহীন জনকল্যাণ নিশ্চিত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। দীর্ঘকাল সময় অনাচারকদাচার দুর্বৃত্তায়নের অভিশপ্ত করায়ত্তে ছিল পুরো দেশ। সরকারি বিভিন্ন সেবা সংস্থাসহ সর্বত্রই অশুভ শক্তির অসহনীয় অপতৎপরতা জনগণের জীবনকে অতিশয় অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ঘুষদুর্নীতিহয়রানির কদর্য পরিক্রমায় মানুষের সাবলীল জীবনযাপন হয়েছিল ওষ্ঠাগত। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেই ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা সর্ষের মধ্যে ভয়ানক ভূত হিসেবে দুর্বৃত্তরা ছিল অতি সক্রিয়। লোভলালসা, স্বজনপরিবারঅঞ্চলবন্ধুপ্রীতির আড়ালে উচ্চ থেকে নিম্ন পর্যন্ত শিক্ষাবাণিজ্যভূমিহাসপাতালব্যাংকবীমাসহ প্রত্যেক কিছুই ছিল তাদের দখলে। সমুদয় সামাজিকরাজনৈতিক পরিমন্ডলে ধনসম্পদপ্রতিপত্তিকে অতিশয় শক্তিমান করার ব্যক্তি বিশেষের সীমাহীন কুপ্রবৃত্তি নাগরিক সমাজ অত্যন্ত ঘৃণার সাথে অবলোকন করেছে। পর্যাপ্ত আইনি প্রক্রিয়ায় এবং গভীর দক্ষ পর্যবেক্ষণে এদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা সমগ্র দেশকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল।

জনগণের কল্যাণ সাধনে কথিত বাচনিক বুলিতেসম্পূর্ণ অনৈতিক আচ্ছাদনে অনুকম্পা ও আশীর্বাদপ্রাপ্ত এসব নষ্ট চরিত্রের মানুষগুলো জনগণের বিরুদ্ধেই অতি সঙ্গোপনে অনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। নানামুখী অপপ্রচার ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে জনগণের বন্ধু সেজে মুখোশধারী এসব ব্যক্তিরা সমাজে কমবেশি চিহ্নিত ছিল। রাজনীতির আবরণে অর্থক্ষমতালিপ্সু কথিত রাজনীতিবিদদের নরপশুতুল্য বিবেকবর্জিত অবৈধ প্রভাব বিস্তার ছিল অসহনীয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহরনগরের প্রতিটি অলিগলিতে অতিমাত্রায় উৎসাহিত জঘন্য বাহিনীর তান্ডবদুর্ধর্ষ কর্মকাণ্ডে জনজীবন ছিল প্রাণস্পন্দনহীন। আত্মসংযমআত্মসমালোচনাআত্মশুদ্ধির সকল শুভ উদ্যোগকে প্রচন্ড ভ্রুক্ষেপে দেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ছিল গভীর অনুভূত। ভূমিব্যবসা বাণিজ্যের জবরদখল, চাঁদাটেন্ডারবাজি, ঠিকাদারিহাটের ইজারাসহ সর্বত্রই নিজেদের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে হত্যাকান্ডসহ দমনপীড়ননির্যাতনের নানামুখী ভয়ংকর অপরাধ সংঘটন ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার।

রাষ্ট্রের সমূহ প্রতিষ্ঠানসংস্থা ছিল আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রশাসনসহ সর্বক্ষেত্রে দলবাজি ও দলাদলির অপসংস্কৃতি প্রচন্ড মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। লবিংতদবিরে অবৈধঅনৈতিক কষাঘাতে পর্যুদস্ত ছিল মেধাযোগ্যতাদক্ষতা ও সততা। মানুষরূপী দানবেরা বিভিন্ন ছলচাতুরীঅভিনয়শৈলীজালিয়াতিপ্রতারণার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেছিল পদপদকপদায়ন। পেশাজীবীদের অনেকে বুদ্ধিজীবী হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের পেশিশক্তিতে পরিণত করেছে। সুবিধাবাদী কর্মকর্তাদের অধিকাংশই দ্রুত পদোন্নতিসহ প্রাইজ পোস্টিং নিতে ছিল মরিয়া। বিশেষ করে ‘পাওয়ার হাউজগুলোয়’ একধরনের অদৃশ্য নিজস্ব বলয় তৈরি করতে অনেকেই সক্ষম হয়েছে। দেশের ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে টেন্ডার বাণিজ্য, ঘুষ ও দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ঋণখেলাপি ও অর্থপাচারের বেপরোয়া ঘটনাসমূহ সমগ্র অর্থব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে প্রকৃত পেশাদার, সৎ, মেধাবী এবং দেশপ্রেমের যোগ্যতার মানদন্ডে সর্বোচ্চ গুণের অধিকারীরা ছিল প্রায় অবহেলিত। পরীক্ষিত সুনাগরিকদের যথাযথ মূল্যায়ন না করে বরং অবমূল্যায়নের পথকে বিস্তৃত করা হয়েছিল। প্রশাসনসহ সমাজের সর্বক্ষেত্রে একধরনের হাইব্রিড চাটুকার ও ক্ষমতাধরদের দ্রুতই জয়জয়কার প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এদের সিংহভাগ ক্ষমতার অপব্যবহারে নিজেরা মোটাতাজা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রমতে, এরা সুকৌশলে দুর্নীতি করেছে এবং দুর্নীতির অর্থ অবৈধ উপায়ে বিদেশে পাচার করেছে।

