সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো যাবে না যেভাবেই হোক লাভজনক রাখুন

| বৃহস্পতিবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২৫ at ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর সরকারি সিদ্ধান্তে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অনেক মানুষ সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভর করে সংসারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য আনতে চায়। এ কারণে সরকার পরিচালিত সঞ্চয়পত্র ক্রয় করে থাকে। যেখানে সরকারের দায়িত্ব নাগরিকের ভালোমন্দ দেখভালের, সেখানে সরকারই সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মূলত বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার এত দিন সঞ্চয়পত্র বিক্রির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বর্তমানে সরকার মূলত ট্রেজারি বিল ও বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে সস্তায় ঋণ গ্রহণের দিকে ঝুঁকছে। যেহেতু এসব বিলবন্ডের গড় সুদহার বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের চেয়ে বেশ কম, সেহেতু সরকার আবারও সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে সরকারের ঋণের ব্যয় সাশ্রয় হবে। কিন্তু বিপদে পড়বেন অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। যাঁরা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, তাঁরা বড় ধরনের আর্থিক চাপের মুখে পড়বেন। ধারণা করা হচ্ছে, সরকার মূলত ঋণের ব্যয়ভার কমানো এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পালনের তাগিদে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা কার্যকরী হবে আগামী জানুয়ারি থেকে। বর্তমান সুদহার আরও দেড় শতাংশ কমানো হবে। এবারই প্রথম নয়, এর আগে ২০২১ সাল থেকে কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ যখন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে, তখন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানো এই শ্রেণিটিকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইতিমধ্যে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিতে দৃশ্যমান দেখা যাচ্ছে।

সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বাড়লে কেউ ব্যাংকে টাকা রাখবে না বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছিলেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা হার বাড়িয়ে দিলে সবাই সঞ্চয়পত্র কিনবে, ব্যাংকে টাকা রাখবে না। ব্যাংকেও তো তারল্যের ব্যাপার আছে। ব্যালেন্স করে দেখতে হবে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে দিলে ব্যাংক কোত্থেকে টাকা পাবে? দেশের ব্যাংকখাত পুনরুদ্ধারের চেষ্টার কথা জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, খারাপ ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে। ইসলামী ব্যাংক এর একটি উদাহরণ। এ ব্যাংকে আস্থা ফিরে আসছে। অন্য ব্যাংকগুলোর জন্য ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্ট করা হয়েছে। এটার প্রথম শর্ত হলো যারা ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছে তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। কারও টাকা মার যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ক্রমেই নেতিবাচক ধারার দিকে যাচ্ছে। গত জুলাই মাসে নিট বিক্রি কমেছে ৪১ শতাংশের বেশি। মানুষ এখন সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য বিকল্প খুঁজছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও চাইছে, মানুষের আগ্রহ সঞ্চয়পত্র থেকে ট্রেজারি বিল বা বন্ডের মতো বিকল্প বিনিয়োগের উৎসের দিকে যাক।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের এই কৌশলগত সিদ্ধান্তকে প্রশংসনীয় বলা যেত, যদি এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের জন্য বিকল্প, নিরাপদ ও উচ্চ মুনাফার বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করে দিত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চ, সেখানে কেবল সুদের হার কমানো একটি অবিবেচনাপ্রসূত ব্যাপার বলতে হবে। সরকার সস্তায় ঋণ নিতে গিয়ে নাগরিকের একটি বৃহৎ অংশকে আর্থিক নিরাপত্তার ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও আর্থিক প্রভাব পুরো অর্থনৈতিক খাতে পড়বে। এতে সাধারণ মানুষ এবং সঞ্চয়পত্রের টাকার ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবনে আর্থিক দুর্গতি সৃষ্টি হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগের বিকল্প কম। বয়স্ক অনেক মানুষ তাঁদের জীবনযাপনের ব্যয় সঞ্চয়পত্রের আয় থেকে করে থাকেন। অনেক অবসরপ্রাপ্ত ও বয়স্ক নাগরিক আছেন, যাঁদের দীর্ঘদিনের সঞ্চয়ের অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে সঞ্চয়পত্রের আয় থেকেই চলেন। তাই সঞ্চয়পত্রের আয় বৃদ্ধি পেলে তাঁদের দৈনন্দিন খরচ নির্বাহ করা সহজ হবে। বলা বাহুল্য, সঞ্চয়পত্র এক প্রকার নিরাপদ বিনিয়োগরূপে বিবেচিত হয় সমাজে। অনেকে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করে পেনশনাররূপে তাঁর অর্থ সরকারের নিকট জমা রাখেন। তা থেকে প্রাপ্ত মুনাফাই ঐ সকল ব্যক্তির আয়ের প্রধান উৎস হয়ে থাকে। অনুরূপ পারিবারিক সঞ্চয়পত্রও রয়েছে এবং বলা জরুরি যে, এই মুনাফার ওপর সমগ্র পরিবার নির্ভরশীল। নির্দিষ্ট মুনাফার উপর জীবিকা নির্বাহ এদের কঠিন হলেও অনেকের বিকল্প উপায়ও থাকে না। কিংবা অন্যান্য ব্যবসা বা বিনিয়োগের সামর্থ্যও থাকে না। তারা সরকার নির্দিষ্ট মুনাফা দেখেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকেন এবং সেই অনুপাতে ব্যয় নির্বাহ করেন। কিন্তু হঠাৎ মুনাফার হার হ্রাস পেলে ব্যয়ের খাতে চাপ পড়া স্বাভাবিক। তাই যেভাবেই হোক, দেশের সঞ্চয় ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য সঞ্চয়পত্রকে লাভজনক রাখতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধসুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : কবি ও ঔপন্যাসিক