১৭ মে শুক্রবার, বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। বাংলাদেশে শহর অঞ্চলে শতকরা ৩৫ জন এবং গ্রামাঞ্চলে শতকরা ২৫ জন প্রাপ্ত বয়স্ক উচ্চ রক্তচাপগ্রস্ত। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তকরণ ও তার নিয়ন্ত্রণ আশানুরূপ নয়। সঠিক পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে উচ্চ রক্তচাপ জনিত ভোগান্তি ও মৃত্যুহার আশঙ্কাজনক। তাই এ বছরের উচ্চ রক্তচাপ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন’ তা নিয়ন্ত্রণে রাখুন। দীর্ঘায়ু হোন।
রক্তচাপ কী?
হৃদপিণ্ড সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে সারা দেহে রক্তপ্রবাহ বজায় রাখে। সংকোচনের সময় বাম নিলয় মহাধমনী দিয়ে শাখা প্রশাখা ধমনীর মাধ্যমে রক্ত শরীরের বিভিন্ন অংশে সঞ্চালিত করে। এই প্রবাহমান রক্ত ধমনীর প্রাচীরের উপর যে পার্শ্বচাপ সৃষ্টি করে তা‘ই রক্তচাপ। রক্তচাপ সব সময় ‘মি.মি. পারদ‘-এই এককে প্রকাশ করা হয়। কারণ পারদের চাপমান যন্ত্র আদিকাল থেকে চাপ পরিমাপের সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। যদি বলা হয় ‘রক্তচাপ ১২০ মি.মি. পারদ‘ এতে বোঝা যাবে রক্তনালীতে সৃষ্ট এই চাপ একটি পারদের কলামকে মহাকর্ষের বিপরীতে ১২০ মি.মি. উচ্চতায় তুলতে সক্ষম। বর্তমান প্রচলিত রক্তচাপ মান যন্ত্রের মধ্যে পারদের চাপমান যন্ত্র এবং এনেরয়েড চাপমান যন্ত্রই বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয়। সব পদ্ধতির সাধারণ নিয়ম হচ্ছে সুবিধাজনক একটি রক্তনালীতে বাহ্যিক চাপ প্রয়োগে রক্তপ্রবাহ সাময়িক বন্ধ করা। রক্তপ্রবাহ পুনরায় চালু হবার সময়ের চাপই হৃৎপিণ্ডের সংকোচন চাপ বা সিস্টোলিক রক্তচাপ। আর হৃৎপিণ্ড প্রসারণের সময় রক্তনালীতে যে সর্বনিম্ন চাপ থাকে তা‘ই প্রসারণ চাপ বা ডায়াস্টোলিক চাপ। বাহুর ব্রাকিয়াল ধমনী এ জন্য ব্যবহৃত হয়।
রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্র:
পারদ, এনেরয়েড ও অটোমেটিক ডিজিটাল এই তিনটা যন্ত্রের মাধ্যমে রক্তচাপ মাপা হয়। এ গুলোর মধ্যে সর্বজনস্বীকৃর্ত ও নির্ভরযোগ্য হচ্ছে পারদের চাপমান যন্ত্র। একই কারণে রক্তচাপকে সবসময় ‘মি.মি. পারদ‘ এই এককে প্রকাশ করা হয়। এই পদ্ধতিতে যান্ত্রিক জটিলতা নেই। দীর্ঘদিন ব্যবহারেও তার কার্যকারিতা ও নির্ভুলতা অটুট থাকে। এনেরয়েড যন্ত্র বহুল ব্যবহৃত। তবে দীর্ঘদিন ব্যবহারে এ যন্ত্রের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে পড়তে পারে। তখন রক্তচাপ সত্যিকার চাপের চেয়ে কম পাওয়া যাবে। তাই পারদের যন্ত্রের তুলনায় এই যন্ত্রের নির্ভরযোগ্যতা কম। সচরাচর ব্যবহৃত বাহুবন্ধনীস্থ ব্লাডারের পরিমাপ ২৩ক্ম১২ সে.মি.। এই ব্লাডার বাহুর পরিধির ৮০% হতে হবে। তার চেয়ে কম হলে রক্তচাপ প্রকৃত চাপের চেয়ে বেশি বা কম নির্ণীত হতে পারে। অপরদিকে ব্লাডার বড় সাইজের হলে রক্তচাপ কম পাওয়া যাবে। অর্থাৎ ছোট কাফে রক্তচাপ বেশি এবং বড় কাফে তা কম পাওয়া যাবে। শিশুদের জন্য ছোট সাইজের এবং মেদবহুল ব্যক্তির জন্য বড় সাইজের কাফ ব্যবহার আবশ্যক। একটা বাবার নির্মিত বাল্ব (যা চাপ প্রয়োগে সংকুচিত হয়) টিউবের মাধ্যমে ব্লাডারের সাথে যুক্ত করা হয়। বাল্বের মাধ্যমে রাডারকে স্ফীত করা হয়। আবার তা চাপমুক্ত করা হয়। রাডার রাবার টিউবের মাধ্যমে একদিকে বাল্ব এবং অন্যদিকে চাপমান যন্ত্রের স্কেলের সাথে সংযোগ রক্ষা করে। বাল্ব এবং কাফের মধ্যবর্তী টিউবের দৈর্ঘ্য ৩০ সে.