সত্যবাদীন্যায়পরায়ণতায় ঋদ্ধ ব্যক্তিরা সাময়িক কোথাও যৎসামান্য অবস্থান পেলেও কঠিন চাপের ভারে তা ছিল বিপর্যস্ত। তথাকথিত দল ও দলের অঙ্গসংগঠনের নৈরাজ্যকর কর্মযজ্ঞে দেশজুড়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছিল প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রকৃত অর্থে জ্ঞানীনীতি নৈতিকতায় অনন্য প্রতীক হিসেবে যারা উঁচুমানের ছিল; তাদের মূল্যায়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। সত্যসততার মাপকাঠিতে অবিচল ব্যক্তিদের নানাভাবে ফাসিয়ে দেওয়ার খড়গহস্ত ছিল সবসময় উদ্যত। ক্ষেত্রবিশেষে সমাজস্বীকৃতজননন্দিত ব্যক্তিদের অযথা হয়রানিঅপমানিতলাঞ্ছিত করতে এরা কুণ্ঠাবোধ করেনি। অপমানের তীব্র তাড়নায় এদের অনেকের আর্তনাদ ছিল হতাশাব্যঞ্জক। ব্যতিক্রম চিন্তা চেতনার মানুষের মূল্যায়ন ছিল অত্যধিক কঠিন। বরং অবমূল্যায়নের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানুষগুলো ছিল চরম বিপাকে। কথিত বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক প্রতারণামূলক বানোয়াট অভিযোগের ধোঁয়া তুলে সম্মানিত ব্যক্তিদের সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করার বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন লোকের অভাব ছিল না। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে ব্যর্থ কদর্য চরিত্রের মানুষগুলো নানা উপায়ে অর্থের বিনিময়ে অপ্রত্যাশিত অভিযোগ দাখিল এবং তারই প্রেক্ষিতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ঘটনা তদন্তের অপতৎপরতায় লিপ্ত থেকেছে।

এটি সর্বজনস্বীকৃত; যে কোন জাতিরাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনে সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতে সংগঠিত জনসমষ্টির প্রকৃষ্ট সমর্থনে রাজনৈতিক দলের উন্মেষ ঘটে। গঠনমূলক রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনাবাস্তবায়নে প্রায়োগিক কৌশল নির্ধারণ করে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠন ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জনস্বার্থে প্রতিশ্রুত কর্মযজ্ঞ সম্পাদন সাধারণত রাজনৈতিক দলের মুখ্য উদ্দেশ্য। সমগ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও পবিত্র সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিধিবদ্ধ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় ভোটাধিকার প্রয়োগে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনজনগণের ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রণিধানযোগ্য অনুষঙ্গ। স্বৈরচারী মনোবৃত্তি সংহার করে গণমতামত নির্ভর গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের মধ্যেই স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তার সফলতা নিহিত।

