সড়ক আর নিরাপদ হলো কই?

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস আজ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছেই  কেন এত দুর্ঘটনা

মোরশেদ তালুকদার | রবিবার , ২২ অক্টোবর, ২০২৩ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

জনসচেতনতা সৃষ্টি ও সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে দেশে সরকারিভাবে প্রথম ২০১৭ সালে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ পালন করা হয়। ওই বছর (২০১৭২০১৮ অর্থবছর) দেশে ২ হাজার ৪৯৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারায় ২ হাজার ৫১৩ জন। সর্বশেষ ২০২২২০২৩ অর্থবছরে দেশে ৪ হাজার ৫৭৭ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৪ হাজার ৩৭১ জন। এ তথ্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। অর্থাৎ নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে গৃহীত সরকারের নানা উদ্যোগের মধ্যেই দেশে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে আজও সারা দেশে পালিত হবে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস।

জানা গেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করে পুলিশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে। বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করে। এসব প্রতিষ্ঠান সংবাদপত্রে প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার তথ্যের ওপর নির্ভর করে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত বছর সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। সরকারি ও বেসরকারি দুটো প্রতিবেদনে পার্থক্য থাকলেও উভয় প্রতিবেদনে কিন্তু দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি পূর্বের বছরের চেয়ে বৃদ্ধি পায়।

উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সাল থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে আছে নিসচা। এর প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৫ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অনুমোদন করা হয়। একই বছর থেকে সরকারি উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

কেন এত দুর্ঘটনা : ২০১৭২০১৮ অর্থবছরে ৮৪ হাজার ১৯ জন পেশাজীবী গাড়িচালককে প্রশিক্ষণ দেয় বিআরটিএ। গত ২০২২২০২৩ অর্থবছরে এ সংখ্যাা ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৩৩০ জন। একই সময়ে সচেতনতামূলক প্রচারণাও বৃদ্ধি করে সরকারি সংস্থাটি। এরপরও সড়ক দুর্ঘটনা কেন কমছে না, সে প্রশ্ন উঠেছে।

জানা গেছে, অদক্ষ চালক এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত ওভারটেক, ফিটনেসবিহীন যানবাহনই মূলত সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। পাশাপাশি পথচারীদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অসচেতনতার জন্যও ঘটছে দুর্ঘটনা।

সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক নিরাপত্তায় দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। বিআরটিএ ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে রোড সেফটি ইউনিট গঠিত হলেও মিডিয়ায় কথা বলা ছাড়া তাদের কোনো গবেষণা কার্যক্রম নেই। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো গবেষক নেই, গবেষণা নেই, কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। ফলে প্রতি বছর সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছেই।

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী ও যাত্রীর দায় আছে ৯০ শতাংশ। এছাড়া ৩০ শতাংশ পরিবেশগত এবং ১০ শতাংশ যান্ত্রিক কারণ দায়ী আছে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর একটি প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলা হয়, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত গতি, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্য বোঝাই, অবৈধ প্রতিযোগিতা, হেলমেট ও সিটবেল্ট না বাঁধার প্রবণতা, মাদকদ্রব্য সেবন করে গাড়ি চালনা, চালকের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, যানবাহনসমূহের যথাযথ পরীক্ষানিরীক্ষা না করা, হেলপারের সহায়তায় গাড়ি চালনা, যান্ত্রিক ত্রুটি, সড়ক ব্যবহারবিধি না জানা ও সচেতনতার অভাব, ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় চলাচল, রাস্তা নির্মাণে ত্রুটি, অপর্যাপ্ত রাস্তা ও নিরাপত্তার অভাব এবং যথাযথভাবে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ না করা।

গতকাল রাজধানীতে আয়োজিত রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা চরমভাবে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগই ঠিকমতো আলোর মুখ দেখছে না। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগই যথেষ্ট মাত্রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে জনগণ যেমন সচেতন হচ্ছে না, তেমনি সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।

বাড়ছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে প্রাণহানি : রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ২৫ হাজার ৯২৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা যায় ২৯ হাজার ১ জন। আহত হয়েছে ৪২ হাজার ৩৮৮ জন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায় ৯ হাজার ৩০৯ জন। নিহতদের মধ্যে ৭ হাজার ৬৬৫ জন পথচারী এবং ৩ হাজার ৮৯৬ জন হচ্ছে শিক্ষার্থী। সংগঠনটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে ৬ হাজার ৮২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭১৩ জন নিহত ও ১২ হাজার ৬১৫ জন আহত হয়েছে।

প্রতি বছর জানুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। নিসচার সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা দেশে সড়ক, নৌ ও রেলপথে মোট ৭ হাজার ২৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ১০৪ জন মারা যায় এবং ৯ হাজার ৭৮৩ জন আহত হয়। এর আগে ২০২১ সালে ৪ হাজার ৯৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানায় নিসচা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পযন্ত ৪ হাজার ১৬ সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৭২৭ জন নিহত ও ৫৭৮১ জন আহত হয়েছে। এছাড়া গত মাসে দেশে ৪০২ সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৭ জন মারা যায় এবং ৬৫১ জন আহত হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৭১ জন মারা যায় এবং ১৮২ জন আহত হয়। ২০২২ সালে দেশে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত এবং ১২,৩৫৬ জন আহত হয়েছে; যা পূর্বের ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এদিকে গত মাসে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটির (বিআইজিআরএস) একটি জরিপ প্রকাশিত হয়। এতে দেখা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে চট্টগ্রাম মহানগরে দুর্ঘটনায় ২৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশই পথচারী। এছাড়া ছাড়া ৩০ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে মোটরসাইকেল ও থ্রি হুইলার যাত্রীদের।

এর আগে গত জুলাই মাসে সংস্থাটির একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নগরের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ দায়ী তিনটি শ্রেণি, যাদের ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা ব্যবহারকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই তিন শ্রেণি হচ্ছে পথচারী, মোটরসাইকেল চালক এবং সাইকেল চালক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাগরে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, বৃষ্টির আভাস
পরবর্তী নিবন্ধবাহারছড়ায় একমাস ধরে বের হচ্ছে গ্যাস!