একটি–দুটি খুন হলে পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, টকশো, ইউটিউব তপ্ত কয়লার মতোন লাল হয়ে ওঠে। কিন্তু গত ২০২৪ সালে শুধুমাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় ‘খুন’ হয়েছে ৭,২৯৪ জন মানুষ, অথচ তাতে কারো কিছু তেমন এলো–গেল না। দেশব্যাপী ‘বিদায় স্টোর’’–এর ব্যবসা ভালো হলো, বিক্ষিপ্তভাবে একেক টিভি চ্যানেল একেকটি দুর্ঘটনার নিউজ কভার করলো, তারপর শেষ। ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম, ‘‘রাস্তায় নামলে এক্সিডেন্ট তো হবেই, এইটা নিয়ে এতো হইচই করার কি আছে?’’ বছরের পর বছর, গড়ে প্রতিবছর সাত/আট হাজার মানুষের প্রাণ যায় এই সড়ক দুর্ঘটনায়। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো, তাহলে অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনকে একটা ‘নোবেল’ দিতাম। একক প্রচেষ্টায় তিনি ‘‘নিরাপদ সড়ক চাই’’ এই স্লোগানটা আমাদের কানে কানে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে যাচ্ছেন। খেয়াল করে দেখবেন, এই স্লোগানটি কিন্তু আপনিও শুনছেন। তার মানে কি? মানেটা একটু পরই বলছি, তার আগে আরো কিছু পরিসংখ্যান দিই। ২০২৫–এর রোজার ঈদে ৩১৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে তাতে খুন হয়েছে ৩২২ জন। ২০২৫–এর কোরবানির ঈদে তুলনামূলক কম, দশ জেলায় ১৮ জন খুন হয় হয়েছে। আপনারা এতক্ষণে বিরক্ত হয়ে গেছেন যে, এই লোক সড়ক দুর্ঘটনাকে ‘খুন’ ‘খুন’ বলছেন কেন? আমাদের দেশে ঘটে চলা সড়ক দুর্ঘটনাগুলো তো খুনই। কেননা, আমার যেমন ইচ্ছা তেমন গাড়ি চালাবো, আর মরবে মানুষ। কেননা, আমি উল্টা পথে গাড়ি চালাবো, আমার খেয়াল–খুশিমতো লেন চেঞ্জ করবো, ডানে–বামে না দেখে মেইন রোডে উঠে পড়ব, গাড়ি এমন বেপরোয়া গতিতে চালাবো যাতে মনে হবে ইঞ্জিনটা সাইলেন্সার দিয়ে বের হয়ে আসবে, হাইওয়েতে রাস্তার পাশে রাস্তার খানিকটা দখল করে পার্কিং করব, ডানে–বামে অথবা ইউটার্নের জন্য যে এক্সট্রা লেইন থাকে ওটাকে কার্যকরী না রেখে ট্রাক–বাসের জন্য পার্মানেন্ট পার্কিং বানাবো…এবং এরকম আরো অনেক কিছু্ই আমি করে বেড়াবো যা লিখতে গেলে পড়ার ধৈর্য হারিয়ে ফেলতে হবে।
খেয়াল করে দেখবেন ‘‘দুটি সন্তানের বেশি নয় একটি হলে ভালো হয়’’ বা ‘‘আপনার শিশুকে টিকা দিন’’ বা ‘‘শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ান এটি তার জন্মগত অধিকার’’…এই স্লোগানগুলো দারুণ ভাইরাল এবং ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, মানুষ গ্রহণ করেছে। এখন, একজন ইলিয়াস কাঞ্চন যদি ওই একটা স্লোগান পুরো দেশে ছড়িয়ে দিতে পারে তাহলে প্রশাসন কি উপরেল্লিখিত পয়েন্টগুলোতে ‘‘না’’ শব্দটি যোগ করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পাওে না? এই স্লোগানগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হোক রেডিওতে, টিভিতে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, মাইকিং করে দিতে থাকুক টানা কয়েক বছর, দেখা যাবে ঠিকই ফল আসছে।
দেশে এ–বিষয়ক আইন নাই তা–ও কিন্তু নয়! অল্প কথায় বিদ্যমান আইনগুলার একটু উল্লেখ করি এখানে। যেমন: ড্রাইভারকে অবশ্যই অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে। লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ৬ মাসের জেল অথবা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ২ বছর জেল অথবা ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত অথবা প্রাণহানি হলে অনধিক পাঁচ বছরের জেল অথবা ৫ লাখ টাকা জরিমানা। ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ মারলে শাস্তি দন্ডবিধি ৩০২ ধারা। ওভারলোড গাড়ি চালালে ১ বছরের জেল অথবা ১ লাখ টাকা জরিমানা। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য ৩ মাস জেল অথবা ১০ হাজার টাকা জরিমানা। অবৈধ পার্কিং অথবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা হলে ৫০০০ টাকা জরিমানা। ফিটনেস ছাড়া গাড়ি চালালে ৬ মাসের জেল ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। উল্টা পথে চালালে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা।
এই আইনগুলো কঠিন হাতে নির্দ্বিধায় প্রয়োগের শুরু করাটা তাই এখন সময়ের দাবী। আমরা রাস্তায় খুন হব, আমাদের রক্ত রাস্তার পাশে খালে–বিলে গড়িয়ে পড়বে, পাড়ার কুকুর আমাদের রক্ত চেটেচেটে খাবে…একটা সভ্য এবং তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশে এটা হতে পারে না! বর্তমান সরকার, প্রশাসন এবং অনাগত সরকার এবং তাদের প্রশাসনের কাছে একটা চোয়াল শক্ত করা বার্তা আমরা পৌঁছে দিতে চাই, ‘‘আমাদের স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করুন, এটা আমাদের অধিকার।’’