সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জাপানের প্রাচীন দর্শন হারা হাচি বু

ফজলুর রহমান | বৃহস্পতিবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

ব্রিটিশ ডায়েটিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র ও রন্ধন বিশেষজ্ঞ ক্লেয়ার থর্নটনউড এর কথাগুলো শুনি। তিনি এই সময়কার খাদ্যাভ্যাসের প্রসঙ্গে বলেছেন, “১৯৭০এর দশকে একটা প্লেট গড়ে ২২ সেন্টিমিটার হতো। এখন তা বেড়ে ২৮ সেন্টিমিটার হয়েছে। তার মানে আমাদের খাবারের পরিমাণও বেড়েছে। আমাদের কতটা খাওয়া উচিত, সেটা নির্ধারণ করার একটা সহজ উপায় রয়েছে। আমরা কিন্তু আমাদের হাতের তালু থেকেই সেই বিষয়ে অনায়াসে জানতে পারি। আপনার হাতের তালুর সমান খাসির মাংস, মুরগি বা মাছ এবং দুই হাত মিলিয়ে যতটা সব্জি রাখা যায়, ততটুকুই আপনার জন্য যথেষ্ট। এ ছাড়া সারাদিনে এক মুঠো কার্বোহাইড্রেট (আলু, ভাত, পাস্তা ইত্যাদি) এবং এক মুঠো ফল খাওয়া যেতে পারে।”

ক্লেয়ার থর্নটনউড আরো বলেছেন, “অনেকেই বুঝতে পারেন না যে সবার একই পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন নেই। যদি কোনো পরিবারে খাবার পরিবেশন করার সময় হয় সব সদস্যদের যে একই পরিমাণ খাবার দিতে হবে, তেমনটা নয়। বরং যার যা প্রয়োজন সেই অনুযায়ী তাদের খাবার পরিবেশন করা উচিত। স্বাস্থ্যের জন্য ভালো খাবার এই বিষয়ের ওপর নির্ভর করে না যে কোনো ব্যক্তি কতটা পরিমাণে আহার করছেন। তিনি কী খাচ্ছেন তার ওপরও নির্ভর করে।আপনি যা খেতে ভালোবাসেন, সেটা ছেড়ে দেওয়ার দরকার নেই। ডায়েটের ৮০ শতাংশ স্বাস্থ্যকর, কম ক্যালোরিযুক্ত পুষ্টিকর খাবার হতে পারে এবং বাকি ২০ শতাংশ আমাদের প্রিয় খাবার বা উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার হতে পারে।

সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা সিএনএন এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমায় ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভ্যাস। ডিমেনশিয়া হলো একধরনের স্নায়ুবিক সমস্যা, যাতে মানুষের স্মৃতিশক্তি, চিন্তাশক্তি ও কাজকর্ম করার ক্ষমতা ক্রমেই কমে আসে। গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করলে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি অন্তত ৩৫ শতাংশ কমে।

বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচারএ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণায় ৫ হাজার ৭০০ জনের বেশি মানুষের জীবনযাপন ৩৪ বছর ধরে অনুসরণ করা হয়েছে। এ থেকে জানা গেছে ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভ্যাসের সুফল।

ভূমধ্যসাগর ঘিরে থাকা এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের বেশ কিছু দেশ মিলে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। এ অঞ্চলের মানুষ মদ্যপান করেন কম। খান অল্প লাল মাংস। খাবারের তালিকায় বেশি থাকে সবজি, ফল, বাদাম, শস্য, মাছ ও অলিভ অয়েল। শরীরের পরিপাকসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো খাবারের বিভিন্ন ভিটামিন, এনজাইম, অ্যামিনো অ্যাসিড, শর্করা ও স্নেহজাতীয় উপাদানের ওপর নির্ভর করে। যাঁদের শরীরে দুটি এপিওই৪ জিন রয়েছে, তাঁদের পরিপাকপ্রক্রিয়া ভিন্ন ধরনের হয়। ভূমধ্যসাগরীয় খাবারের স্বাস্থ্যকর পুষ্টি উপাদানগুলো এমন ব্যক্তিদের শরীরে তা নাটকীয়ভাবে সাড়া দেয়।

