দেশে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে। বিক্রি কমে গেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, মধ্যবিত্ত আর অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের নিরাপদ বিনিয়োগের খাত সঞ্চয়পত্র এখন সরকারেরও মনোযোগ হারাচ্ছে। দফায় দফায় ব্যাংকের আমানতের সুদের হার বেড়ে ১৩ শতাংশে উঠলেও গত তিন বছর ধরে ১১.৭৩ শতাংশে আটকে আছে সঞ্চয়পত্র। সাধারণত একে আকর্ষণীয় রাখতে এর সুদের হার ব্যাংকের চেয়ে বেশি থাকার রীতি থাকলেও এদিকে সরকারের মনোযোগ নেই বললেই চলে। বিশ্লেষকদের ধারণা, সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার অনাগ্রহ থেকেই সম্ভবত সুদের হার বাড়াচ্ছে না। অথচ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেই যাদের অনেকের সংসার চলে, তারা এখন হতাশ। একসময় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার দিক থেকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল সঞ্চয়পত্র, যা ব্যাংক আমানতের সুদহারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আর এখন ব্যাংক আমানতের সুদহারের চেয়ে অনেক কম মুনাফা মিলছে। এমনকি এখন সঞ্চয়পত্রের চেয়ে সরকারের করা ব্যাংক ঋণে বেশি সুদ গুনছে।
ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদহার ১৩.১৯ শতাংশ। এই উচ্চ সুদে সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে টাকা তুললেও সঞ্চয়পত্রে নজর কম দিচ্ছে সরকার। এর নেপথ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশন। আইএমএফ থেকে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার আগে সঞ্চয়পত্রে সুবিধা কমিয়ে বন্ড উৎসাহিত করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে।
এর পর থেকেই বন্ডের সুবিধা বাড়িয়ে যাচ্ছে সরকার। আর সঞ্চয়পত্রে সুবিধা না বাড়িয়ে উল্টো ঋণ নেওয়া কমিয়ে টাকা পরিশোধ করছে।
সমপ্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই–সেপ্টেম্বরে ১৪ হাজার ৯৯২ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ২১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে নতুন করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বা ৩১ শতাংশ কমেছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ধনী গোষ্ঠীর অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন। এ সময়ে ব্যবসা–বাণিজ্যের গতিও শ্লথ হয়েছে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া বিল–বন্ডের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ বিল–বন্ডে স্থানান্তর হয়েছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বিল–বন্ড ও ব্যাংকের আমানতে উচ্চ সুদের কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ যতটা কমেছে, তার চেয়ে বেশি কমেছে মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমে যাওয়ায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এই দুটি শ্রেণির মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমেছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, সামপ্রতিক সময়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। ফলে তাঁরা এখন দৈনন্দিন খরচের চাপ সামলে আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছেন না। অন্যদিকে সম্পদশালীদের মধ্যে যাঁরা নামে–বেনামে এক সময় সঞ্চয়পত্রে বিপুল বিনিয়োগ করতেন, তাঁদেরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের আগ্রহ কমেছে। আবার কিছু ব্যাংক আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারায় মানুষের মধ্যে নগদ টাকা রেখে দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, ব্যাংকে আমানতের সুদহার বাড়ার কারণে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহারও বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইএমএফের ঋণের শর্তের কারণে এই সুদহার বাড়ানোর বিষয়টি গতি পায়নি। তবে পেনশনার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের প্রতি মাসে সুদের টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া ওয়েজ অনার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডসহ সঞ্চয় অধিদপ্তর পরিচালিত ১১টি সঞ্চয় স্কিমের বিনিয়োগগুলো মেয়াদ শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করার সুবিধা বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যেভাবেই হোক, দেশের সঞ্চয় ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য সঞ্চয়পত্রকে লাভজনক রাখতে হবে।