মি. এবং কাফ ও চাপমান যন্ত্রের স্কেলের মধ্যবর্তী টিউবের দৈর্ঘ্য ন্যূনতম ৭০ সে.মি.। রাবার টিউব ও তার সংযোগস্থান হবে নিশ্চিদ্র। বাল্ব ত্রুটিপূর্ণ হলে বাতাস বেরিয়ে আসে এবং ধীরলয়ে চাপ নিষ্ক্রমণ কঠিন হয়। এতে সিস্টোলিক চাপ কম এবং ডায়াস্টোলিক চাপ বেশি অনুমিত হতে পারে। কাফ্ বাহুতে জড়ানোর সময় ব্লাডারের উপরে হওয়া আবশ্যক। তা কুনুই এর ২–৩ সে.মি. উপরে থাকবে। উভয় যন্ত্রের ক্ষেত্রে স্টেথোসকোপ কনুইয়ের উপরের দিকে রেখে শব্দ শুনতে হবে।
হাতের অনুভব প্রক্রিয়ায়: প্রথমে ব্রাকিয়াল ধমনী আঙ্গুল দিয়ে অনুভব করুন। বাহুবন্ধনীতে চাপ তাড়াতাড়ি তুলে তা নাড়ী বিলুপ্তির ৩০ মি:মি: উপরে নিয়ে যান। তারপর ধীরে ধীরে বাহুবন্ধনীর চাপ অবমুক্ত করুন। নাড়ী ফিরে আসার সময়ের চাপই সিস্টোলিক চাপ। যখন স্টেথোস্কোপের শব্দ শুনতে অসুবিধা হয় তখন এ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ যেমন– গর্ভাবস্থায়, ব্যায়ামরত অবস্থায়, শক্ (Shock)-এ (যখন রক্তচাপ অনেক কম এবং হৃৎস্পন্দন দুর্বল)। হাতের কব্জির রেডিয়াল ধমনী এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়।
যান্ত্রিক শ্রবণ প্রক্রিয়ায় (স্টেথোস্কোপের সাহায্যে): স্টেথোস্কোপ আলতো ভাবে ব্রাকিয়াল ধমনীর সর্বোচ্চ স্পন্দন যেখানে পাওয়া যায় সেখানে রাখুন। এক্ষেত্রে ডায়াফ্রাম ব্যবহার করুন। স্টেথোস্কোপ সমানভাবে রাখতে হবে। বেশি চাপ দেবেন না। এতে রক্তনালী বিকৃত হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ সৃষ্টি হতে পারে যা রক্তচাপ নির্ণয়ে বিভ্রান্তির কারণ হয়। স্টেথোস্কোপ কাপড়, বাহুবন্ধনী অথবা রাবার টিউবের সাথে যাতে না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। এতে ঘর্ষণজনিত শব্দ সৃষ্টি হতে পারে। রক্তচাপ পরিমাপের সময় বাহুর অবস্থান হবে হৃৎপিণ্ডের একই সমতলে (যা বুকের চ্যাপ্টা অস্থি স্টার্নাম এর মধ্য অংশ দিয়ে নির্দেশিত)। তার নিচে বাহু ঝুলিয়ে রাখলে রক্তচাপ বেশি পাওয়া যাবে এবং উপরে তুলে রাখলে তা কম পাওয়া যাবে (১০ মি.মি. পর্যন্ত)। বাহুর ভার যাতে ব্যক্তি বিশেষকে বহন করতে না হয় তার ব্যবস্থা করা আবশ্যক। তাই কনুইকে ধরে রাখতে হবে কিংবা পুরো হাতকে কিছু একটার উপর রাখতে হবে অন্যথায়, বসা কিংবা দাঁড়ানো অবস্থায় ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ ১০% পর্যন্ত বাড়তে পারে। প্রথমবার উভয় বাহুতে রক্তচাপ মাপা উচিত। সাধারণত সিস্টোলিক রক্তচাপ ১০ মি.মি. এবং ডায়াস্টোলিক চাপ ৫ মি.মি. পর্যন্ত দুই বাহুতে কম বেশি হতে পারে। ডানহাতিদের তা ডানদিকে বেশি হয়। তবে এই পার্থক্য সিস্টোলিক ২০ মি.মি. এর বেশি এবং ডায়াস্টোলিক ১০ মি.মি. এর বেশি হলে তা হৃদরোগ কিংবা রক্তনালীর অসুখের কারণে কিনা তা খতিয়ে দেখা আবশ্যক।
রক্তচাপ ও তার পরিমাপের বিভিন্ন তাত্ত্বিক দিকের আলোকে সঠিকভাবে রক্তচাপ পরিমাপের জন্য সংক্ষিপ্ত নির্দেশিকা নিম্নরূপ:
আরামদায়কভাবে বসে থাকুন। ভালো হয় একটা শান্তরুমে কিছু সময় যদি বিশ্রামে থাকেন। রক্তচাপ পরিমাপের অন্তত ২ ঘণ্টা ধূমপান, কফি কিংবা মদ্যপান করবেন না।
উপযুক্ত সাইজের বাহুবন্ধনী নির্ধারণ করুন। ব্লাডারের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ মধ্যবাহুর যথাক্রমে ৮০% এবং ৪০% হবে।