আসলে সঠিক খাদ্য উপাদান গ্রহণ না করলে শুধু ডিমেনশিয়া নয়, দেখা দিতে পারে বিভিন্ন সমস্যা। গবেষকরা বলছেন, শিশুদের খাদ্যের সঙ্গে যেমন কিশোরদের খাদ্যের পার্থক্য থাকে, তেমনি কিশোরদের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গেও পার্থক্য রয়েছে বয়স্কদের। বয়স কম থাকলে অনেকেই খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ভাবতে চান না। লাঞ্চ ও ডিনারে অনেকে ফাস্টফুড পছন্দ করে। এগুলো শরীরের ক্ষতি করে। বয়স্কদের খাদ্যাভ্যাসে কিশোরকিশোরীদের তুলনায় কম ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন গ্রহণ করা ভালো। বাইরের খাবার একেবারেই খাওয়া যাবে না এমন নয়, তবে সেটি যেন রুটিন হয়ে না দাঁড়ায়। এ ছাড়া ভালো খাবার মানেই শুধু ঝোল বা সিদ্ধ সবজি নয়। স্বাস্থ্যকর খাবারও সুস্বাদু হতে পারে, যেমন সালাদে অলিভ অয়েল বা পছন্দসই সালাদ ড্রেসিং যোগ করা। খাবারে গোলমরিচ গুঁড়া, লেবুর রস, ধনেপাতা, পার্সলে কুচি বা কারিপাতা যোগ করে স্বাদ বাড়িয়ে নেওয়া যায়। নিয়মিত একটি রুটিন মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ।

ডায়েটিশিয়ানদের মতে, সকালে নিয়মিত খাবার না খেলে সারা দিন শরীর ক্লান্ত লাগে এবং জাংক ফুড খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। রাতে দুধ, কর্নফ্লেক্স, ব্রেড, ফল, বাদাম জাতীয় খাবার রাখা উচিত, যাতে সকালে আপনার বেশি ক্ষুধা পায়।বয়সের সঙ্গে শরীরের চাহিদা এবং প্রয়োজন বুঝে খাওয়ার অভ্যাস বদলাতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, বয়স বাড়ার সঙ্গে শরীরের প্রতি অবহেলা আসে, যা সমস্যার কারণ হয়। শরীরের প্রতি নজর না দিলে শরীরও ভালোভাবে কাজ করবে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে হরমোনাল পরিবর্তন ঘটে। যা শরীর ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। যেমনওজন বাড়া, শরীর ভারী হওয়া, অস্টিওপোরোসিস বা মাসল লস। অতিরিক্ত তেল, ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার না খাওয়া, বাইরের খাবার এবং জাংক ফুড পরিহার করা।

চিকিৎসকরা বলছেন, অনেকে অভ্যাসের বশে খেতে থাকেন; বিশেষ করে টিভি দেখতে দেখতে বা কাজ করতে করতে। তবে ক্ষুধা না লাগলে খাবার খাওয়া এড়ানোই ভালো। অনেক সময় পর্যাপ্ত পানি পানের অভাবকেও ক্ষুধা মনে হয়। তাই খাওয়ার আগে এক গ্লাস পানি পান করে নিন। চিপস বা বিস্কুটের প্যাকেট খুলে একেবারে শেষ না করা পর্যন্ত খাওয়া, খারাপ অভ্যাস; বরং খাবার পরিমাণ পরিমাপ করে একটি ছোট বাটিতে নিয়ে খান। এতে অতিরিক্ত খাওয়া এড়ানো যাবে। দাঁড়িয়ে, হাঁটতে হাঁটতে বা কম্পিউটারে কাজ করতে করতে খেলে মস্তিষ্ক ঠিকভাবে বুঝতে পারে না আপনি কতটা খাচ্ছেন। এতে অতিরিক্ত খাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। ফলে সময় বের করে আরাম করে বসে মনোযোগ দিয়ে খাবার খান। সবার সমস্যাগুলো হয় না, তবু সতর্ক থাকা উচিত। এই সতর্কতার একটি অংশ হলো সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা।

হার্ভার্ড হেল্‌থ পাবলিশিং’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়তে পাঁচটি মূলমন্ত্র পালনের পরামর্শ দেয়। সেগুলো দেখা যাক এবার।

প্রচুর উদ্ভিজ্জ খাবার

শাকসবজি, ফল, মটর, শুঁটি, পূর্ণ শষ্য, বাদাম ও বীজএসব খাবার থেকে মিলবে দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ। পাওয়া যাবে উপকারী আঁশ ও স্বাস্থ্যকর উপাদান ‘ফাইটোক্যামিকেলস’। এই উদ্ভিজ্জ প্রাকৃতিক রাসায়নিক মানব দেহে নানান উপকার সাধন করে। এরমধ্যে রয়েছেঅ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, প্রদাহ রোধ এমনকি ক্যান্সাররোধী কার্যকারিতা। ‘হার্ভার্ড’য়ের পুষ্টিবিদেরা পরামর্শ অনুযায়ীদৈনিক খাবার প্লেটের অর্ধেক অন্তত সবজি ও উদ্ভিজ্জ খাবার রাখতে হবে।

