এবার ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত ও আহতের সংখ্যাও অনেক। অন্যান্য জায়গায় সংঘটিত দুর্ঘটনার কথা না বললেও চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়ার চুনতি জাঙ্গালিয়ায় পর পর তিন দিনের দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ‘এই মহাসড়কে শতাধিক বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। এগুলো এক একটি যেন মৃত্যুকূপ। দুর্ঘটনা কবলিত স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, দুই পাশে ঘন বনাঞ্চল, লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানি, অপ্রশস্ত সড়ক, ঢালু সড়ক ও দূরপাল্লার গাড়ি চালকদের অভিজ্ঞতার অভাব– এই ছয়টি কারণে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের কাছে এটি দুর্ঘটনার হটস্পট হিসেবে পরিচিত। উল্লিখিত কারণ ও চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধান করা না গেলে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। পুলিশ ও যোগাযোগ বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্যান্য সময়ের চেয়ে ঈদের ছুটিতে দুর্ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ অবৈধ যানবাহন এবং বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। আমাদের দেশে ঈদের আগে সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিয়তি। প্রতি বছর ঈদের ছুটিতে যে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয় তা থেকে এবারও রক্ষা মেলেনি। এবারের ঈদের সবকিছু যখন আনন্দ ও স্বস্তিদায়ক ছিল, তখন ছুটির আনন্দ সড়কে প্রাণহানির কাছে যেন পরাস্ত হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সড়কে মৃত্যু বাংলাদেশের মানুষের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতার অংশ। সড়কে বছরে যে প্রাণহানি হয় যুদ্ধরত অনেক দেশেও এত প্রাণহানি হয় না। বিভিন্ন খাতে আমরা অভূতপূর্ব উন্নয়ন করতে পারলেও স্বাধীনতার পর থেকেই অব্যবস্থাপনা ও সড়কে মৃত্যু যেন আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার নিত্যসঙ্গী। গত কয়েক বছরে সড়কে প্রাণহানির পরিমাণ আরো বেড়েছে। প্রধান উপার্জনকারীর বিদায়ে অনেক পরিবারকে পথে নামতে হচ্ছে। আবার পঙ্গুত্ব বরণ করা ব্যক্তিরাও পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সড়কে প্রাণহানি আমাদের মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপিতেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। দিনের পর দিন সড়কে প্রাণহানির মচ্ছব চলছে অথচ মনে হয় তার দায়িত্ব নেয়ার কেউ নেই।
তাঁরা বলেন, চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া যানবাহন চালানোর পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়ক ও সেতুর নাজুক অবস্থাও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। গণপরিবহনে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে গতিসীমার বাইরে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেয়ার অশুভ প্রতিযোগিতা আর বাড়তি মুনাফার লোভে পরিবহন সংস্থাগুলো চালকদের অনেক বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে চালকের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ে, তাকে বেসামাল হয়ে গাড়ি চালাতে হয়; যা প্রকারান্তরে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লক্কর–ঝক্কর, অচল যানবাহনে রং লাগিয়ে যেনতেন মেরামত করে রাস্তায় চলাচল করে বিভিন্ন উৎসব–পার্বণের সময়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী দূর–দূরান্তে গমনাগমন করে। সড়ক–মহাসড়কে অনেক সময় বাস–ট্রাকের মাদকাসক্ত চালকের গতির লড়াইয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। কেউ–বা আবার গাড়ি চালানোর সময় ব্যবহার করেন সেলফোন, যা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো, বিরামহীন যানবাহন চালানো, মহাসড়কে অটোরিকশা, নসিমন–করিমন ও মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল এবং ব্যস্ত সড়কে ওভারটেকিং, ওভারলোডিং তদারক না করা সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। ত্রুটিপূর্ণ মহাসড়কের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমরাও মনে করি, দুর্ঘটনা কমাতে হলে এর কারণগুলো সামনে রেখে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। মহাসড়কে সব অবৈধ পরিবহন বন্ধ করতে হবে। মানুষের বাড়ি ফেরা নিশ্চিত করতে ভালো পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। সড়ক–মহাসড়ক যানবাহন চলাচল উপযোগী করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ চালক দ্বারা যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। আইনের প্রয়োগ যথাযথ করার পাশাপাশি দুর্ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে সড়কে এমন মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগ কাগজকলমে সীমাবদ্ধ থাকলে দুর্ঘটনা কমবে না। তাই সড়কে মৃত্যুর হার কমাতে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।