বাহুবন্ধনী বাহুতে এমনভাবে জড়িয়ে নিবেন যাতে তা খুব হালকা কিংবা খুব আঁটসাট না হয়। ব্লাডারের কেন্দ্রবিন্দু থাকবে বাহুর ব্রাকিয়াল ধমনীর উপরে এবং বাহুবন্ধনীর নীচের প্রাপ্ত কনুইয়ের ২ সেঃ মিঃ উপরে থাকবে।
বাহুবন্ধনী হৃৎপিণ্ডের একই সমতলে আছে কিনা তা নিশ্চিত হোন–রোগীর অবস্থান যাই হোক না কেন।
পাম্প করে বাহুবন্ধনীর চাপ বৃদ্ধি করুন। যতক্ষণ পর্যন্ত না কব্জি নিকটস্থ রেডিয়াল নাড়ী বন্ধ হয়। চাপমান যন্ত্রে এ সংখ্যাটি লক্ষ্য করুন। চাপ ছেড়ে দিন; ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা করুন। তারপর চাপ আগের সংখ্যার ৩০ মি:মি: উপরে তুলুন।
এবার চাপ ধীরে ধীরে কমান–সেকেন্ডে ২–৩ মি.মি. কিংবা আরো কম। বাহুবন্ধনীর চাপ অপসারণকালীন ব্রাকিয়াল ধমনীতে রক্তপ্রবাহ শুরুর সময় প্রথম শব্দ শোনার মুহূর্তের চাপই সিস্টোলিক চাপ। আর শব্দ যখন সম্পূর্ণ চলে যায় তখনকার চাপই ডায়াস্টোলিক চাপ।
যখন সব শব্দ চলে যায় তখন বাহুবন্ধনী তাড়াতাড়ি এবং সম্পূর্ণভাবে বায়ুশূন্য করুন, যাতে হাতের শিরায় রক্ত জমে না যায়।
একই বাহুতে পুনর্বার রক্তচাপ পরিমাপের আগে ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা করুন।
এই পরিমাপগুলোর গড় করুন। যদি প্রথম দুইটা পরিমাপের মধ্যে সিষ্টোলিক ৬ মি:মি: এর বেশি অথবা ডায়াস্টোলিক ৪ মি.মি. এর বেশি পার্থক্য হয় কিংবা যদি প্রথম পরিমাপ খুব বেশি পাওয়া যায় তবে পরিপূর্ণ বিশ্রামের পর একই নিয়মে আরো কয়েকবার মেপে দেখুন।
প্রথমবার উভয় বাহুতে রক্তচাপ মেপে দেখুন, বিশেষত: দু‘দিকে নাড়ীর গতির কোনো পার্থক্য
মনে হলে। দু‘দিকের রক্তচাপের ৫ মি.মি. পর্যন্ত তারতম্য গ্রহণযোগ্য। তারতম্য অনেক বেশি
হলে যে পরিমাপটা বড় সেটাই গ্রহণ করবেন।
বয়স্কদের ক্ষেত্রে বসা এবং দাঁড়ানো উভয় অবস্থায় রক্তচাপ পরিমাপ করুন। ডায়াবেটিস
রোগী এবং উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সেবনকারীদের ক্ষেত্রেও তা করা আবশ্যক।
সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক চাপ নিকটবর্তী ‘মি.মি. পারদে‘ প্রকাশ করুন। তা নিকটবর্তী
বা ১০ মি.মি. এ শেষ করবেন না। সংখ্যাপ্রীতি পরিহার করুন।
রক্তচাপ মাপার সাথে সাথে তা লিখে রাখুন।
কোন বাহুতে তা নিলেন এবং তখন রোগীর অবস্থান (বসা, দাঁড়ানো, শায়িত) নির্দেশ করুন।
উচ্চ রক্তচাপগ্রস্ত সবার ঘরে রক্তচাপ পরিমাপের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য যন্ত্র এবং নির্ভুল পদ্ধতি মেনে চলা আবশ্যক। ঘরে রক্তচাপ পরিমাপের সুবিধা হচ্ছে এতে দিনের বিভিন্ন সময় অনেকগুলো পরিমাপ সম্ভব। এভাবে দৈনন্দিন জীবনের কাছাকাছি পরিবেশে রক্তচাপ দেখা যায়। এ ব্যবস্থায় রোগী তাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়, যা তাদের চিকিৎসার প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি করে। ঘরে রক্তচাপ পরিমাপ উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসার কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য মূল্যবান ব্যবস্থা।
সঠিকভাবে রক্তচাপ পরিমাপ করুন; অন্যদের তা মাপতে উৎসাহিত করুন। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করুন, দীর্ঘায়ু হোন।
লেখক: হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, সভাপতি, বাংলাদেশ হাইপারটেনশন
এন্ড হার্ট ফেইলিউর ফাউন্ডেশন।