আগামী ছয় মাসের জন্য সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার সরকার যেই হারে কমিয়েছে, তা গ্রাহকদের জন্য দুঃসংবাদ শুধু নয়, এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে তাদের মনে। সরকারের নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী পাঁচ বৎসর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ মুনাফার হার পাওয়া যাবে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যা পূর্বে ছিল ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অনুরূপ মেয়াদ কম অনুসারে মুনাফার হারও আনুপাতিক হারে হ্রাস পাবে। একদিকে দাবি অনুযায়ী বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি হয়নি, অন্যদিকে দেশে দুই বছরের অধিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলমান। এ অবস্থায় জীবিকা নির্বাহে সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় নির্ভরশীলগণ আরও হিমশিম খাবেন–তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তে সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রকৃত নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবন আরো নাস্তানাবুদ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, নিম্নবিত্ত, নিম্ন–মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগের বিকল্প কম। বয়স্ক অনেক মানুষ তাঁদের জীবনযাপনের ব্যয় সঞ্চয়পত্রের আয় থেকে করে থাকেন। অনেক অবসরপ্রাপ্ত ও বয়স্ক নাগরিক আছেন, যাঁদের দীর্ঘদিনের সঞ্চয়ের অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে সঞ্চয়পত্রের আয় থেকেই চলেন। এখন তাঁদের দৈনন্দিন খরচ নির্বাহ করা কঠিন হবে।
কেননা, সঞ্চয়পত্র এক প্রকার নিরাপদ বিনিয়োগরূপে বিবেচিত হয়। অনেকে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করে পেনশনাররূপে তাঁর অর্থ সরকারের নিকট জমা রাখেন। তা থেকে প্রাপ্ত মুনাফাই ঐ সকল ব্যক্তির আয়ের প্রধান উৎস হয়ে থাকে। অনুরূপ পারিবারিক সঞ্চয়পত্রও রয়েছে এবং বলা বাহুল্য, এই মুনাফার ওপর সমগ্র পরিবার নির্ভরশীল। নির্দিষ্ট মুনাফার উপর জীবিকা নির্বাহ এদের কঠিন হলেও অনেকের বিকল্প উপায়ও থাকে না। কিংবা অন্যান্য ব্যবসা বা বিনিয়োগের সামর্থ্যও থাকে না। তারা সরকার নির্দিষ্ট মুনাফা দেখেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকেন এবং সেই অনুপাতে ব্যয় নির্বাহ করেন। কিন্তু হঠাৎ মুনাফার হার হ্রাস পেলে ব্যয়ের খাতে চাপ পড়া স্বাভাবিক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্ত আর অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের নিরাপদ বিনিয়োগের খাত সঞ্চয়পত্র এখন সরকারেরও মনোযোগ হারাচ্ছে। দফায় দফায় ব্যাংকের আমানতের সুদের হার বেড়ে ১৩ শতাংশে উঠলেও গত তিন বছর ধরে ১১.৭৩ শতাংশে আটকে আছে সঞ্চয়পত্র। সাধারণত একে আকর্ষণীয় রাখতে এর সুদের হার ব্যাংকের চেয়ে বেশি থাকার রীতি থাকলেও এদিকে সরকারের মনোযোগ নেই বললেই চলে। বিশ্লেষকদের ধারণা, সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার অনাগ্রহ থেকেই সম্ভবত সুদের হার বাড়াচ্ছে না। বরং কমছে। অথচ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেই যাদের অনেকের সংসার চলে, তারা এখন হতাশ। একসময় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার দিক থেকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল সঞ্চয়পত্র, যা ব্যাংক আমানতের সুদহারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আর এখন ব্যাংক আমানতের সুদহারের চেয়ে অনেক কম মুনাফা মিলছে। এমনকি এখন সঞ্চয়পত্রের চেয়ে সরকারের করা ব্যাংক ঋণে বেশি সুদ গুনছে।
তাঁরা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। ফলে তাঁরা এখন দৈনন্দিন খরচের চাপ সামলে আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছেন না। অন্যদিকে সম্পদশালীদের মধ্যে যাঁরা নামে–বেনামে এক সময় সঞ্চয়পত্রে বিপুল বিনিয়োগ করতেন, তাঁদেরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের আগ্রহ কমেছে। আবার কিছু ব্যাংক আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারায় মানুষের মধ্যে নগদ টাকা রেখে দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিভাবে মুনাফার হার বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগকারীদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায় তজ্জন্য জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরকে আরও তৎপর হতে হবে। এই ছয় মাসের জন্য সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে সরকারের যুক্তি–ট্রেজারি বন্ডের সুদহার হ্রাস পেয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল–আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করবার শর্ত ছিল। যার ফলে ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদহার যুক্ত করা হয়। তাই আমরা মনে করি, সরকারকে এ বিষয়ে আবারও ভাবতে হবে। বিশেষ করে সরকারের আর্থিক নীতি নির্ধারণে অবশ্যই দেশের মানুষের স্বার্থ সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনতে হবে।