রাজনৈতিক চেতনাশিক্ষাপরিশীলিত আচার আচরণের প্রসার ও শিষ্টাচার বহির্ভূত কার্যকলাপ পরিহারে জনমতের সমৃদ্ধিকরণ গঠনমূলক রাজনীতির ব্যঞ্জনা তৈরি করে। ব্যক্তির মতামত ও সামষ্টিক মূল্যায়নে স্বাধীনচেতাদেশপ্রেমিকসৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নেতৃত্বে অকুতোভয় নির্ভীকতায় দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণই রাজনীতির পবিত্রতম প্রপঞ্চ। দলীয় আনুগত্যের বিপরীতে জাতিরাষ্ট্রের প্রতি আদর্শিক আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণ সুস্থ ও সুষ্ঠু রাজনীতির উৎসস্থল। পরিশীলিত রাজনীতি রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের সঙ্গে জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থানির্ভরশীলতাবিশ্বাসভালোবাসার বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বেশ কিছুকাল রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চার অনুশীলন প্রায় নিম্নতর পর্যায়ে ছিল। রাজনীতিতে নীতিনৈতিকতা ও ঐতিহ্যিক ধারা সংকুচিত হয়ে আদর্শহীন লুম্পেন ভাবাদর্শ শক্তিশালী হয়ে উঠার দৃশ্যাদৃশ্য প্রকট। রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পাওয়ানা পাওয়ার দোলাচলে অর্থপেশীপারিবারিক সম্পর্ক অত্যন্ত জোরালো ভূমিকায় অধিষ্ঠিত ছিল। উল্লেখ্য অপশক্তির অবিরত চর্চা তরুণতরুণীর বৃহৎ অংশকে রাজনীতি বিমুখ করে তুলেছে। ফলশ্রুতিতে রাজনীতিতে দেশপ্রেমিক মনমানসিকতা সম্পন্ন মেধাবী তারুণ্যের বিকাশের সমীকরণে যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি তেমন দৃশ্যমান নয়। রাজনৈতিকঅর্থনৈতিকসামাজিকসাংস্কৃতিকধর্মীয় ক্ষেত্রে সত্যসুন্দরকল্যাণআনন্দের উপাদান সমূহের যথার্থ পরিচর্যার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচ্য হওয়া অবশ্যম্ভাবী।

সভ্যতার বাস্তবতা এই যে; সচেতন আপামর জনগণের আস্থাবিশ্বাসসমর্থন ব্যতীত অশুভ নেতৃত্বের বিকাশ দেশকে অনগ্রসরতার পথেই এগিয়ে নিয়ে যায়। কখনো তা আধুনিকমানবিকপ্রাগ্রসর পথে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পথকে সুগম করে না। এই ধরনের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির বিকাশবিস্তার ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয় এবং জনগণের সম্পদ লুন্ঠনে অসম লুটেরা প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে। এটিও সত্য যে, সরকারের সকল সংস্থা যদি সততাস্বচ্ছতাজবাবদিহিতার মানদন্ডে সুবিচার নিশ্চিতকল্পে কার্যকর ভূমিকা পালন করে; সুশাসন তখন আইনের শাসনের সম্পুরকপরিপূরক ধারায় প্রবহমান থাকে। সুস্থযোগ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশমানতা সাবলীল গতিতে উন্মোচিত হয়।

জনশ্রুতি মতে, সরকারে বর্ণচোরা অশুভ স্বার্থান্বেষী শক্তির সাথে অদৃশ্য যোগসাজশ বা আপসকামিতায় পারদর্শী কথিত রাজনীতিকব্যবসায়ীপেশাজীবী ব্যক্তিদের কুৎসিত মনোবৃত্তিকে পরাস্ত করা দেশের আপামর জনগণের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। অবৈধ পেশী ও অর্থশক্তি বিভ্রষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি কথিত গণতন্ত্রের মোড়কে ভয়ংকর দাপট এবং ক্ষমতার বলয় সৃষ্টিকারীদের রুখে দেওয়ার জন্য দেশবাসীকে একতাবদ্ধ হতে হবে। সকল স্তরের নির্মোহ ও ত্যাগী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অবমূল্যায়নের মোড়কে অপাংক্তেয়বিতর্কিতঅযাচিতদোষী সাব্যস্ত করার সকল পাপিষ্ঠ উদ্দেশ্য সংহার করা জাতীয় আদর্শিক কর্তব্য। ন্যায়পরায়ণতায় ঋদ্ধ অবিচল ব্যক্তিবর্গকে যথাযোগ্য মূল্যায়নে যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা না হলে জাতি শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; ভবিষ্যৎকে আলোকময় করার সকল সৎ উদ্যোগও বিফলে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধডেনমার্কে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ থেকে গ্রেটা থুনবার্গ গ্রেপ্তার