ষাটের দশকে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে সৃষ্টি হয় ৭২৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বিস্তৃত কাপ্তাই হ্রদ। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই কৃত্রিম জলাধার সৃষ্টির ফলে বিস্তীর্ণ সড়ক পথ তলিয়ে যায়। যে কারণে আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় এই জেলার তিনটি উপজেলা পুরোপুরি হ্রদবেষ্টিত হয়ে পড়ে।
বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলা সদরে যাতায়াতে নৌ–পথ ছাড়া বিকল্প নেই। পাহাড়ি কৃষি পণ্য পরিবহন কিংবা বাজারজাতে দুর্ভোগ, স্বাস্থ্যসেবা ও দৈনন্দিন জীবনযাপনে ভোগান্তির কারণে মৌলিক সেবা থেকেও বঞ্চিত এই তিন উপজেলাবাসী। শুষ্ক মৌসুমে ভোগান্তির মাত্রা বেড়ে যায় আরও কয়েকগুণ। হ্রদবেষ্টিত এ তিন উপজেলাকে বাঘাইছড়ি–লংগদু ও কাপ্তাই উপজেলার সঙ্গে সংযোগ করতে একটি উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কারিগর পাড়া বাজার থেকে বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাট পর্যন্ত ২০০ কিলোমিটার গ্রামীণ পাঁকা সড়ক তৈরির প্রস্তাবনা তৈরি করে প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছে এলজিইডি। এই প্রস্তাবনার আওতায় কাপ্তাই থেকে বিলাইছড়ি উপজেলা; বিলাইছড়ি থেকে জুরাছড়ি হয়ে বরকল এবং বরকল থেকে লংগদু উপজেলার তিনটি ইউনিয়নসহ বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাট পর্যন্ত ২০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দুই লেনের সড়ক নির্মিত হবে। পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গভাবে উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
এলজিইডি রাঙামাটি কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রধান সড়ক সংযোগ কার্যক্রমের আওতায় কাপ্তাই হ্রদের পূর্বদিকের হ্রদবেষ্টিত তিন উপজেলাকে সড়ক পথে আনার এই উদ্যোগে কাপ্তাই, লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলাও সম্পৃক্ত রয়েছে। এই প্রস্তাবনার ২০০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ২০২২–২৩ অর্থবছরে কাপ্তাইয়ের কারিগরপাড়া বাজার থেকে ভালুকিয়া হয়ে বিলাইছড়ি উপজেলা পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় এসেছে।
জুরাছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুরেশ কুমার চাকমা বলেন, জুরাছড়ি উপজেলার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দুই উপজেলা বিলাইছড়ি ও বরকলের সঙ্গে পাহাড়ি সড়ক রয়েছে। তবে এই দুইটি সড়কে যানবাহন চলাচলের কোনো উপায় নেই। হেঁটে জুরাছড়ি থেকে বরকল সদরে যেতে ৩–৪ ঘণ্টা সময় লাগে। আর জুরাছড়ি থেকে বিলাইছড়ি সদরে যেতে ৮–৯ ঘণ্টা সময় লাগে। জুরাছড়ি থেকে বিলাইছড়ি পর্যন্ত পাকিস্তান আমলের এই সড়কটির জন্য আমরা বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে লিখলেও কিছুই হয়নি। আমি উপজেলা পরিষদের দায়িত্ব নেওয়ার পর এমপি মহোদয়ের ডিওলেটার নিয়ে একাধিকবার আবেদন জমা দিলেও একটিরও কাজ হয়নি।
এলজিইডি রাঙামাটি কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আহামদ শফি বলেন, ২০০ কিলোমিটার সড়ক ও সেতু নির্মাণের একটি প্রস্তাবনা হেড কোয়ার্টারে প্রেরণ করা হয়েছে। এই সড়কে বিভিন্ন জায়গায় এখন কাঁচা সড়ক রয়েছে। কিছু পাহাড়ি এলাকায় হাঁটার উপযোগী সরুপথও রয়েছে। তবে প্রস্তাবিত প্রকল্প পাস হলে পুরো সড়কটি ২৪ ফুট ও দুই লেনের পাঁকা সড়কে পরিণত হবে।
প্রাক্কলিক ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, আমরা মূলত ১ কিলোমিটারে ৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে থাকি, সে হিসাবে ২০০ কিলোমিটার সড়কে ৬০০ কোটি টাকা এবং সেতু–কালভার্ট মিলিয়ে ৮০০ কোটি টাকার ওপর হতে পারে। তবে প্রস্তাবনাটি অনুমোদন পেলে আমরা বাস্তবিক সমীক্ষা করে ডিপিপিতে চূড়ান্ত প্রাক্কলিক ব্যয় নির্ধারণ করব।
প্রকৌশলী আরও বলেন, বিশেষত কাপ্তাই হ্রদের পূর্বপাড়ের (বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল) তিন উপজেলাসহ পাহাড়ি এলাকার মানুষ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে কৃষি পণ্য বাজারজাত, মালামাল, রোগী ও যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এলজিইডির এই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন হলে হ্রদবেষ্টিত তিন উপজেলা ছাড়াও বাঘাইছড়ি, লংগদু ও কাপ্তাই উপজেলার কিছু অংশের মানুষ দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ পাবেন। এছাড়া খাদ্য সহায়তা, নির্বাচনী সরঞ্জাম প্রেরণ ও নানান আপদকালীন সময়েও দুর্গম এলাকায় পৌঁছানো আরো সহজ হওয়ার পাশাপাশি ওইসব এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিরাপদ হয়ে উঠবে।