পর্যাপ্ত প্রোটিন

নানা গবেষণায় দেখা গেছেপর্যাপ্ত প্রোটিন দেহের জন্য প্রয়োজন। আর শারীরিক কারণে প্রোটিনের উৎস হিসেবে যারা মাংস খেতে পারেন না, তাদের জন্য রয়েছে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন। যেমনমটর, ডাল, সয়া, বাদাম, বীজ। এছাড়াও রয়েছে নানান ধরনের সামুদ্রিক খাবার, মাছ ও ডিম। পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণের সাথে শারীরিক কার্যক্রম বা ব্যায়াম চালিয়ে গেলে দেহকে সুস্থ সবল রাখতে সাহায্য করে।

প্রক্রিয়াজাত খাবার কমানো

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেল্‌থ’য়ের গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, বেশি মাত্রায় অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার ওজন বাড়ায় এবং কোলেস্টেরল ও রক্তের শর্করার মাত্রা অস্বাস্থ্যকরভাবে বাড়িয়ে দেয়। তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের জন্য ভাজাপোড়া, সসেজএই ধরনের খাবার বাদ দিয়ে পরিপূর্ণ খাবার গ্রহণের অভ্যাস গড়তে হবে। অল্প মাত্রার প্রক্রিয়াজাত খাবার, যেমনসাধারণ টক দই, টিনজাত টুনামাছ এবং বাদাম থেকে তৈরি প্রাকৃতিক মাখন বা পিনাট বাটারএগুলো খাওয়া উপকারী। এছাড়া অপ্রক্রিয়াজাত খাবার হিসেবেপ্রকৃতি থেকে পাওয়া খাবার বেছে নিতে হবে। যেমনকপি, ব্রকলি, আপেল বা বাদাম। খাবার প্রক্রিয়াজাত করার সময় পুষ্টিগুণ হারিয়ে যায়। আর অতিরিক্ত চর্বি, লবণ, চিনি যোগ করার ফলে সেই খাবার হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর।

স্যাচুরেইটেড ফ্যাট, চিনি ও লবণ খাওয়া কমানো

দি ইউ.এস. গভর্নমেন্ট’স ডায়েটারি গাইডলাইন’ দৈনিক ক্যালরির ১০ শতাংশের চেয়েও কম স্যাচুরেইটেড ফ্যাট বা চর্বি গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়। একইভাবে আলাদাভাবে চিনি দেওয়া খাবার (প্রক্রিয়াজাত করার সময় যোগ করা চিনি) খাওয়ার ক্ষেত্রেও সাবধান হতে হবে।

সমন্বয় ও ভিন্নতা

পুষ্টির চাহিদা মেটাতে ওপরে উল্লেখিত সব ধরনের পুষ্টিকর খাবারের সমন্বয় করে বিভিন্ন ‘খাদ্য শ্রেণী’র খাবার গ্রহণ করতে হবে। পুষ্টি উপাদানযুক্ত খাবার বেছে নিতে পারলে দেহের পুষ্টি চাহিদা যেমন পূরণ হয় তেমনি অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করাও কমে।

দৈনিক খাদ্যাভ্যাসে যেমন রাখতে হবে পুষ্টিকর খাবার তেমনি অতিরিক্ত খাওয়াও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এমন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস তৈরির উপায় কী হতে পারে?

প্রতিদিনের ছোট ছোট ভুল অভ্যাস আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্যহানির কারণ হতে পারে। আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না, নিয়মিত খাওয়ার সময়ে কত রকম অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে উঠেছে। সেই সাধারণ ভুলগুলো জানা থাকলে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করুন। আর জানা না থাকলে জেনে নিয়ে তারপর বাদ দিন। খাওয়ার অভ্যাস শুধু শরীর নয়, মন ও সম্পর্কের ওপরও প্রভাব ফেলে। ছোট ছোট পরিবর্তন, যেমন ধীরে খাওয়া, ক্ষুধা বুঝে খাওয়া, চিবিয়ে খাওয়া বা স্বাস্থ্যকর খাবার নির্বাচন ইত্যাদি দীর্ঘ মেয়াদে আপনার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। মনে রাখুন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মানেই সুস্থ জীবনযাপন। বিশেষজ্ঞদের মতে, খাবার গ্রহণের পর ‘পেট ভর্তি’ সিগন্যাল মস্তিষ্কে পৌঁছাতে প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে। তাই ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাওয়া শুধু হজমের জন্যই ভালো নয়, ওজন নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক। খেতে না পারলেও প্লেটের সব খাবার খেতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। পেট যদি ভর্তি মনে হয়, তাহলে খাবার রেখে দিন। জাপানের একটি প্রাচীন দর্শন হারা হাচি বু। এতে মানুষকে পেটের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত খেয়ে থেমে যেতে বলা হয়। তাতে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে এবং দেহ ও মনদুটোই হালকা থাকে।

লেখক: উপপরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)

পূর্ববর্তী নিবন্ধএনেসথেটিস্টের ভূমিকা ও সমকালীন ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধশিশুর টাইফয়েড রোগের প্রতিষেধক টিকা